ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

খেজুর গুড়ে হাইড্রোজ: স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি

ফিচার ডেস্ক | প্রকাশিত: ০২:৩০ পিএম, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫

মো. বিল্লাল হোসেন
ফেসবুকে স্ক্রল করলেই একটু পর পর চোখে পড়ছে, ভেজাল খেজুর গুড় ধ্বংস করার ভিডিও অথবা নিউজ। যেহেতু এখন খেজুর গুড়ের সময় তাই স্বভাবতই এটি নিয়ে অনেক বেশি কথা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জেলা বিশেষ করে যেসব জেলায় সবচেয়ে বেশি খেজুরের গুড় উৎপাদিত হয় (যেমন রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, যশোর, নাটোর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও নড়াইল‌ ইত্যাদি) সেসব জেলাতে ভ্রাম্যমান আদালত এর মাধ্যমে ভেজাল গুড় ধ্বংস করা হচ্ছে যা প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক সহ অন্যান্য মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে। এসব ভেজাল গুড় তৈরি করা হচ্ছে কাপড়ে ব্যবহৃত রং, আটা, হাইড্রোজ, গ্যাস পাউডার, চুন ও চিনি ইত্যাদি ব্যবহার করে। অর্থাৎ এসব ভেজাল গুড়ে খেজুর রসের ন্যূনতম অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই। সুতরাং এটি খুব সহজে অনুমেয় যে এই খেজুরের গুড় আমাদের শরীরের জন্য কতটা ক্ষতিকর।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনলাইন ব্যবসার প্রচার ও প্রসার তুমূল গতিতে বেড়ে যাওয়ার কারণে ফেসবুক ও ইউটিউবে প্রচুর পরিমাণে খেজুর গুড় বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখা যায়। ফেসবুক খুললে দেখা যায় হাজার হাজার পেজ যেখানে অবলীলায় দাবি করা হচ্ছে ‘আমাদের গুড় শতভাগ খাঁটি ও বিশুদ্ধ। আপনি নিশ্চিন্তে নিতে পারেন’। অথচ বাস্তবতা বলছে আমাদের দেশে যে পরিমাণ খেজুর গাছ আছে তার চেয়ে অনেক বেশি খেজুর গুড় অনলাইনে বিক্রি হয়।

যদিও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও অন্যান্য সংস্থা বাংলাদেশে মোট খেজুর গাছের পরিমাণ ও সেখান থেকে উৎপাদিত খেজুর গুড়ের পরিমাণ সম্পর্কে সঠিক তথ্য সরবরাহ করতে পারছে না তাই মোট কি পরিমান গুড় দেশে উৎপাদিত হয় সেটি বলা বেশ মুশকিল। যদিও বিভিন্ন জেলাভেদে সংশ্লিষ্ট জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আনুমানিক তথ্য প্রকাশ করে থাকে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তবে যে তথ্য পাওয়া গেছে সে অনুযায়ী গুড়ের উৎপাদন বাজারে যে পরিমাণ গুড় বিক্রি হয় তার তুলনায় অবশ্যই অনেক কমতা।

এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণ ও অতিরিক্ত গাছ কেটে ফেলার ফলে খেজুর রসের উৎপাদন তুলনামূলকভাবে কমেছে ফলে এত বেশি গুড় উৎপাদন করা এবং তা অনলাইনে বিক্রি করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এজন্য সবার মাথায় একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এত গুড় কীভাবে বাজারে এলো? আসলে বাজারের বেশিরভাগ গুড়ই ভেজাল‌ গুড়। এসব গুড় এত বেশি ক্ষতিকারক কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি যে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।

ভেজাল গুড় ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি
ভেজাল গুড়ে অনেকগুলো উপাদান ব্যবহার করা হয় তবে পরিষ্কারক দ্রব্য হিসেবে যে রাসায়নিক যৌগটি ব্যবহার করা হয় তা খোলা বাজারে হাইড্রোজ নামে পরিচিত। এর রাসায়নিক নাম সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইট বা সোডিয়াম ডাইথায়োনাইট। এর রাসায়নিক সংকেত Na2S2O4 । এটি এক ধরনের সালফার বিশিষ্ট অজৈব যৌগ যা সাদা দানাদার পাউডার হিসেবে বিক্রি হয়। এটি কাপড়ের ডাই (সালফার ডাই ও ভ্যাট ডাই) হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া এটি চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য পরিষ্কার করতে, পানি ও গ্যাস পরিষ্কার করতে, বিভিন্ন ধরনের পলিমার প্রস্তুতিতে ও ফটোগ্রাফিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সুতরাং এটি স্পষ্টভাবে প্রতিয়মান হয় যে হাইড্রোজ কোনভাবেই খাদ্যদ্রব্যে মিশ্রণের জন্য নয়। এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।

২০১৪ সালের ৬ অক্টোবর বিশ্বখ্যাত পাবলিশার এলসেভিয়ার এর এশিয়ান প্যাসিফিক জার্নাল অব ট্রপিকাল বায়োমেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত ইঁদুরের উপর পরিচালিত একটি গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে হাইড্রোজ যুক্ত খাবার গ্রহণের ফলে ইঁদুরের দেহে ক্রিয়েটিনিন ও ইউরিয়ার পরিমাণ মারাত্মকভাবে বেড়ে যায় অন্যদিকে দেহে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমে যায়। এছাড়া হাইড্রোজ যুক্ত খাবার গ্রহণের ফলে কিডনির গ্লোমেরুলিতে ইনফ্লামেশন হয় হলে কিডনি নষ্ট হওয়ার মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হয়। তাই এটা খুব সহজে বলা যায় যে হাইড্রোজ যুক্ত এসব ভেজাল গুড় মানব শরীরের জন্য ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ বিপদ। উল্লেখ্য যে গুড় দিয়ে এই গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়েছে সেই স্যাম্পলগুলো রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং গবেষণাটি পরিচালনা করেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজের একদল গবেষক।

অন্যদিকে এসব ভেজাল খেজুর গুড়ে ব্যবহৃত কাপড়ের রং মানব শরীরে ক্যানসারের ঝুঁকি তৈরি করে, চোখের ক্ষতি করতে পারে কিংবা লিভার, কিডনি এ ধরনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হানি হতে পারে। তাছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব রং মানব শরীরে মিউটেশন ঘটাতে পারে।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে সহজেই অনুমেয় যে বর্তমান সময়ে খেজুর গুড় কিনলেই হবে না, সেটি কিনতে হবে সচেতন ভাবে যাচাই-বাছাই করে। অনলাইনে কারো মুখের কথায় বিশ্বাস না করে অবশ্যই অফলাইনে খোঁজখবর নিয়ে তারপর খেজুর গুড় কিনতে হবে তাহলেই বাঁচা যাবে এই ভেজাল খেজুর গুড় খাওয়ার স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে। তাই আসুন আমরা সকলে সচেতন হই, বিশুদ্ধ খেজুর গুড় খাই, সুস্থ জীবন যাপন করি।

আরও পড়ুন
অনলাইন জুয়া সময়ের নীরব ঘাতক
সুস্থ মাটি, সুস্থ শহর: বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের বার্তা

লেখক: প্রভাষক, খাদ্য প্রকৌশল ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

কেএসকে/জেআইএম

আরও পড়ুন