ভিডিও EN
  1. Home/
  2. একুশে বইমেলা

সেবুলের ছোটকাগজ

লিটল ম্যাগাজিনের বৈপ্লবিক জাগরণ

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ১২:৪৭ পিএম, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫

অনন্য কাওছার

প্রথাবিরোধী সমাজচিন্তা ও অবাণিজ্যিক সাহিত্য প্রকাশের অবিকল্প আশ্রয় হিসেবে গড়ে উঠেছিল ছোটকাগজের সাহিত্য। নবীন-প্রবীণ লেখকদের মুক্তচিন্তা ও আধুনিকতাবাদী রাইটিং সদর্পে জায়গা করে নিতো এসব লিটল ম্যাগাজিনে। প্রচলিত প্রথাকে ভেঙে নবীন মতবাদ ও ঘূণে ধরা সমাজের আমূল-পরিবর্তনের প্রয়াসে নির্মিত প্রবন্ধ, মুক্তগদ্য, কবিতা ও গল্প-উপন্যাস প্রকাশিত হতো যত্ন সহকারে। ছোটকাগজের সাহিত্য বা লিটল ম্যাগাজিনের লেখকদের নিয়েই গড়ে উঠতো ভিন্ন ভিন্ন লেখকগোষ্ঠী। স্বদেশি কিংবা বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে তাদের বৈপ্লবিক উত্থান অনস্বীকার্য। ছোটকাগজের সাহিত্য মানে কেবল ছোট ছোট লেখকদের ব্যাপার, এমনটি নয় বরং এতে কিংবদন্তি কবি-সাহিত্যিকদের হাতেখড়ি হয়েছিল। অবশ্য ছোটকাগজের সাহিত্যে নবীনদের জাগরণী চেতনার বিশুদ্ধতম পরিচর্যার সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে।

গবেষকদের মতে, ঐতিহাসিক সূত্রে প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্রের হাত ধরে এ অঞ্চলে লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু হলেও আক্ষরিক অর্থে বুদ্ধদেব বসুর প্রগতি ও কবিতা পত্রিকায় পাশ্চাত্য থেকে শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন ফর্ম ও ধারার বিকাশ ঘটেছে সমগ্র উপমহাদেশে। ১৭৩১ সালে এডওয়ার্ড কেভ সম্পাদিত ‘The gentlemen’s magazine’-এ সর্বপ্রথম ম্যাগাজিন শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিভিন্ন রকমের উপাদানের সংমিশ্রণ অর্থে ‘স্টোরহাউজ’ থেকে ম্যাগাজিন শব্দের উৎপত্তি।

এ ছাড়া রালফ ওয়াল্ডো ও মার্গারেট ফুলার সম্পাদিত ‘দি ডায়াল’-এর মাধ্যমে পাশ্চাত্যে লিটল ম্যাগাজিনের গোড়াপত্তন। অবশ্য বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে হেরিয়েট মনরো ও এজরা পাউন্ড সম্পাদিত ‘Poetry: A magazine of verse (1912)’ প্রকাশিত হয়। গবেষকদের মতে, এ ম্যাগাজিন এতই জনপ্রিয় ছিল যে, এখানে কোনো নতুন কবির লেখা ছাপা হলে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হতো না। ছোটকাগজের সাহিত্য যৎসামান্য কিছু নয়। এটি বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিকের বৈপ্লবিক উত্থানের সবুজ উদ্যান।

লেখা নির্বাচনের ক্ষেত্রে উদারচিত্ত ও মহৎপ্রাণ সম্পাদকের কৃতিত্বও উল্লেখযোগ্য। এস এম সেবুল তেমন একজন বিচক্ষণ সাহিত্য সম্পাদক। নবীনদের প্রতিভা বিকাশের জন্য তিনি প্রফুল্লচিত্তে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রকৃত কবি হিসেবে এখানেই তিনি সার্থক। এ প্রসঙ্গে বলতে হচ্ছে, সংকীর্ণ মন-মানসিকতা দিয়ে উৎকর্ষ সাহিত্য বা শিল্পের চর্চা অসম্ভব। এটি বুঝে উঠতে অনেকের গোটা জীবন চলে যায়। তবুও বিশুদ্ধতার আলোকবর্তিকা জ্বলে ওঠে না।

তার সম্পাদিত ‘নির্বাচিত’ ম্যাগাজিনে আমার ‘কাঁদি নিশিরাত’ (২০২১) কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। তখনকার দিনে এটি মোটেই স্বাভাবিক ছিল না। প্রবীণদের সমালোচনা উপেক্ষা করে যে তিনি কবিতাটি ছাপিয়েছিলেন— এতে প্রতীয়মান হচ্ছে তিনি একজন মানবিক কবি। প্রতিভার কদর করতে তিনি মোটেই কার্পণ্য বোধের পরিচয় দেননি। পরপর ‘পথিকৃৎ’ প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা এবং ‘খণ্ডচিত্র’ গ্রন্থের অন্যতম কবি হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। এর ধারাবাহিকতায় চূড়ান্তপর্বে শাশ্বত উদয়ন। তিনি তখনই বলতেন, লেখাগুলো জাতীয় পত্রিকার সমমানের। তার দূরদর্শিতা বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। এখন প্রায় সবগুলো দৈনিক জাতীয় পত্রিকায় নিয়মিতই লেখা ছাপা হচ্ছে। তার অনুপ্রেরণা আজও সাহস জোগায়। তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি অকুণ্ঠচিত্তে।

আরও পড়ুন
লিটলম্যাগ সংগ্রহশালা করছে বাংলা একাডেমি 
আখ্যান: সাহিত্যের নতুন আঙিনা ও কণ্ঠস্বর 

ছোটকাগজের সাহিত্য আজকাল তেমন একটা চোখে পড়ে না। অতি-আধুনিকায়ন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোটকাগজের বদলে সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি প্রকাশের প্রবণতা অধিক। তবুও স্বমহিমায় বাংলাদেশের বেশকিছু ছোটকাগজের সাহিত্য চলমান। এরমধ্যে অন্যতম ওবায়েদ আকাশের ‘শালুক’। শালুকের জীবনানন্দ দাশের সংখ্যাটি আমাকে অভিভূত করেছে। অপরদিকে গ্রামীণ সমাজের নিরেট বাস্তবতা ও অবক্ষয়ের কালো অন্ধকারে আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে কবি এস এম সেবুল।

তিনি ঝিমিয়ে পড়া আছিরগঞ্জের সাহিত্যের বৈপ্লবিক জাগরণের অন্যতম কবি। একাধারে যেসব লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদনা করেছেন; তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে—প্রত্যাশা পর্ব প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় সংখ্যা, ‘আত্মপ্রকাশ’, ‘উৎকর্ষ’, ‘প্রজ্ঞাদর্শন’, ‘নিরেট দর্পণ’, ‘দাহ’, ‘নির্বাচিত’, ‘পথিকৃৎ প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা’, ‘শাশ্বত উদয়ন’ এবং ‘খণ্ডচিত্র’ সম্পাদিত গ্রন্থ। ‘প্রত্যাশার আলো’ প্রেস থেকে ফিরে আসে রাজনৈতিক কারণে। এ ছাড়া প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থ ‘যদি জন্ম না নিতাম’।

জাতীয় দৈনিক জনকণ্ঠে একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছিল কবিতা। ১৯৯৭-৯৮ সালে মাসিক সুকন্যায় নিয়মিত লিখতেন। সিলেটের আঞ্চলিক পত্রিকাগুলো কবির নখদর্পণে ছিল। গ্রিসের প্রবাসজীবনে সুখানুভব থেকেও বিষাদে ভরে উঠেছিল তার আপাদমস্তক। বাংলা সাহিত্যের বইয়ের মলাটের ঘ্রাণ তাকে তাড়িয়ে ফিরতো। অজ্ঞাত অসুখে ইচ্ছাবিরুদ্ধ ফিরে আসেন বাংলাদেশে।

এখন নিয়মিত লিখছেন আর লিটল ম্যাগাজিনের বৈপ্লবিক জাগরণের মশাল জ্বেলে অতিবাহিত করছেন জীবন। লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদনা করতে গিয়ে আর্থিক জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। তবুও নিরলসভাবে সাহিত্যের সমৃদ্ধি ও শিল্পের উচ্চাভিলাস তাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। তিনি আছিরগঞ্জের সাহিত্যের ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবেন। পাঠকের অন্তর্লোকে জেগে থাকবেন চিরকাল।

এসইউ

আরও পড়ুন