যেখানে রাত কাটে খাজার প্রেমে
খাজার শানে মগ্ন ভক্তরা। ছবি : রবিউল ইসলাম পলাশ
শীত বেলায় মহল্লার মোড়ে মোড়ে আলোর ঝলকানি রূপের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত রাজধানীবাসী। লালসালুতে মোড়ানো বিশাল আকৃতির ডেক। ডেকের ওপর টঙসদৃশ ছোট আকৃতির ঘরও বানানো হয় কোথাও কোথাও। যেটি মাজারের রূপও ধারণ করে। পুরো ডেক-ই ঝাড়বাতিতে সাজানো থাকে। ক্যাসেট বা মাইকে বাজানো হয় খাজার শান। খাজাভক্ত মানুষেরা সাধ্যমতো দান করেন ডেকে। তাই নিয়ে চলে খাজার নামে ওরস মোবারকের আয়োজন।
হাজার মাইল দূরে ভারতের আজমিরে শায়িত আছেন পীরে কূলের শিরোমণি হজরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)। তাতে কী? ভক্তের ভক্তি-ভালোবাসায় প্রতি মুহূর্তে সিক্ত হন খাজা।
এমনই এক খাজাপ্রেমের মেলা বসেছিল রোববার কাজীপাড়ায়। কাজীপাড়ার জামতলা বউবাজারে খাজা গরিবে নেওয়াজ মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) স্মরণে পবিত্র ওরস মোবারকের আয়োজন করেন স্থানীয় বাসিন্দা কিরণ। ১২ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের একটি ইউনিটের সভাপতি কিরণ। খাজার প্রেমে মন মজিয়ে দেওয়ানা হয়েছেন বাউল গানেও।
বক্তব্য রাখছেন আয়োজক কিরণ
তরুণ বয়স থেকেই বাউলে আসক্তি কিরণের। বাউল গানের আসরে জীবনের প্রায় চল্লিশ বছর কাটিয়েছেন। দেশের বিখ্যাত বাউল শিল্পী-সাধকরা এক নামেই চেনেন কিরণকে। বাউল শিল্পীদের গান শুনে কিরণের বকশিশ দেয়ারও জুড়ি মেলে না। শিল্পী-সাধকদের কাছে কিরণ যেন আপনের চেয়েও আপন।
রোববার খাজা স্মরণে আয়োজনে কোনোই কমতি ছিল না কিরণের। সহস্র মানুষের জন্য বিরিয়ানি রান্না। বিশাল মঞ্চ। হাজার মানুষের বসার প্যান্ডেল। ডজন খানিক বাউল শিল্পীর মনকাড়া গান। গানে গানে খাজাপ্রেমে পাগলপাড়া ভক্তরা যেন উম্মাদ বনে যান।
গভীর রাতে মঞ্চে ওঠেন আড়ং ডেইরি চ্যানেল আই বাংলার গানের চ্যাম্পিয়ন শারমিন। সঙ্গে ছিলেন মমতাময়ী সুরের অধিকারী আরেক তরুণ বাউলশিল্পী বিথী আযম। শারমিন-বিথীর বাউলিয়ানায় যেন কাজীপাড়ার আকাশ কেঁপে ওঠে। বাউলভক্তরা প্রাণ খুলে মেলে ধরেন খাজার প্রেমানন্দ। রাত যতই গভীর হয়, সে প্রেম ক্ষুধা ততোই তীব্র হয়।
গাইছে আড়ং ডেইরি-চ্যানেল আই বাংলার গানের চ্যাম্পিয়ন শারমিন
কথা হয় ওরসের আয়োজক কিরণের সঙ্গে। বলেন, গত কয়েক দশক ধরেই প্রতি বছর খাজার নামে ওরস করি। বাবায় বেঁচে থাকতে তিনিই আয়োজন করতেন। এখন আমি করি। সবার ভালোবাসা নিয়েই এমন মহতি আয়োজনের সুযোগ মেলে। খাজার প্রতি প্রেমতো আর শেষ হওয়ার নয়। খাজা বাবার সঙ্গে প্রেমের গাঁথুনি দিয়ে আল্লাহ-রাসূলের দিদার লাভ করতেই এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
কিরণের বন্ধু বাবুর মোল্লা বলেন, খাজার শান শুনলে প্রাণ খোলে। সারারাত গান শুনেও মন ভরে না। বাউল গান শুনেই রাত কাটে। এমন আসরে বসলে রাত কীভাবে কেটে যায়, তা বোঝার উপায় থাকে না।
উল্লেখ্য, ৫৩৭ হিজরিতে ইরানের খোরাসানের সঞ্জর গ্রামে ১৪ রজব জন্মগ্রহণ করেন হজরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)। তিনি ওলিকূল শিরোমণি হজরত আব্দুল কাদের জিলানীর (রহ.) ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন। অল্প বয়সে খাজা গরিবে নেওয়াজ তার মা-বাবাকে হারান। ছোটবেলা থেকেই তিনি আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য কঠোর সাধনায় মগ্ন থাকতেন। তিনি আল্লাহর সাধনা এবং দুস্থদের সেবার মধ্যে সংসারের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করতেন।
মনকাড়া সুরে মঞ্চ মাতান তরুণ বাউল শিল্পী বিথি আজম
কথিত আছে মদিনা শরিফে নবীজী তাকে স্বপ্নযোগে হুকুম করেন, ভারতের আজমির নামক স্থানে ইসলাম ধর্ম প্রচার করার জন্য। মহানবী (সা.) তাকে স্বপ্নযোগে আজমিরের পরিচয় দেন। তারপর তিনি আজমিরের উদ্দেশে রওনা হন। এই মহান বুজুর্গ ব্যক্তি তার দীর্ঘ জীবনে আধ্যাত্মিক সাধনা শেষে ৯৭ বছর বয়সে ৬৩২ হিজরিতে ৬ রজব ওফাত প্রাপ্ত হন। ভারতের আজমিরে পবিত্র মাজার শরিফ অবস্থিত। তার পবিত্র মাজার শরিফে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ ভক্ত জেয়ারতের উদ্দেশ্যে আসেন। আমাদের বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার ভক্ত জেয়ারতের জন্য খাজা বাবার দরবারে যান। ৬ রজব আমাদের বাংলাদেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় খাজা বাবার ভক্তরা তার ওফাত দিবস পালন করেন।
এএসএস/এসএইচএস/আরআইপি