ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ফিচার

বিজয় দিবস

মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট (অব.) এমএ ওয়াদুদ ও অপারেশন গোয়ালমারি

আনিসুল ইসলাম নাঈম | প্রকাশিত: ১২:১১ পিএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫

আমার গন্তব্য একজন মুক্তিযোদ্ধার অসামান্য অবদান জানার সন্ধানে। চাঁদপুর জেলা স্টেডিয়ামের পাশে কয়েকটি বিল্ডিং পার হয়েই তার বাসা। লিফট দিয়ে উঠতেই দরজার সামনে তার নামফলক দেখতে পেলাম। নামফলক দেখে বুঝতে অসুবিধা হয়নি, এটা তারই বাসা। দরজায় টোকা বা কলিংবেল দিতে হয়নি। কারণ ভেতর থেকে শক্ত কোনো লক পাইনি। ভেতরে প্রবেশ করে ড্রয়িং রুমে কারো দেখা পেলাম না। তারপর সরাসরি চলে গেলাম তার বেড রুমে। আধশোয়া অবস্থায় তাকে বিছানার উপর আবিষ্কার করলাম।

৮২ বছরের একজন বৃদ্ধ। চেহারায় স্পষ্ট বয়সের ছাপ। আমাকে দেখে কম্বল সরিয়ে উঠতে উঠতে মিনিট তিনেক সময় নিলেন। আমি একজন কিংবদন্তির সামনে। তিনি যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফট্যানেন্ট (অব.) এমএ ওয়াদুদ। প্রথমেই জানতে চাইলাম শরীর কেমন এখন? একবুক হতাশা ও দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, ‘বেশি একটা ভালো যাচ্ছে না।’ বুঝতে বাকি রইলো না, বয়স হয়েছে। স্মরণ শক্তিতেও ভাটা পরেছে। বছর ছয়েক আগে হারিয়েছেন প্রিয়তমা স্ত্রীকে। তারপর থেকে খুব একা হয়ে গেছেন। এখন জীবনের শেষ সময় পার করছেন।

warমুক্তিযুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন সময়ে পাওয়া সম্মাননা স্মারক ও ক্রেস্ট

তার জন্ম ও বেড়ে উঠা চাঁদপুরের মতলব উপজেলার ইসলামাবাদ ইউনিয়নের সুজাতপুর গ্রামে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় সদস্য ছিলেন। পড়াশোনা করেন নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজে। এই কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বাবু সরওয়ার-ওয়াদুদ প্যানেলে ১৯৬৬ সালে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে নির্বাচিত হন। তিনি বলেন, ‘সেসময় মেধার ভিত্তিতে নেতা নির্বাচিত হতো। কিন্তু বর্তমানে এর উল্টো চিত্র দেখা যায়। সেসময় ছয় দফা আন্দোলন নিয়ে সারাদেশ উত্তাল সময় পার করছে। আমরাও সবার সঙ্গে আন্দোলনে নেমে পড়ি। কলেজের জিএস হওয়াতে মিছিলের সামনের সারিতে থাকতাম। মিছিলের এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে আমাদের তুমুল সংঘর্ষ বাঁধে। এতে দুজন পুলিশ নিহত ও বেশ কিছু মানুষ হতাহত হন। সেই ঘটনায় মামলা হয়। সেই মামলার মধ্যে পড়ে গেলাম। তখন পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। এক পর্যায়ে করাচি বোর্ড থেকে সেকেন্ড ডিভিশন নিয়ে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করি।’

তিনি ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগদান করেন। এরপর ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। পাকিস্তান শাসক আইয়ুব খানের সঙ্গে পরিচয়ের কথা স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমাদের সেনাবাহিনীর ট্রেনিং হয় পাকিস্তানের কাকুল এলাকায়। একদিন ট্রেনিং স্টেশন কমান্ডার আমাকে তার অফিসে ডাকেন। তিনি আমাকে তিনদিন ছুটি দিয়ে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি যাওয়ার কথা বলেন। আমার এক মামা, তিনি ছিলেন পাকিস্তানের স্পিকার। তিনিই আমাকে আমন্ত্রণ করেন। আমি তখন নব্য ক্যাডেট। ইউনিফর্ম পড়ে সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে চলে যাই। ইউনিফর্ম বদলে স্পিকার মামার সঙ্গে নাস্তা করলাম। এরপর পার্লামেন্টে চলে গেলাম। সেখানে স্পিকারের জন্য ভিআইপি লাউঞ্জ রয়েছে। লাউঞ্জের পাশেই বসলাম। চা বিরতির সময় মামা আইয়ুব খানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি আর্মির চাকরিতে জেনে আইয়ুব খান খুশিতে করমর্দন করেন। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপচারিতা হয়। যাওয়ার সময় আইয়ুব খান আমাকে ‘মামা’ ডাকার জন্য বলে দেন।’

পাকিস্তান থেকে অস্ত্রভর্তি লাগেজ নিয়ে পলায়ন
১৯৬৯ সালে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ শেষ হয়। সেখানে যুদ্ধের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিতে হয়। ১৯৭০ সালের প্রথমদিকে প্রশিক্ষণের পর কমিশন লাভ করে র‍্যাঙ্ক পেলাম। এরপর পোস্টিং হলো করাচির হায়দ্রাবাদ ক্যান্টনমেন্টের মালী নামক জায়গায়। এটি গহীন পাহাড় জঙ্গলে অবস্থিত। আমি, লেফটেন্যান্ট দিদারুল আলম এবং লেফটেন্যান্ট মাহাবুব একসঙ্গে ছিলাম। আমরা তিনজন খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। সেখানে কয়েকমাস এয়ারট্রুপ ট্রেনিং চলছিল। ম্যাপ দেখে ট্রেনিং করতে হতো। সেই প্রশিক্ষণটা মুক্তিযুদ্ধের সময় কাজে দিয়েছে। প্রশিক্ষণে থাকাকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্ক দিনদিন অবনতির গুঞ্জন শুনতাম।

war২০০৯ সালে (৩৬তম) মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির জেনারেল জে আর এফ জ্যাকবের কাছ থেকে সম্মাননা ও ক্রেস্ট গ্রহনের ছবি দেখাচ্ছেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট (অব.) এমএ ওয়াদুদ

১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময় পূর্ব পাকিস্তানের বিজয় হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত হোন। কয়েকদিন বাদেই ১৯৭০ সালের নির্বাচন। ক্যান্টনমেন্টে একদিন আফজাল পাঠান নামে এক মুচির সঙ্গে কথা হয়। তখন সে আমার ব্যক্তিগত কিছু বিষয় জানতে চায়। সেখানে তার কথায় কিছু অসংগতি লক্ষ্য করি। তখন থেকে মনের মধ্যে সন্দেহ চলে আসে। আমি বন্ধু দিদারুল ও মাহবুবকে বিষয়টি অবহিত করি। তাদের নিয়ে ডিনারের পর নিরিবিলি জায়গায় বসে আলাপ করি। ঠিক সেসময় আরেক জায়গা থেকে একটি মেসেজ পাই ‘টেক ইউর সেফটি ফাস্ট।’ তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম তিনজন ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে দেশে চলে আসব। তখন তিনটি চায়নিজ স্টেন গান, ৩টি বিশ রাউন্ডের পিস্তল এবং ১৮টি ম্যাগাজিন একটি ব্যাগে নিলাম। কিন্তু অস্ত্রভর্তি লাগেজ নিয়ে ইমিগ্রেশন পার করে বিমানে উঠব কীভাবে? তখন আমার এক আত্মীয় (সম্পর্কে খালু) ছিলেন করাচী এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন অফিসার। তার সহযোগিতায় ইমিগ্রেশন পার হয়ে লাগেজ বিমানে তুলি। এরপর আমরা ঢাকার তৎকালীন তেজগাঁও বিমানবন্দরে নামি। আগেই বড় ভাইয়ের মাধ্যমে একটা পিক-আপ গাড়ি ব্যবস্থা করে রাখি। গাড়িতে অস্ত্রভর্তি লাগেজ নিয়ে সোজা নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ ঘাটে চলে আসি। ঘাট থেকে লঞ্চের মাধ্যমে আমাদের এলাকায় চলে আসি। তখন আমরা তিনজন ইউনিফর্ম পড়া অবস্থায় ছিলাম। আমাদের দেখে গ্রামের মধ্যে একটা হইচই পড়ে গেল। তবে আমরা কাউকে বিষয়টা আচঁ করতে দেইনি।

যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করি
প্রথমদিকে আমরা দেশের পরিস্থিতির কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। এরপর এদিক-সেদিক যাই, ঘুরাঘুরি করে খবর জানার চেষ্টা করি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের হাওয়া বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। এরপর নূরুল হুদার সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি তৎকালীন বৃহত্তর কুমিল্লার ছাত্র ঐক্যের আহ্বায়ক এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের জিএস ছিলেন। নুরুল হুদার নেতৃত্বে প্রথম মিটিং হয় মতলবের নিশ্চিন্তপুর এলাকায়। ফ্লাইট লে. (অব.) এবি সিদ্দিক মুক্তিযুদ্ধের সময় বৃহত্তর মতলব সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন। তখন গোলাপ মোরশেদ ফারুকী মতলব থেকে নির্বাচিত তৎকালীন পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনিসহ আমরা তিনজন এবং নুরুল হুদা-এই পাঁচজন মিটিং করি। সেই মিটিংয়ে আমরা বলে দেই ‘দেশের পরিস্থিতি ভালো নয়, আমাদের যুদ্ধে নামতে হবে।’ এছাড়া ৭০ সালের নির্বাচনের পার্লামেন্ট বসার কথা ছিল জানুয়ারি মাসে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান বিষয়টা নিয়ে টালবাহানা করছে। এজন্য যে কোনো পরিস্থিতির জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। সিদ্ধান্ত আসবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের থেকে।

মিটিং শেষে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এরপর থেকে স্থানীয় যুবক ও বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করি। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি দুই মাস টানা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এতে প্রায় ২ হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। তখন দেশের মধ্যে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পার্লামেন্ট স্থগিত হওয়ার পর দ্বন্দ্ব পূর্ণমাত্রায় রুপ নেয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনলাম। ভাষণ শুনেই বুঝলাম যুদ্ধের ঘোষণা চলে এসেছে। সেসময় পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় ২৬ হাজার বাঙালি আর্মি ছিল। এদের মধ্যে অনেককে বন্দি এবং নিরস্ত্র করা হয়। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে থাকা বাঙালি আর্মিদের বন্দি করা হয়।

যুদ্ধের শুরুর দিনগুলো
সেসময় প্রথম বিদ্রোহ করেন কেএম শফিউল্লাহ, কুমিল্লাতে খালেদ মোশাররফ, চট্টগ্রামে মেজর রফিকুল ইসলাম এবং অন্যান্যরা বিক্ষিপ্তভাবে বিদ্রোহ শুরু করেন। আমরা তিন বন্ধু তখন কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে চাঁদপুর মহকুমা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী (সাবেক প্রধানমন্ত্রী)। আমাদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণের বিষয়টি তিনি জানতে পারেন। তখন চাঁদপুর মহকুমা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন ফ্লাইট লে. (অব.) এবি সিদ্দিক। তিনি আমাকে চিঠির মাধ্যমে যুদ্ধে নামার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা গণহত্যা চালায়। পরের দিন আমরা তিনজনের কাঁধে অস্ত্র ও ব্যাগে ম্যাগাজিন নিয়ে চাঁদপুর চলে আসলাম। এসেই ফ্লাইট লে. (অব.) এবি সিদ্দিকের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি আমাদের আগে থেকেই চিনতেন। তার সঙ্গে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে থাকাবস্থায়ও দেখা হয়েছিল। তিনি সবার সঙ্গে আমাদের তিনজনকে পরিচয় করে দিলেন।

warভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত মি. রাজিত মিত্তার এবং বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কেএম শফিউল্লাহ'র হাতে ফুল তুলে দিচ্ছেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট (অব.) এমএ ওয়াদুদ ও তার সহধর্মিণী

মহিলা কলেজে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন
চাঁদপুরের স্বাধীনতাকামী জনতা তখন বিছিন্নভাবে ছিলেন। তারপর সিদ্ধান্ত হয় সবাইকে একসঙ্গে করে চাঁদপুরে ক্যাম্প করার। খাওয়া-দাওয়ার কাজ সংগ্রাম কমিটি করবে। ২৭ মার্চ প্রথম চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প করা হয়। সেখানে অ্যাডজুট্যান্ট কমান্ডার হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা, অস্ত্র উদ্ধার করা এবং অস্ত্র রক্ষা করা এই দায়িত্বগুলো আমার পালন করতে হয়। ক্যাম্পে নিয়মিত সবাইকে প্রশিক্ষণের মধ্যে রাখতে হয়। ক্যাম্পে অপরিচিত কাউকে কার্ড বা পরিচয় শনাক্ত করে প্রবেশের নিয়ম ছিল। পুলিশ, ইপিআর, নেভি, এয়ারফোর্স এবং আর্মি মিলে প্রায় ৩০০ জনের মতো সদস্য ক্যাম্পে আসেন। একটা পরিপূর্ণ বিগ্রেড বলা হয়। এছাড়া স্থানীয় উৎসুক জনতাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। রাতে আমরা পেট্রোলিং করা শুরু করে দেই। তখন সারাদিন ব্যায়াম এবং অস্ত্রের প্রশিক্ষণের উপর থাকতাম। সাধারণ মানুষদের মাইকিং করে সতর্ক করে দেই। যে কোনো সময় পাকিস্তানবাহিনীর হামলা হতে পারে।

চাঁদপুরে যুদ্ধের শুরু
১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল সকাল ১০টায় চাঁদপুরের পুরান বাজার বাণিজ্যিক এলাকায় পাকিস্তান বিমানবাহিনী প্রথম হামলা চালায়। এতে করে অনেক গুদামঘর ধ্বংস হয়ে যায়। এতে একজন বৃদ্ধা মারা যায়। পরে আমরা ধাওয়া করলে তারা পালিয়ে যায়। তাৎক্ষণিক চীফ অব কমান্ডারের সঙ্গে ক্যাম্পে বসলাম। পরবর্তী ব্যবস্থা সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করলাম। এরপর দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। চাঁদপুরের বড় স্টেশন এলাকা, টেকনিক্যাল এলাকা, ইচলী ঘাট প্রত্যেক এলাকায় একজনকে প্রধান করে দায়িত্ব দেওয়া হলো। আর আমি মেইন পয়েন্টে অবস্থান নেই। আমাদের কাছে তখন খুব বেশি একটা অস্ত্র ছিলনা। সেদিন বিকালেই কুমিল্লা থেকে হানাদার বাহিনীর বিরাট একটি দল টেকনিক্যাল স্কুলে এসে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে সেদিন রাতে চাঁদপুর শহরে হামলা চালায় পাকবাহিনী। তারা তখন আমাদের ক্যাম্পের সঠিক অবস্থান জানতো না। সেখান থেকে কামান নিক্ষেপ করলেও কামানের গোলা গিয়ে মেঘনা নদীতে পড়তো। আমার নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান দল ছিল। রাত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা ওয়ারলেসের এলাকায় যুদ্ধ করি। এরপর রাতে মাইকিং করে মানুষকে সূর্য উঠার আগে শহর ছাড়ার জন্য জানিয়ে দেই। পরের দিন সকাল ৮টায় তারা চাঁদপুর শহরের দিকে মার্চ করে। তখন পুরো শহর জনমানবহীন। এরমধ্যে এক ভলান্টিয়ার তাদের দেখে স্যালুট প্রদান করেন। পাকিস্তান বাহিনীরা তাকে শত্রু মনে করে সেখানেই ফায়ার করে হত্যা করে। তারা শহরে ঢুকে পড়লে আমরা তাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করি। মাঝখানে একটি খালের পর ক্যাম্প, তাদের থেকে দূরত্ব ১০০ ফিট। আমার বাহিনীর গুলিতে একজন পাঞ্জাবী নিহত হয়। তার অস্ত্রটি ইপিআরের একজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আসে। আমি পেছন থেকে সেসময় তাকে কভার দেই। এক পর্যায়ে আমাদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় পরদিন (১০ এপ্রিল) সকাল ৮টার দিকে আমরা ফরিদগঞ্জ উপজেলার পাইকপাড়া হাইস্কুলে নতুন ক্যাম্পে চলে যাই। সেখানে সেক্টরের আওতায় এলাকা ভাগ করে দেওয়া হয়।

আমার বাহিনী নিয়ে প্রথমে মতলব যাই। এরপর আগরতলার মেলাঘরে চলে যাই। সেখানে মুজিবনগর সরকারের তালিকায় নাম যুক্ত করি। এরপর অস্ত্র রিপোর্ট করে চলে আসি। আমার দায়িত্ব পরে মতলব, গজারিয়া থানা, পশ্চিম দিকে মেঘনা নদী, পূর্বদিকে চান্দিনা এই জোন এলাকা। এটিকে ২নং সেক্টরের অধীনে একটি অঞ্চল হিসেবে ধরা হতো। এই পুরো মেঘনা অঞ্চলে কমান্ডার ছিলাম আমি। পুরো নয় মাস যুদ্ধে এই অঞ্চলে কোনো পাঞ্জাবি পা দিতে পারেনি।

warবীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট (অব.) এমএ ওয়াদুদ ও লেখক আনিসুল ইসলাম নাঈম

গোয়ালমারি যুদ্ধে আহত এবং বিজয় অর্জন
২নং সেক্টরের বড় যুদ্ধগুলোর মধ্যে গোয়ালমারি যুদ্ধটি অন্যতম। দাউদকান্দি, মতলব ও গজারিয়া উপজেলা অঞ্চলে পাকবাহিনীর তৎপরতা সীমিত করতে এবং এ অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত করতে এ যুদ্ধের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ২০ নভেম্বর ঈদুল ফিতর। ভোরে উঠে নামাজ পড়তে ও সেমাই রান্না করতে হবে। তাই আগেরদিন একটু তাড়াতাড়িই মুক্তিযোদ্ধারা ঘুমিয়ে পড়েন। গার্ড মুক্তিযোদ্ধারাও ঈদের রাত ভেবে ঘুমিয়ে পড়েন। তাদের ধারণা ছিল- হানাদার হলেও পাকিস্তানিরাও তো মুসলমান। তাই এ পবিত্র রাতে আর আক্রমণের ভয় নেই। কিন্তু স্থানীয় রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের এ গোপন ঘাঁটির খবর দাউদকান্দি থানা, ডাকবাংলো ও আশপাশের কয়েকটি ক্যাম্পে থাকা পাকসেনাদের কাছে পৌঁছে দেয়।

তারা ঈদের দিন ভোররাতেই মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা যখন ফজর ও ঈদের নামাজের জন্য ব্যস্ত, তখন ভোর ৪টার দিকে ঘাঁটি আক্রমণ করতে এগিয়ে আসে। গোয়ালমারি বাজারের বটগাছের নিচে ইয়াসমিন নামে এক পাগলি (ইনসান পাগলি) থাকত। পাক সেনাদের দূর থেকে আসতে দেখে সে দৌড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটির কাছে চলে আসে এবং চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘আইয়ে রে আইয়ে রে, আইয়ে রে আইয়ে রে।’ তার চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে মুক্তিযোদ্ধারা ঘুম থেকে জেগে ওঠেন এবং কেউ অস্ত্র হাতে নেন, কেউবা পাগলিকে গালমন্দ করেন। হঠাৎ বাজারের দিক থেকে গুলি আসতে থাকে। এবার মুক্তিযোদ্ধারা নিশ্চিত হন যে, তারা সত্যই অক্রান্ত। তখন তারা অস্ত্র নিয়ে ঘাঁটি থেকে কিছুটা পশ্চিম দিকে সরে গিয়ে পাল্টা গুলি ছুড়তে শুরু করেন। কৌশলগত কারণে তারা আরও পেছনে জামালপুর গ্রামের দিকে যেতে থাকেন। পাকসেনারাও গুলি ছুড়তে- ছুড়তে এগিয়ে যায়। এর ফলে পাকবাহিনীকে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলার সুযোগ তৈরি হয়। গোয়ালমারি-জামালকান্দির দক্ষিণে চাঁদপুরের মতলব উপজেলা।

সেদিনের যুদ্ধের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট (অব.) এমএ ওয়াদুদ বলেন, ‘মতলব সুজাতপুর ডিগ্রি কলেজ আমাদের ক্যাম্প ছিল। সেখানে অস্ত্রাগার ছিল। নিয়মিত প্যারেড হতো। প্রায় ৬০ ফুট উঁচু কড়ই গাছে ওয়ারলেস বেঁধে দেওয়া হয়। হেডকোয়ার্টারে প্রায় ১২০০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। এরমধ্যে কমান্ডো, ডাইরেক্ট অপারেটর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য ছিল। ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর, ঈদের দিন। আমি দখলকৃত পাকিস্তানি গানবোট দিয়ে মেঘনা নদী টহল দিয়ে আসি। ইফতারের পর কিছু নব্য বিবাহিত সদস্যদের ছুটি দেওয়া হয়। আর দক্ষ ১৫ জন যোদ্ধা নির্বাচন করে ২টি এলএমজি, দুই পাশে বালুর বস্তা দিয়ে মাঝখানে মর্টার বসানো হয়। অপারেশনের সময় এটি আমি পরিচালনা করতাম। সেদিন রাতে পুরো সব জায়গায় পেট্রোলিং করা হয়। সবাইকে বলা হলো, ঈদের আনন্দে কেউ যাতে বাংকার ফেলে না যায়। আমরা সবাই নদীপথে সতর্ক অবস্থায় ছিলাম। তবে পাকিস্তানীরা উত্তর-পূর্ব দিক শ্রীরায়েরচরের সামনে গোয়ালমারি দিয়ে আসা শুরু করলো।

এই অঞ্চলে শামীম ওসমানের দাদার বাড়ি, করিম ভূঁইয়া (সাবেক সেনাপ্রধান), মেজর জেনারেল সুবেদার ভূঁইয়া এবং ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের (সাবেক মন্ত্রী) বাড়ি। তারা এদিক দিয়ে ঢুকে সব বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলার পরিকল্পনা করেন। আমার ঘাঁটিতে প্রায় সব ধরনের অস্ত্র ছিল। কোনো অস্ত্রের ঘাটতি ছিলনা। সেদিন সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিতেই ওয়ারলেস বেজে উঠে ‘হ্যালো, হ্যালো..শহীদনগর থেকে বলছি। পাকবাহিনীর প্রায় ১০টি গাড়ি পশ্চিম দিকে যাচ্ছে।’ এই শব্দ শোনার পর আমি যুদ্ধের সাইরেন বাজিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেই। তখন সবাই সশস্ত্র হয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। আমি বাহিনী নিয়ে ভোরেই ঘাঁটি থেকে রওনা হলাম। সূর্য ওঠার আগেই আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে যাই। এরপর সবাইকে পজিশন নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়ে দেই। আমরা গোয়ালমারি বাজারের খুব কাছাকাছি চলে যাই। সেখান থেকে দেখলাম শামীম ওসমানের দাদার বাড়িতে আগুন দেওয়া হচ্ছে। তখন উপরে একটা রকেট লঞ্চার নিক্ষেপ করলাম। এরপর হামলা শুরু হয়। আমাদের বাহিনীর তীব্র আক্রমণে তারা বেকায়দায় পড়ে যায়। তখন মেজর আলামিন যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে ‘ট্রুপস ক্লোজ...’ বলতে থাকেন। তারা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করলেও বাঙালি গেরিলা ও সশস্ত্র যোদ্ধাদের কাছে টিকতে পারেনি। সাধারণ বাঙালিরা যুদ্ধ ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছেন।

warযুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট (অব.) এমএ ওয়াদুদের ১৯৭৩ সালে তোলা ছবি

আমি বড় বড় আম গাছের মাঝে ছিলাম। যুদ্ধ করতে করতে সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে আমরা সবাই দুর্বল হয়ে পড়ি। তখন যুদ্ধের ফাঁকে ফাঁকে খাবার খাই। ঈদের দিন মানুষজন রুটি আর সেমাই দিয়ে রোল বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ান। দুপুর নাগাদ হানাদারদের গোয়ালমারি বাজারের দলটি উত্তরে দাউদকান্দি থানার দিকে পিছু হটতে থাকে। তখন আমার নেতৃত্বাধীন ইউনিট তাদের ওপর তুমুল আক্রমণ চালায়। এতে বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং বাকিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এ সুযোগে আমার দলটি গোয়ালমারি বাজার দখল করে নেয়। বিকাল সোয়া ৪টার দিকে হানাদাররা বাজারের দিকে গুলি ছুড়তে থাকলে মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমীন শহীদ হন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সর্বশক্তি দিয়ে হানাদারদের আক্রমণ করেন। কমান্ডার শফিকের নেতৃত্বাধীন দাউদকান্দির পূর্বাঞ্চলের ইউনিট, গোয়ালমারি চৌধুরী বাড়ি ঘাঁটির দল এবং আমার দল এ তিনটি ইউনিট একযোগে হানাদারদের ওপর আক্রমণ করে। পাকসেনারাও পাল্টা জবাব দেয়। এদিকে গোমতী-মেঘনা নদীর পশ্চিম পাড়ে গজারিয়ায় অবস্থানরত একটি দল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম অগ্রসর হন। আমি বিকাল সাড়ে চারটার দিকে আহত হলাম। তখন মেজর আলামিন নেতৃত্বে পাকবাহিনী আমার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তবে ঠিক সেই মুহূর্তে বাংকার থেকে গুলি এসে লাগলো। আমার পিঠের উপরের দিকে ঘাড়ের পিছনের অংশে এক পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। চোয়ালের এক পাশ আঘাতপ্রাপ্ত হয়। আহত হওয়ার আধঘণ্টা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাই। এরপর আমার সেকেন্ড ইন চীপকে যুদ্ধের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পাশাপাশি নির্দেশনা দেওয়া হয়, ‘হয় শেষ শত্রু না হয় শেষ বুলেট।’ এর আগে যুদ্ধ বন্ধ হবেনা।

আহত হওয়ার পর তাৎক্ষণিক ফাস্ট এইডের কিছু পাওয়া যায়নি। আমাকে পাশের একটা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী তার নতুন শাড়ি ছিঁড়ে আমার আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে পেঁচিয়ে দেন। বিষয়টা আমার কাছে আশ্চর্যের মনে হলো। আমাদের ঘাঁটিতে ভালো ভালো ডাক্তার ছিল। তারা আমাকে প্রাথমিক ব্যান্ডেজ করে দিল। আমি পেইনকিলার ইনজেকশন নিজেই হাতে পুশ করলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে দিশেহারা পাকবাহিনী সন্ধ্যার পর দাউদকান্দি থানার দিকে পালিয়ে গিয়ে কালারকান্দি আনাল খালের কাঠের পুল এলাকায় অবস্থান নেয়। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম তিনদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে এখানে প্রায় ৪০ জনের মতো পাকসেনা নিহত হয়। জীবিতদের মধ্যে দুজন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে এবং বাকিরা দাউদকান্দি থানার দিকে পালিয়ে যায়। ধরাপড়া দুজনকে পরে মেরে ফেলা হয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে শহীদদের লাশ ও ১৩ জন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে আমার নেতৃত্বাধীন দলটি সুজাতপুর ঘাঁটিতে ফিরে আসে। এই যুদ্ধে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ৮ জন গ্রামবাসী শহীদ হন।

আরও পড়ুন
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা
বিজয়ের ৫৪ বছরে বাংলাদেশ

কেএসকে/জেআইএম

আরও পড়ুন