ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

সুস্থ মাটি, সুস্থ শহর: বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের বার্তা

ফিচার ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:১৪ পিএম, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫

মাহমুদুল হাসান চৌধুরী

প্রতিবছর ৫ ডিসেম্বর পালিত হওয়া বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২৫ সালে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, কারণ সাম্প্রতিক দশকে বিশ্বব্যাপী নগরায়নের উন্মত্ত গতি কেবল কৃষিজমির উৎপাদনশীলতা কমিয়ে আনছে না, বরং শহরের বাসযোগ্যতা, পানির পুনর্ব্যবস্থাপনা, বায়ুমণ্ডলের মান এবং জলবায়ু স্থিতিশীলতাকেও গভীর হুমকির মুখে ফেলেছে। এই প্রেক্ষাপটে এফএও ঘোষণা করেছে ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য ‘হেলদি সোয়েলস ফর হেলদি সিটিস’ বা ‘সুস্থ মাটি, সুস্থ শহর’, যা আমাদের সামনে এনে দিয়েছে নগরসভ্যতার স্থিতিশীলতা এবং মানবসম্পর্কিত সুস্থতার জন্য মাটির অনির্ধার্য ভূমিকার উপর গভীর ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার আহ্বান।

আধুনিক শহরের উন্নয়ন ও প্রযুক্তির অগ্রগতি যতই হোক না কেন, মানব সভ্যতার জন্য খাদ্য, পানি, অবকাঠামো, বসতি এবং শহুরে জীবনের মেরুকেন্দ্রিক অবকাঠামোর ভিত্তি হলো মাটি। কিন্তু আজকের নগরায়নে কংক্রিট, অ্যাসফল্ট, প্লাস্টিক, রাসায়নিক বর্জ্য, শিল্পবর্জ্য এবং ভারী ধাতুর স্তরগুলো মাটিকে প্রায় শ্বাসরোধ করেছে। ফলে পানি শোষণের ক্ষমতা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে, শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ‘হিট আইল্যান্ড’ প্রভাব তীব্র হচ্ছে, বৃষ্টির সময় জলাবদ্ধতা বেড়েছে এবং মাটির নিচের অণুজীব, কেঁচো, ছত্রাক, কীটপতঙ্গসহ অদৃশ্য জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছে। এক টেবিলচামচ সুস্থ মাটিতে যে ক্ষুদ্র প্রাণী, জীবাণু এবং অণুজীব রয়েছে, তাদের সংখ্যা প্রায় সমান পৃথিবীর জনসংখ্যার চেয়ে, যা পুষ্টিচক্র, পানি পরিশোধন, কার্বন সংরক্ষণ, উদ্ভিদের রোগপ্রতিরোধ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে; কিন্তু নগরায়নের চাপের ফলে সেই জীববৈচিত্র্য দ্রুত বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যার কারণে শহরের খাদ্য নিরাপত্তা, বায়ু মান, জলাশয় ব্যবস্থাপনা, উদ্ভিদ স্বাস্থ্য এবং মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

২০১৪ সালে এফএও আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ঘোষণা করার পর ‘স্টপ সয়েল এরোসিওয়ন’, ‘কিপ সয়েল এলাইভ’, ‘সয়েল অ্যান্ড ওয়াটার: অ্যা সোর্স অব লাইফ’ এবং ‘সয়েল পলিউশন-অ্যা হিডন রিয়েলিটি’ এর মতো প্রতিপাদ্য একের পর এক মানবসভ্যতাকে সতর্ক করেছে, যা মাটির গুরুত্ব, তার রক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং ক্ষয় রোধের বিভিন্ন উপায়কে বৈশ্বিক আলোচ্য বিষয় হিসেবে তুলে ধরেছে। তবে শহুরে মাটি এতদিন তুলনামূলকভাবে অবহেলিত ছিল। অথচ আজ বিশ্বের ৫৫ শতাংশ মানুষ শহরে বসবাস করছে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে শহরের মাটি শুধু নগর বাস্তুসংস্থান ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনার নয়, বরং নগর নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য, জলবায়ু ঝুঁকি, খাদ্য প্রবাহ এবং শহরের পরিবেশগত ভারসাম্যের নিয়ামক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। রাস্তা, ফুটপাত, বহুতল ভবন, গ্যারেজ, পার্কিং লট, শপিংমল এসব নির্মাণের নিচে মাটি সিল হয়ে গেলে বৃষ্টির পানি নিচে প্রবেশ করতে পারে না, ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত হ্রাস পায়, ড্রেনেজ ব্যবস্থার ব্যর্থতা ঘটে, এবং অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।

একই সময়ে, শিল্পবর্জ্য থেকে নিঃসৃত সীসা, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, পারদ, মাইক্রোপ্লাস্টিক, টায়ারের রাবার, স্যুয়ারেজ-বর্জ্য এবং নির্মাণ-ধ্বংসাবশেষ মাটির সঙ্গে মিশে তা বিষাক্ত করে, যা শহরের শিশুদের স্বাস্থ্য, বায়ু মান, স্থানীয় উদ্ভিদ, ফলমূল এবং প্রাণীজগতের ওপর প্রভাব ফেলে। নগর মাটির এই অবক্ষয়কে আজ ‘আরবান সয়েল ক্রাইসিস’ বলা হয় একটি নীরব কিন্তু দ্রুত বিস্তারমান বৈশ্বিক সংকট যা খাদ্য উৎপাদন, পানির নিরাপত্তা, জলবায়ু প্রশমন, নাগরিক স্বাস্থ্য এবং শহরের বাসযোগ্যতা সরাসরি প্রভাবিত করছে।

তবুও আশার আলো নেই নয়। বিশ্বব্যাপী শহরগুলোতে এখন ‘নেচার-বেজড সলিউশনস’ বা প্রাকৃতিক সমাধান ব্যবহার করে মাটির স্বাস্থ্য পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। রেইন গার্ডেন, বায়ো-সোয়েল, সবুজ ছাদ, উল্লম্ব উদ্যান, নগর বন, নীল-সবুজ করিডোর এবং কমিউনিটি গার্ডেন এসব পদক্ষেপ শহরের মাটিকে পুনরুজ্জীবিত করছে, পানি শোষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে, বন্যা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করছে, শহরের তাপমাত্রা কমাচ্ছে, কার্বন সংরক্ষণ বাড়াচ্ছে এবং শহুরে জীববৈচিত্র্যকে রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুযায়ী, মাটিতে মাত্র ১ শতাংশ জৈব পদার্থ বৃদ্ধি করলেই তার পানি ধারণ ক্ষমতা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়, যা নগরায়নের ফলে বাড়তে থাকা বন্যা ও খরার ঝুঁকি, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং কার্বন শোষণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কম্পোস্টিং, বর্জ্য পৃথকীকরণ, ই-ওয়েস্ট রিসাইক্লিং এবং শিল্পবর্জ্য নিয়ন্ত্রণের মতো কার্যক্রম শহরের মাটিকে সুস্থ রাখার কার্যকর উপায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। নগর ছাদকৃষি বিশ্বব্যাপী এক বিপ্লবী উদ্যোগ হিসেবে পরিচিত হচ্ছে নিউইয়র্ক, সিঙ্গাপুর, টোকিও, মিলান, সিউলসহ বহু শহরে ছাদকৃষি শুধু ফল সবজি উৎপাদন করছে না, বরং শহরের তাপপ্রবাহ হ্রাস, বায়ুদূষণ কমানো, মাটির কার্বন সংরক্ষণ বৃদ্ধি এবং স্থানীয় পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

২০২৫ সালের বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের উপলক্ষে এফএও আয়োজন করছে ‘আরবান সয়েল হেলথ মনিটরিং ফ্রেমওয়ার্ক’, ‘সয়েল ইন ১ মিনিট’ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা, শিশুদের জন্য ‘টাইনি সয়েল ডিটেকটিভস’, বৈশ্বিক ওয়েবিনার, নীতিনির্ধারণী আলোচনা এবং বিভিন্ন গবেষণা কর্মসূচি। এর মাধ্যমে শহরের মাটিকে বৈজ্ঞানিক, নীতিগত এবং সামাজিক আলোচনার মূলধারায় আনা হচ্ছে, যেখানে বিজ্ঞানী, শহর পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবিদ, প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ এবং নাগরিক সমাজ একসঙ্গে অংশগ্রহণ করছে। শহুরে মাটি শুধু গাছ লাগানোর মাধ্যম নয়; এটি শহরের জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, পানি ব্যবস্থাপনা, কার্বন সংরক্ষণ, খাদ্য উৎপাদন, মানসিক স্বাস্থ্য, শিশুদের খেলার পরিবেশ, নগর জীববৈচিত্র্য এবং নগরের বাসযোগ্যতার মূল ভিত্তি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটও অত্যন্ত চ্যালেঞ্জপূর্ণ। ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, খুলনা, সব বড় শহর দ্রুত কংক্রিট নগরীতে পরিণত হচ্ছে। কৃষিজমি, জলাধার, খাল এবং সবুজ এলাকা হারিয়ে যাচ্ছে, প্লাস্টিক, রাসায়নিক বর্জ্য এবং শিল্পকারখানার ভারী ধাতু মাটিকে বিষাক্ত করছে। নদী ভরাট, খাল দখল এবং জলাধার বিলুপ্তি মাটির জলধারণ ক্ষমতা হ্রাস করছে, ফলে অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা ও বন্যা সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকার মাটিতে সীসা, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়ামের পরিমাণ অনেক এলাকায় ডব্লিউএইচও সীমা ছাড়িয়েছে, যা শিশুদের স্নায়ুবিক সমস্যা, কিডনি ক্ষতি এবং খাদ্যদূষণের ঝুঁকি তৈরি করছে। তবে আশার দিক রয়েছে ছাদকৃষির বিস্তার, কম্পোস্টিং উদ্যোগ, নগর বনায়ন, সবুজ করিডোর পরিকল্পনা, এসআরডিআই এর মাটি পরীক্ষা ও ভারী ধাতু ম্যাপিং, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাটি মানচিত্রায়ন মিলিয়ে শহরের মাটি পুনরুদ্ধারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

অতএব, বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২৫ এর মূল বার্তা স্পষ্ট: ‘সুস্থ শহর চাইলে আগে সুস্থ মাটি চাই’। শহরের পরিকল্পনা, নগর উন্নয়ন, পরিবেশনীতি, শিল্প ব্যবস্থাপনা, নাগরিক সংস্কৃতি সবকিছুর কেন্দ্রে মাটিকে রাখতে হবে। মাটি বাঁচানো মানে শুধু উদ্ভিদ রক্ষা নয়, বরং জলাবদ্ধতা কমানো, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বায়ুদূষণ কমানো, খাদ্যব্যবস্থা শক্তিশালী করা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য শহর তৈরি করা। এই কাজ রাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ, শিল্পখাত এবং প্রতিটি মানুষকে একত্রিতভাবে করতে হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে নীরব এবং অমূল্য সম্পদ মাটি আমাদের প্রতিদিন বাঁচিয়ে রাখে; এবার সময় এসেছে আমরা তাকে বাঁচানোর, তার মূল্য বোঝার এবং আমাদের শহর ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুস্থ নগরায়ন নিশ্চিত করার।

আরও পড়ুন
অনলাইন জুয়া সময়ের নীরব ঘাতক
পাঁচ শতাব্দীর ভূকম্পনের ইতিহাস

লেখক: মৃত্তিকা বিজ্ঞানী, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, কৃষি মন্ত্রণালয়

কেএসকে/এমএস

আরও পড়ুন