১৫৪৮ থেকে ২০২৫

পাঁচ শতাব্দীর ভূকম্পনের ইতিহাস

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:৫০ পিএম, ২৩ নভেম্বর ২০২৫
ফাইল ছবি

শাহারিয়া নয়ন

দেশে ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প—শুক্রবারের কম্পনে যে শক্তি মুক্ত হয়েছে, তা মনে হচ্ছিলো প্রায় হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত বোমার শক্তির সমান। ভোরের মতো শান্ত একটি সকাল। কেউ বাইরে যেতে প্রস্তুত, কেউ নাস্তা বানাচ্ছেন, আবার কোথাও শিশুরা খেলছে ঘরের উঠানে। হঠাৎ—মাত্র কয়েক সেকেন্ডের এক ঝাঁকুনিতে থমকে গেল মানুষের স্বাভাবিক জীবন। ছিটকে পড়ল জানালার কাচ, কেঁপে উঠলো বহুতল ভবন, আতঙ্কে মানুষ দৌড়ে নেমে এলো রাস্তায়। আর সেই কয়েক সেকেন্ডই কেড়ে নিলো দুই শিশুসহ দশটি প্রাণ। আহত হলো ছয় শতাধিক মানুষ। এই ভূমিকম্প আবারও স্মরণ করিয়ে দিলো—বাংলাদেশ এখনো দাঁড়িয়ে আছে এক ভয়ংকর ভূকম্পনীয় ঝুঁকির ওপর।

নরসিংদীর মাধবদীতে শক্তিশালী ভূমিকম্পের ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই আবারও কম্পন অনুভূত হয়েছে গাজীপুরের বাইপাইলে। শনিবার সকাল ১০টা ৩৬ মিনিট ১২ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৩ মাত্রার এই ক্ষুদ্র ভূমিকম্পটি রেকর্ড করে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র।

এর ঠিক আগের দিন, শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনুভূত হলো শক্তিশালী ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস জানিয়েছে, ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদী এলাকায়। কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী এই কম্পনে দেশের তিন জেলায় ছয় শতাধিক মানুষ আহত হন এবং প্রাণ হারান দুই শিশুসহ অন্তত ১০ জন।

পুরান ঢাকার কসাইটুলীতে ভূমিকম্পের সময় একটি ভবনের ছাদের রেলিং ভেঙে রাস্তায় হাঁটতে থাকা তিনজন চাপা পড়ে মারা যান। নিহতরা হলেন—স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী রাফিউল ইসলাম, আব্দুর রহিম এবং তাঁর ১২ বছর বয়সী ছেলে আব্দুল আজিজ রিমন। রূপগঞ্জে দেওয়াল ধসে প্রাণ হারায় ১০ মাস বয়সী শিশু, ফাতেমা।

এ ছাড়া নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার আজকীতলা পূর্বপাড়া গ্রামের ফোরকান মিয়া (৪৫) ভূমিকম্পের সময় গাছ থেকে পড়ে গুরুতর আহত হন। হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ডাঙ্গা ইউনিয়নের ইসলামপাড়া নয়াপাড়ার বাসিন্দা নাসিরউদ্দিন (৬৫) ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে স্ট্রোক করেন। পরে তার মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন।

মুগদার মদিনাবাগে ভূমিকম্পে নির্মীয়মান ভবনের রেলিং ধসে মাথায় পড়ে মাকসুদ (৫০) নামের এক নিরাপত্তাকর্মীর মৃত্যু হয়। নরসিংদীর পলাশে মাটির ঘরের দেওয়ালচাপায় প্রাণ হারান ৭৫ বছর বয়সী কাজম আলী ভূঁইয়া। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা গুরুতর। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ জন, নরসিংদীতে অন্তত ৪৫ জন এবং গাজীপুরে তিন শতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছেন আতঙ্কে দৌড়ে নামার সময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ভবন থেকে লাফ দিয়ে আহত হয়েছেন অন্তত চার শিক্ষার্থী। সব মিলিয়ে তিন জেলায় দুই শতাধিক মানুষ বিভিন্ন মাত্রায় আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

আরও পড়ুন
উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকার ভবনগুলো তীব্র ঝুঁকিতে 
বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ৭ পেশা 

বাংলাদেশের ভূমিকম্পের ইতিহাস বলছে, এ ভূখণ্ড বহুবার বড় বড় ভূমিকম্পের আঘাত মোকাবিলা করেছে। এই অঞ্চলে প্রথম বড় ভূমিকম্প হয়েছিল ১৫৪৮ সালে, যখন চট্টগ্রাম-সিলেট অঞ্চলে মাটি ফেটে কাদা–পানি বেরিয়ে এসেছিল। এরপর ১৬৪২ সালের ভূমিকম্পেও সিলেটে বহু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রাণহানির তথ্য পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বিধ্বংসী ভূমিকম্পটি ঘটে ১৭৬২ সালে। চট্টগ্রামের বিশাল এলাকা ভূপৃষ্ঠের আলোড়নে তছনছ হয়ে যায়। মাটি ফেটে বের হতে থাকে কাদা-পানি, নদী শুকিয়ে পড়ে, পুরো গ্রাম দেবে যায় পানির নিচে। ‘বাকর চনক’ নামের এক অঞ্চলে প্রায় ২০০ মানুষ তাদের গৃহপালিত প্রাণীসহ সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যায় বলে উল্লেখ আছে তৎকালীন বিবরণে। ঢাকায়ও সেই কম্পনের তীব্রতা ছিল প্রবল। নদী-ঝিলের পানি অস্বাভাবিকভাবে ফুলে উঠেছিল, পানি নেমে গেলে অসংখ্য মৃত মাছ কূলে ভেসে থাকতে দেখা যায়। অসংখ্য বাড়ি-ঘর ধসে পড়ে, প্রাণ হারায় প্রায় পাঁচশ মানুষ।

১৭৭৫ ও ১৮১২ সালের ভূমিকম্পেও ঢাকার অনেক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যদিও হতাহতের উল্লেখ নেই। ১৮৬৫ সালের ভূমিকম্পে সীতাকুণ্ডের একটি পাহাড় ফেটে কাদা-বালি বেরিয়ে আসে, তবে বড় ক্ষতি হয়নি। ১৮৮৫ সালে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া এলাকায় আঘাত হানে প্রায় ৭ মাত্রার ‘বেঙ্গল আর্থকোয়েক’। ঢাকাসহ একাধিক জেলার স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রাণহানি সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি। এর মাত্র বারো বছর পর, ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ঘটে ইতিহাসের ভয়াবহ ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’। ধারণা করা হয় এর মাত্রা ছিল প্রায় ৮। সিলেটে অন্তত ৫৪৫ জন মানুষ মারা যায়। পাবনা, সিরাজগঞ্জ, ঢাকাসহ বহু অঞ্চলের সরকারি স্থাপনা ধ্বংস হয়, রেল-সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শুধু আর্থিক ক্ষতিই ছাড়িয়ে যায় ৫০ লাখ টাকার মতো, যা তখনকার সময়ে ছিল বিরাট অঙ্ক।

১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্পে ধ্বংস হয় বহু স্থাপনা। ১৯৫০ সালের আসাম ভূমিকম্প বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় অনুভূত হলেও উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়নি। ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রামের ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে শহরের বহু ভবনে ফাটল ধরে। আর ১৯৯৯ সালে মহেশখালীর ৫ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্পে দ্বীপের বেশ কিছু ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সবশেষ শুক্রবারের ভূমিকম্প আবারও স্মরণ করিয়ে দিলো, বাংলাদেশ এখনো ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ একটি অঞ্চল। রাজধানী ঢাকার ঘনবসতি, দুর্বল ভবন কাঠামো এবং পরিকল্পনাহীন নগরায়ন অতিরিক্ত ঝুঁকি তৈরি করেছে। কয়েক সেকেন্ডের একটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেই তিন জেলায় দুই শতাধিক মানুষ আহত এবং ছয়জনের প্রাণহানি দেশের ভূমিকম্প প্রস্তুতি কতটা দুর্বল—তারই একটি নিদর্শন।

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা এবং গণমাধ্যম বিভাগ, সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।