ভিডিও EN
  1. Home/
  2. একুশে বইমেলা

বই পর্যালোচনা

সাদাকালো ক্যানভাসে স্মৃতিময় গল্প: একজন জাফরুল্লাহ চৌধুরী

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৩:৩৪ পিএম, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বঙ্গ রাখাল

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মারা গেছেন ২০২৩ সালের ১১ এপ্রিল। লেখক সাঈদ জামান দীর্ঘদিন থেকেছেন তাঁর সঙ্গে। সেসব স্মৃতি এবং বাবার স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন ‘সাদা কালো ক্যানভাসে স্মৃতিময় গল্প’ নামের বইটি। এর মাধ্যমে আমরা জেনেছি অনেক অজানা তথ্য। না হলে অনেক তথ্য অজানাই থেকে যেতো।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মানবতার এক ফেরিওয়ালার নাম। যিনি সারাজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে ভেবেছেন গরিব-দুঃখী আর মেহনতি মানুষের কথা। ছুটে গেছেন গ্রামে। শুনেছেন মানুষের কথা; নিয়েছেন তাদের খবর। চিকিৎসকদের গণস্বাস্থ্যে নিয়োগ দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন প্রত্যন্ত গ্রামে। কারণ গ্রামই তো একটি দেশের প্রাণের সঞ্চার করে। তিনি প্রতিটি গ্রামে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। যে কারণে প্রতিষ্ঠা করেছেন গণ বিশ্ববিদ্যালয়।

তিনি একজন সংগ্রামী, বিদ্রোহী ও বিপ্লবী মানুষ ছিলেন। সমাজকে পরিবর্তন করতে চাইতেন। এই পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন শিক্ষার আর ঠিকঠাক শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য তাদের সুস্থ থাকা অতীব দরকারী। এজন্য চিকিৎসাকেও তাদের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অসাধারণ মানুষ হয়েও জীবনযাপনে ছিলেন অতি সাধারণ। কোনো দিন কোনো আভিজাত্য তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি অনায়াসে মিশে যেতে পারতেন যে কোনো মানুষের সাথে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা টং দোকানে বসে চা পান করতেন। অতি সচেতন হয়েও রাস্তার ধারের মুখরোচক খাবার খেতে পছন্দ করতেন।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ভোজনপ্রিয় মানুষ ছিলেন। তিনি খেতে পছন্দ করতেন। প্রাণিকুলের প্রতিও ছিল তাঁর অসীম ভালোবাসা। একবার এক কুকুর হারিয়ে যাওয়ায় পুরো হাসপাতাল চিৎকার করে মাথায় তুলেছিলেন। এরপর সেই কুকুরটাকে সাথে করে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন।

তিনি একবার ডায়ালাইসিস করে চেয়ারে বসে কাঁদছেন। সবাই অবাক! কাঁদছেন কেন? যে মানুষটাকে তাঁর পিতা-মাতা মারা গেলেও কেউ কাঁদতে দেখেননি; সেই মানুষটা আজ কাঁদছেন কেন? এভাবে পাহাড়ের সমান যার দৃঢ়তা; সেই মানুষকে কাঁদতে দেখে স্ত্রী শিরীন হক অবাক। তিনি কাঁদছিলেন গরিব আর অসহায় মানুষের কথা ভেবে। যাদের সপ্তাহে তিন-চার বার ডায়ালাইসিস নিতে হয় তাদের কথা ভেবে। তারা এত টাকা কোথায় পাবে?

স্ত্রী শিরিন হক সেদিন তাঁর গায়ে হাত রেখে বলেছিলেন, প্রয়োজনে অন্য প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিয়ে ফান্ড রেইজ করে তুমি গরিবের জন্য ডায়ালাইসিস ইউনিট চালু করো। সেদিন থেকেই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী পথে নেমে গেলেন এবং পরবর্তীতে তাঁর স্বপ্নকে তিনি বাস্তবায়ন করেন। তিনি গরিব-দুঃখীদের ডায়ালাইসিস করার জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা করেন।

তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। জীবন বাজি রেখে সেসময় যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা করার জন্য স্থাপন করেন ফিল্ড হাসপাতাল। সাধারণ মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তিনি নার্স হিসেবে হাসপাতালে কাজে লাগিয়েছেন। তিনি সব সময় হাসি-খুশি এবং পরিশ্রমী তরুণ-তরুণীদের বেছে নিতেন। তিনি জানতেন চিকিৎসা এমন একটা পেশা; যেখানে আন্তরিকতা না হলে রোগীদের মনের খবর জানা যায় না। রোগির অর্ধেক রোগ ডাক্তারদের ভালো ব্যবহারেই ভালো হয়ে যায়।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দীর্ঘসময় ধরে রোগী দেখতেন। তাদের সাথে কথা বলতে বলতে অনেক কিছু জানার চেষ্টা করতেন। নিজে যেমন অল্প সময় ধরে রোগী দেখতেন না; তেমনই কোনো ডাক্তার অল্প সময় রোগী দেখলে তা পছন্দ করতেন না। তিনি সব সময়ই ডাক্তারদের সময় নিয়ে রোগী দেখার জন্য নির্দেশ দিতেন। রোগী দেখা তো কোনো তাড়াতাড়ি করার কাজ নয়। আন্তরিকতা দিয়ে রোগী দেখলে তাদের মন ভালো হয়ে যায়। তাদের রোগের কারণ, আর্থিক অবস্থা, পারিবারিক অবস্থা সম্পর্কেও জরিপ চালাতে বলতেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বীরাঙ্গনাদের গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন। তাই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের চল্লিশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে ঊনত্রিশ জন বীরাঙ্গনাকে দেন গার্ড অব অনার। অনুষ্ঠানে বীরাঙ্গনা বোনদের আজীবন বিনা টাকায় চিকিৎসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে যৌনকর্মীদের আবাস উচ্ছেদ করলে জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাদের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে থাকার জন্য উন্মুক্ত করে দেন। কারণ তাঁর চোখে সবাই সমান। তাঁর চোখে সবাই সমান মানুষ হিসেবে বিবেচিত হতেন।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলা সিনেমা দেখতে পছন্দ করতেন। পড়ালেখা করতেন নিয়ম করে। পড়ার পাশাপাশি লিখতেনও অনেক। বিচার-বিশ্লেষণ ক্ষমতাও ছিল অপরিসীম। তার কাছে ব্যক্তিমালিকানা বলে কিছু ছিল না। তাঁর চিন্তায় ছিল সব সময় সামাজিক মালিকানা। সব উদ্যোগই ছিল সামাজিক। সমাজের উন্নয়নের জন্য তিনি কাজ করে গেছেন। তিনি সব সময় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজের স্বপ দেখেছেন। স্বাধীন দেশে স্বাস্থ্যসেবা, নারীর প্রগতি এবং গ্রামমুখী পেশার বিকাশের জন্য আমরণ চেষ্টা করে গেছেন।

লেখক সাঈদ জামান তার বাবাকে নিয়ে বলতে গিয়ে বাড়ির অনেক কথা বলেছেন। যেগুলো তার বাবার মুখ থেকে শোনা। বাবা ছোটবেলা থেকে কত কষ্ট করেছেন। তবুও হতাশ হননি। সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। বাবা বাসায় ফিরে তাকে নিয়ে পড়াতে বসতেন। সেটা চলে মেডিকেল পড়া পর্যন্ত। কিন্তু তিনি যখন ঢাকা চলে আসেন; তখন তাদের মধ্যে সেই আগের ভাবটা থাকলো না। বাবার কথা মনে পড়লে সবার আড়ালে গিয়ে চোখের জল ঝরান লেখক।

লেখকের বাবা মারা গেলে যেমন কষ্ট পেয়েছিলেন; ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মারা গেলেও অনেক বেশি কষ্ট পান। কেননা তিনিও তো লেখকের অন্য বাবা। দীর্ঘদিন তিনি তাঁর সংস্পর্শে থেকেছেন। সেবা শুশ্রূষা করেছেন। সেই আদেশ-উপদেশ শাসন লেখক ভুলতে পারেন না। এ যন্ত্রণা লেখককে ব্যথিত করেছে, তাড়িত করেছে। যে কারণে লেখাগুলো লেখকের পক্ষে এক জায়গায় করা সম্ভব হয়েছে। এ যেন লেখকের দায়। এই দায়ই যেন আজ লেখককে সবার কাছে পরিচিত করে তুলেছে।

এসইউ/জিকেএস

আরও পড়ুন