ভিডিও EN
  1. Home/
  2. একুশে বইমেলা

জেন্ডার বিশ্লেষণে ভিন্ন মাত্রা খুঁজে পাবে : হাসান ইকবাল

প্রকাশিত: ১০:৪৯ এএম, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

জেন্ডার নিয়ে লেখালেখি ও আলোচানার ক্ষেত্রে হাসান ইকবাল একটি নতুন নাম। প্রতিশ্রুতিশীল এ তরুণ লেখক-গবেষক নিয়মিত লিখছেন ছোটকাগজ ও ডেভেলপমেন্ট জার্নালে। তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন। বর্তমানে স্প্যানিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন- এডুকো’তে যোগাযোগ ও প্রকাশনা বিভাগে কর্মরত।   

অনেকটা আড়ালে থাকা এ মানুষটি সম্প্রতি তুলে ধরেছেন তার ভাষাভাবনা ও প্রকাশিত নতুন বইসহ নানান বিষয়। লেখালেখির জগত ও ব্যক্তিগত জীবনসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন জাগোনিউজ২৪.কমের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সালাহ উদ্দিন মাহমুদ।

জাগো নিউজ: এবারের বইমেলায় কী কী বই প্রকাশ হয়েছে?
হাসান ইকবাল: মেলার প্রথম সপ্তাহে এসেছে প্রবন্ধের বই ‘ভাষা, নারী ও পুরুষপুরাণ’। প্রকাশ করেছে অবসর প্রকাশনা সংস্থা।  এটি পওয়া যাবে বইমেলার ৪ নম্বর প্যাভিলিয়নে। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। এছাড়া মেলার দ্বিতীয় সপ্তাহে এসেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রবন্ধের বই ‘ভাটকবিতায় মুক্তিযুদ্ধ’। প্রকাশ করছে অয়ন প্রকাশন। কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধের বই ‘দেহকাব্য নারী : বাংলা কবিতায় নারী বন্দনা’ আসবে চৈতন্য প্রকাশন থেকে।

জাগো নিউজ: ‘ভাষা, নারী ও পুরুষপুরাণ’ লেখার অনুপ্রেরণা পেলেন কোথায়?
হাসান ইকবাল: এ গ্রন্থের লেখাগুলো শুরু করেছিলাম আজ থেকে প্রায় বছর দুয়েক আগে। আমার স্নেহময়ী, মমতাময়ী মা। যিনি নিজেও একজন নারী। তার অনুপ্রেরণায় আমার লেখাগুলো বাস্তব রূপ পেয়েছে। আমার লেখার ভাবনাগুলো ছিল নারীকে ঘিরে, নারী যে বিষয়গুলোর মধ্যদিয়ে অবদমিত হয়ে বাঁধা পড়ছে পুরুষতন্ত্রের শিকলে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই সে বিষয়গুলোই আমার লেখার অনুষঙ্গ। আর নারীর উপর ভাষিক নিপীড়ন এখন একটি স্বাভাবিক ঘটনা এবং সমাজতত্ত্বের এমন একটি প্রপঞ্চ যা নারী-পুরুষের সম্পর্কের স্বাভাবিক গতিকে সামাজিক অসমতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এদিকে ভাষা একটি শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে পুরুষাধিপত্যের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। পুরুষাধিপত্য বাস্তবায়নে যে শুধু পুরুষরাই কাজ করছে তা নয়, নারীদের একটা বিরাট অংশও প্রতিনিধিত্ব করছে। তাই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে পুরুষতন্ত্র, পিতৃতান্ত্রিকতা, ভাষার মাধ্যমে নারীর অধঃস্তনতা, বৃত্তের বলয়, পুরুষতন্ত্র, পুঁজিবাদ, নারীদের গৃহস্থালি কাজ ও শ্রমমূল্য নিয়ে আলোচনার পরিধি বিস্তৃত হয়েছে।

জাগো নিউজ: তার মানে ভাষার ডিসকোর্স কীভাবে নারীকে খাটো করে দেখে সেটিই প্রতিপাদ্য?
হাসান ইকবাল: পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় নারীকে খাঁচার ভেতর বন্দি রেখে পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই নারীর অধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর স্বাধীনতা মূল্যায়িত হয়। সাথে সংস্কৃতির একটি বড় অনুষঙ্গ যুক্ত হয়, সেটি হলো ভাষা। সে ভাষার ক্ষেত্রেও পুরুষাধিপত্য প্রতিষ্ঠার ষোলোকলা পূর্ণ করে, তৈরি করে লিঙ্গ বিভাজিত ভাষার এক বলয়। নারীর বিরুদ্ধে কিংবা পুরুষের পক্ষে ভাষার এই অবস্থান দেখা যায় কথ্য ও লেখ্য দু’ভাবেই। পুরুষতান্ত্রিক ভাষার নেতিবাচক (গালি) শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে নারীর সৃষ্টিশীলতা ও মনোজগতকে ভেঙেচুরে গুড়িয়ে দেয় দেবদূত পুরুষরা। তাই ভাষা যখন আধিপত্যশীল একটি গোষ্ঠীর বলয়ে আবদ্ধ হয়ে যায় তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে- ভাষা কি লিঙ্গ নিরপেক্ষ? ভাষা কেনইবা আধিপত্যবাদের কবলে পতিত? ভাষাগত এই বৈষ্যমের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এ গ্রন্থে।

জাগো নিউজ: ভাষা নিয়ে লৈঙ্গিক রাজনীতি আছে বলে মনে করেন?
হাসান ইকবাল: ব্যাপক অর্থে ভাষা হলো যোগাযোগের একটি বড় মাধ্যম। যে মাধ্যমটি সকল জনগোষ্ঠী দ্বারা অনুশীলিত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে লিঙ্গীয় প্রত্যাশাগুলো পুরুষাধিপত্যের ক্ষমতা কাঠামোর ঘেরাটোপে বন্দি। লিঙ্গগত বিভাজনে অসম আচরণ, লৈঙ্গিক রাজনীতির পাশাপাশি নারীকে অপেক্ষাকৃত নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়। বাস্তবে আমাদের সমাজে আধিপত্যশীল ক্ষমতা-কাঠামো টিকিয়ে রাখতে পুরুষেরা সমাজের প্রায় সকল স্তরে লিঙ্গীয় রাজনীতি বজায় রাখে। আমাদের ভাষায় জেন্ডারভিত্তিক নিরপেক্ষতার বিষয়টিও অনুপস্থিত। তবে বর্তমান সময়ে নারী ও পুরুষের প্রতি ভাষার আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যবহার, শব্দচয়নে পুরুষের প্রতি ভাষার প্রবল পক্ষপাতিত্ব এবং নারীর প্রতি ভাষার উদাসীনতার বিষয়টিও তুলে ধরেছি। এ গ্রন্থে নারীর অধঃস্তনতা বা নেতিবাচক দিক তুলে ধরার পাশাপাশি সমাজের লৈঙ্গিক রাজনীতি কিভাবে ভাষাকে পক্ষপাতিত্ব করে নারীকে অবদমন করছে, সেই অন্ধকারের ছবির স্বরূপ সন্ধান করেছি। অবশ্যই, ভাষার রাজনীতি ভয়াবহ, ভাষা নিয়ে লিঙ্গীয় রাজনীতি নারীকে অবদমন করে রাখছে।

hasan-inar
জাগো নিউজ: ভাষা নিয়ে লিখলেও প্রেক্ষাপট কি দেশের নাকি বাইরের?
হাসান ইকবাল: ‘ভাষা, নারী ও পুরুষপুরাণ’ বইটি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। আমি বড় পরিসরে জেন্ডারের বিস্তৃতি দেখাতে চেষ্টা করেছি। সমাজের নানা অনুষঙ্গে এই বিস্তৃতি কত সুদূরপ্রসারী ও কতটা শেকড়সংলগ্ন হতে পারে তাও উদাহরণ সহকারে তুলে ধরেছি। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত থেকে নারীর অধঃস্তনতার বিষয়টি দেখিয়েছি কিছুটা অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে।

জাগো নিউজ: ‘ভাষা, নারী ও পুরুষপুরাণ’- কাদের জন্য এই বই?
হাসান ইকবাল: বইটি নারীদের জন্য কিংবা পুরুষদের জন্য নিয়ে লেখা তা বললে ভুল হবে। আমরা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে এতো এগুচ্ছি। কিন্তু আমাদের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে জেন্ডার সংবেদনশীলতা নেই। বইটি আধিপত্যশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানুষদের সচেতন করার জন্য, যে সকল নারী ও পুরুষ পুরুষাধিপত্যকে প্রশ্রয় দেয় এবং লালন করে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্য। পুরুষরা তাদের নিজস্ব জায়গা থেকে তাদের  দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টালে নারী-পুরুষ মানুষ হিসেবে বাঁচবে। এই বইটি শিক্ষার্থী ও গবেষকদের প্রয়োজন মেটাবে। জেন্ডার বিশ্লেষণে ভিন্ন মাত্রা খুঁজে পাবে তারা। এ গ্রন্থের পাঁচটি অধ্যায়ে মোট চৌদ্দটি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জেন্ডার, নারী, লৈঙ্গিক রাজনীতি, ভাষিক নিপীড়ন ও লিঙ্গ নিরপেক্ষ ভাষা নিয়ে যারা গবেষণা ও লেখালেখি করছেন- এ গ্রন্থটি তাদের বেশ কাজে লাগবে।

জাগো নিউজ: আপনার প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি কেমন ছিল?
হাসান ইকবাল: আমার প্রথম বই বেরিয়েছিল ২০১৪ সালের একুশে বইমেলায়। নেত্রকোনার আঞ্চলিক লোকসাহিত্য নিয়ে প্রবন্ধের বই। প্রবন্ধগুলো ছিল দুটি অনুষঙ্গ নিয়ে ‘নেত্রকোনার প্রবাদ-প্রবচন ও লোকছড়া’। এই বইটির প্রতিটি লাইনের সাথে অনেক রাতজাগা স্মৃতি জড়িয়ে আছে। প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতিটা আসলে অন্যরকম দ্যোতনায়, ভালোলাগায় ভরপুর।  হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করার পর যখন পোস্ট অপারেটিভে আমার কন্যার মুখ প্রথম দেখলাম ঠিক সেরকম। একটা স্বর্গীয় অনভূতি।  

জাগো নিউজ: প্রথম বই সম্পর্কে যদি কিছু আলোকপাত করেন-
হাসান ইকবাল: নেত্রকোনার লোকসংস্কৃতির যে নানা অনুষঙ্গ রয়ছে তা থেকে কুড়িয়ে এনেছিলাম অনেক মুক্তামানিক। ওই গ্রন্থে নেত্রকোনা অঞ্চলে প্রচলিত প্রবাদ-প্রবচন ও লোকছড়া গ্রন্থিত হয়েছে। এতে ২২৫টি লোকছড়া এবং ৩৭৩টি প্রবাদ-প্রবচন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এককথায় নেত্রকোনার আঞ্চলিক লোকসাহিত্য নিয়ে একটি অনবদ্য সংকলন এটি।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশে নারীদের অবস্থা কেমন?
হাসান ইকবাল: সাধারণভাবে বলতে গেলে আমাদের দেশের মেয়েরা বিগত সময়ের চেয়ে এগিয়েছে অনেক দূর। সমাজের প্রাইভেট ডমেইন থেকে পাবলিক ডমেইনে এসে তারা কাজ করছেন, পড়াশোনা করছেন এমনকি পেশাগত দায়িত্বও পালন করছেন। কিন্তু এই ভালো খবরগুলো অপ্রতুল। প্রতিদিন দুঃসংবাদগুলোই কানে আসছে।  

জাগো নিউজ: কোন বই পড়ছেন এবং কী বিষয়ে লিখছেন এখন?
হাসান ইকবাল: মারিয়া মিজ ও ভান্দানা শিবার লেখা ‘ইকোফেমিনিজম-ক্রিটিক, ইনফ্লোয়েন্স, চেন্জ’ পড়ছি। আরো কিছু জার্নাল আছে। সান্ড্রা লেপটিজ বেমের ‘The Lenses of Gender : Transforming the Debate on Sexual Inequality’ পড়া শেষ হলো। সামনে ‘উইমেন স্পেস’ নিয়ে লেখার পরিকল্পনা করছি।

জাগো নিউজ: তরুণ লেখক হিসেবে আমাদের প্রকাশনা সম্পর্কে কিছু বলুন-
হাসান ইকবাল: এই বিষয়টি আমাকে অবাক করে- এদেশে অনেক বই-ই যথাযথ সম্পাদনা ছাড়া প্রকাশিত হয়ে পাঠকের মুখ দেখে। এ বিষয়টি আমাকে খুব পীড়া দেয়। বাংলাদেশে এখন অনেক ভালো সম্পাদনা হচ্ছে- ভালো বই বের হচ্ছে। তাদের দেখেও তো বাকিরা শিখতে পারে। এবারের বইমেলায় আমি অনেক প্রকাশনা দেখেছি- ভুল বানানে ভরপুর। বইয়ের আঙ্গিক, সাজসজ্জা, প্রচ্ছদ ও লেখার মানের দিকে বিন্দুমাত্র সুনজর নেই। তবে লেখকদেরও দোষ আছে। একটা বই বের করতেই হবে।  না হলে মান যায়। তাদের না থাকে ভালো সম্পাদনার জ্ঞান, না আছে নান্দনিক শিল্পবোধ। বিশ্বের অনেক দেশে প্রকাশনা নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা চালু আছে। আমাদের দেশে এটা এখনো সে পরিসরে নেই। প্রচুর বই ছাপা হয় প্রতিবছর একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে- কিন্তু প্রকাশনা শিল্প সেভাবে একটা ভালো জায়গায় দাঁড়াতে পারেনি এখনো।  

জাগো নিউজ: অবসরে কী করা হয়?
হাসান ইকবাল: বই পড়া হয়- এটা ঘুমের ওষুধ। স্লিপিং পিল প্রয়োজন হয় না।

জাগো নিউজ: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
হাসান ইকবাল: জাগো নিউজকেও অসংখ্য ধন্যবাদ ও শুভকামনা।

এসইউ/এবিএস