ভিডিও EN
  1. Home/
  2. স্বাস্থ্য

বন্ধ চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতাল, ‘অগ্নিপরীক্ষা’য় স্বাস্থ্য প্রশাসন

সালাহ উদ্দিন জসিম | প্রকাশিত: ০৬:০০ পিএম, ৩০ মে ২০২৫

• তিনদিনেও হাসপাতাল খোলায় অগ্রগতি নেই
• দৈনিক সেবাবঞ্চিত ৫ হাজার নাগরিক
• নিরাপত্তাহীনতায় চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারী
• জুলাই যোদ্ধাদের চাওয়া বিদেশযাত্রা-পুনর্বাসন
• ‘তাদের হাসপাতালে থাকা জরুরি নয়’

জুলাই যোদ্ধাদের নানাবিধ সংকটে তিনদিন ধরে বন্ধ জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইও)। কখনো নিজেদের দ্বন্দ্বে মারামারি, কখনো স্টাফদের ওপর হামলা, কখনো পরিচালককে অবরুদ্ধ করে রাখাসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা হাসপাতালটির নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

সর্বশেষ গেল বুধবার (২৮ মে) কর্মস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে চিকিৎসক ও স্টাফদের কর্মবিরতি কর্মসূচিতে সৃষ্ট হট্টগোলের মধ্যেই হামলা করে জুলাই যোদ্ধারা। এতে অন্তত ১৫জন চিকিৎসক ও স্টাফ আহত হন। সেনাবাহিনী এসে চিকিৎসক-স্টাফদের উদ্ধার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেও বন্ধ রয়েছে হাসপাতালের স্বাভাবিক কার্যক্রম। দৈনিক সেবাবঞ্চিত হচ্ছে ৫ হাজার নাগরিক।

চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে জুলাই যোদ্ধাদের সঙ্গে আনসার সদস্যদের হাতাহাতিচক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে আনসার সদস্যদের হাতাহাতি/ছবি: সংগৃহীত

গত তিনদিনের নানা প্রচেষ্টায় চালু হয়নি দেশের একমাত্র সরকারি এ চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালের কার্যক্রম। চিকিৎসক-স্টাফরা নিরাপত্তার অভাবে হাসপাতালে আসছেন না। জুলাই যোদ্ধারা খুঁজছেন ডাক্তার ও স্টাফদের বাসার ঠিকানা। অভিযোগ পাওয়া গেছে, বাসায় গিয়েও হামলা করতে চান তারা।

‘হাসপাতালে যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটা স্বাভাবিক করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত দুদিন তো হাসপাতালে কোনো সেবা চালু ছিল না। এটা কীভাবে চালু করা যায়, চেষ্টা হচ্ছে।— স্বাস্থ্য সেবা সচিব মো. সাইদুর রহমান

এদিকে, বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা, সচিব, হাসপাতাল প্রতিনিধি ও ছাত্রপ্রতিনিধি নিয়ে সমস্যা সমাধানে সভা করলেও সিদ্ধান্তে উপনীতি হওয়া যায়নি। ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থায় কর্তৃপক্ষ।

ঘটনার সূত্রপাত

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, জুলাই ফাউন্ডেশনের সিইও’র অনুরোধে তিনজনকে (২৩ মে) শুক্রবার চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। একদিন পর রোববার (২৫ মে) জুলাই ফাউন্ডেশনের সিইও ও হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সভা চলাকালীন ওই তিনজনসহ মোট চারজন গ্রিন টনিক পান করেন। যদিও বিষপানে আত্মহত্যা চেষ্টা বলে ছড়িয়ে যায় সবদিকে। তাদের দ্রুত রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দিনশেষে হাসপাতাল থেকে তাদের অবস্থা স্বাভাবিক ও সুস্থ বলে জানানো হয়।

পরদিন সোমবার (২৬ মে) দিনগত রাতে তাদের একজন হারপিক খেয়েছে বলে প্রচার হয়। বলা হয়, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। (যদিও পরে স্পষ্ট হয়, সে ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন) এরই পরিপ্রেক্ষিতে সোহরাওয়ার্দীতে ভর্তি ওই তিনজনসহ জুলাই যোদ্ধারা মঙ্গলবার (২৭ মে) এনআইও পরিচালককে অবরুদ্ধ করেন। পরিচালকসহ চিকিৎসকদের হেনস্তা করেন। সেখানে পেট্রোলও নিয়ে যান জুলাই যোদ্ধাদের একজন। তবে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি- আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছে, না পরিচালকের রুমে আগুন ধরাতে চেয়েছেন? পরে সেনাবাহিনী গিয়ে পরিচালকসহ চিকিৎসকদের উদ্ধার করেন।

এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পরদিন (২৮ মে, বুধবার) কর্মস্থলে নিরাপত্তার দাবিতে কর্মবিরতি করে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। জরুরি বিভাগ ছাড়া নিয়মিত অস্ত্রোপচার থেকে শুরু করে সব চিকিৎসাসেবা বন্ধ ছিল। যার কারণে দিনের সকাল থেকেই এ নিয়ে হাসপাতালে আসা সাধারণ রোগী ও সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে স্টাফদের কথা কাটাকাটি হয়। বেলা সাড়ে ১১টার পর চিকিৎসক ও রেজিস্টার মাহফুজ আলম বিষয়টি ব্যাখ্যা করে সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।

‘জুলাই যোদ্ধারাদের কয়েকটি ঘটনায় আমরা বিব্রত। তারপরও তাদের মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছিলাম। সর্বশেষ তারা যেভাবে চিকিৎসক ও স্টাফদের মেরেছেন। এখন চিকিৎসক ও স্টাফরা অনিরাপদ বোধ করছেন। তারা হাসপাতালে আসতে চাইছেন না।’— হাসপাতালের পরিচালক খায়ের আহমেদ চৌধুরী

যাদের পূর্বনির্ধারিত অস্ত্রোপচারের তারিখ ছিল, তাদের পরে ফোনে ডেকে এনে অস্ত্রোপচার করে দেবেন বলে জানিয়ে দেন। এতেও সেবাপ্রার্থীরা নিবৃত হয়নি। তারা হই হুল্লোড় ও হট্টগোল করেন। চিকিৎসক ও নার্সদের তেড়ে আসেন। এসময় আনসাররা নিবৃত করতে গেলে হাতাহাতি হয়। স্টাফ ও সেবা প্রার্থীদের মধ্যে মারামারিও হয়। এ উত্তেজনা পুরো হাসপাতাল ছড়িয়ে পড়লে ভেতরের সব ওয়ার্ডের কলাপসিবল গেট আটকে তালা দিয়ে দেন নিরাপত্তারক্ষীরা। বিষয়টিকে নিজেদের জন্য আতঙ্কের বা আক্রমণ হতে পারে এমন আশঙ্কায় উল্টো তালা ভেঙে জুলাই যোদ্ধারা লাঠিসোঁটা, রড হাতে ডাক্তার, স্টাফ ও সেবাপ্রার্থীদের এলোপাথাড়ি পেটানো শুরু করেন। তাদের সঙ্গে এসে যোগ দেন পঙ্গু হাসপাতালে থাকা জুলাই যোদ্ধারাও। এ ঘটনায় চিকিৎসকসহ ১৫ জন আহত হন। আতঙ্কে চিকিৎসক নার্স ও স্টাফ বেশিরভাগ হাসপাতাল ছেড়ে যান। কেউ কেউ ভেতরে আটকে গেলেও সেনাবাহিনী এসে উদ্ধার করে। বন্ধ হয়ে যায় হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম। কার্যত পুরো হাসপাতাল জুলাই যোদ্ধাদের দখলে চলে যায়। এরপর থেকে হাসপাতালে যাচ্ছেন না চিকিৎসক, নার্সসহ স্টাফরা।

তিনদিন ধরে বন্ধ চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতাল

সেই থেকে আজ শুক্রবারসহ গেল তিনদিন বন্ধ দেশের একমাত্র সরকারি চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতাল। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব মহল। অস্থিরতা আছে জুলাই যোদ্ধাদের মধ্যেও।

বৃহস্পতিবার (২৯ মে) সকালে এ নিয়ে হাসপাতালটির ছাত্র সমন্বয়ক নাবিলার সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তিনি বলেন, আমি হাসপাতালেই আছি। সব ধরনের সেবা কার্যক্রম বন্ধ আছে। তবে এটির সুরাহার জন্য কর্তৃপক্ষ ২৪ ঘণ্টা সময় নিয়েছে, দেখি কী হয়।

একইদিন বিকেলে এ নিয়ে বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা, সচিব, হাসপাতাল প্রতিনিধি, ছাত্রপ্রতিনিধিসহ বৈঠক করেও সিদ্ধান্তে উপনীতি হতে পারেনি।

চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে চিকিৎসক ও স্টাফদের কর্মবিরতিচক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে চিকিৎসক ও স্টাফদের কর্মবিরতি/ছবি: সংগৃহীত

এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক খায়ের আহমেদ চৌধুরী শুক্রবার জাগো নিউজকে বলেন, ‘বৈঠকে সবার মতামত আসছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত হয়নি। আমি বাস্তবচিত্র তুলে ধরেছি। এটা তো আমরা স্বীকার করি এবং সেবা দিই যে, তারা (জুলাই আহত) অনেক বড় সেক্রিফাইস করেছে। তাদের অনেকের দুই চোখ ক্ষতিগ্রস্ত, অনেকের এক চোখ ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা তাদের সাধ্যের পুরোটা দিয়েই চিকিৎসা দিয়েছি। এমনকী যাদের প্রয়োজন বিদেশে পাঠিয়েছি। বিদেশ থেকে বিখ্যাত চিকিৎসকদের এনেও চিকিৎসা করিয়েছি। তাদের এখন প্রয়োজন পুনর্বাসন। সেটিও মন্ত্রণালয়সহ সব জায়গায় বলেছি। সমন্বিত প্রচেষ্টা চলমান। এরই মধ্যে পরপর কয়েকটি ঘটনা তারা ঘটিয়ে ফেলেছে। যেগুলোতে আমরা বিব্রত। তারপরও তাদের মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আমরা কিন্তু কাজ করে যাচ্ছিলাম। সর্বশেষ তারা গেল বুধবারে যেভাবে চিকিৎসক, স্টাফদের মেরেছে। এখন ডাক্তার, স্টাফরা অনিরাপদ বোধ করছে, হাসপাতালে আসতে চাইছে না।’

তিনি বলেন, ‘তাদের (জুলাই আহত) এখন চিকিৎসাটা মূলত ফলোআপ বা চলমান চিকিৎসা। এজন্য তাদের এনআইও’র মতো বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। যার যার এলাকায় ফেরত যেতে পারে। তাদের অসুস্থতার সিমটম (লক্ষণ) দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট এলাকার মেডিকেল কলেজগুলোর চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগে যাবে, সেখানে তাদের সেবা দিতে পারবে। যদি ওই হাসপাতাল মনে করে অস্ত্রোপচার লাগবে বা বিশেষায়িত কোনো সেবা লাগবে, তারা এনআইও’কে রেফার করবে। আমরা সেটা করে দেবো। অথবা, সরকার যদি মনে করে তাদের ঢাকার হাসপাতালে রেখেই সেবা দেবে, তাহলে অন্য হাসপাতালে শিফট করতে হবে।’

হাসপাতাল পরিচালক বলেন, ‘যে স্টাফরা তাদের মার খেয়েছে, তারা তাদের সেবা দিতে অস্বস্তি বোধ করবেন, আর জুলাই আহতরাও তাদের সেবায় আস্থা রাখতে পারবেন না। নার্সরা যদি কোনো ওষুধ দেন, তারা সন্দেহ করবেন, ভাববে বিষ দিয়ে দিলো কি না। যে বাবুর্চিকে মারছেন, বার বার বলেও তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে পারছি না। বাবুর্চি বলছে, স্যার আমারে তো তারা মারছে, আমার ওপর তো তাদের বিশ্বাস থাকার কথা না।

এদিকে, জুলাই আহতরাও মেইন বাবুর্চি দুজনকে অ্যালাউ করেনি, করবে না। এখন কোনোরকম একজনকে ম্যানেজ করে পাঠিয়েছি। মেইন বাবুর্চি দুজনকে তারা মেরেছিল। আমার ডাক্তার, নার্স, স্টাফ সবাই আতঙ্কিত। তারা মার খেয়েছে সেদিন। এখনো সব দিক থেকে হুমকি পাচ্ছে। ওরা (জুলাই আহতরা) হুমকি দিচ্ছে চিকিৎসকদের বাসায় বাসায় গিয়ে হামলা করবে। পরিস্থিতিটা ঘোলাটে করছে তারা।’

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাসপাতালে যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটা স্বাভাবিক করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গতকাল ও গত পরশু তো হাসপাতালে কোনো সেবা চালু ছিল না। এটা কীভাবে চালু করা যায়, চেষ্টা হচ্ছে। আহতদের বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া এবং পুনর্বাসনের দাবির বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট। আমরা চেষ্টা করছি, যাদের বিদেশ যাওয়া প্রয়োজন যাবে। পুনর্বাসন কমন দাবি, কিন্তু একেকজনের একেকভাবে পুনর্বাসন করতে হবে, কাজটা সহজ না। আমরা চেষ্টা করছি।’

বৈঠক সূত্র বলছে, বৈঠকে জুলাইল যোদ্ধাদের প্রতিনিধি নাহিদ ইসলাম, হাসনাত আব্দুল্লাহ ও আবু বকর উপস্থিত ছিলেন। তারাও ৮/১০জন জুলাই যোদ্ধাকে এনআইও থেকে অন্যত্র স্থানান্তর করার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকার বেকায়দায় আছে। তারা জানে, জুলাই যোদ্ধাদের অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। যৌক্তিক-অযৌক্তিক যেকোনো বিষয়ে মেজাজ হারান তারা। চিকিৎসক-স্টাফদের সঙ্গে বিবাদে জড়ান। গ্রুপিংয়ে নিজেরাও মারামারি করেন। সর্বশেষ পুরো হাসপাতালে চিকিৎসক ও স্টাফদের মেরে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করেছেন তারা। এতে চিকিৎসক-স্টাফরা হাসপাতালে আসছেন না। আবার জুলাই যোদ্ধারা হাসপাতাল ছাড়ছেন না।

হাসপাতাল সূত্র নিশ্চিত করেছে, গেল বুধবার পর্যন্ত ৫৫ জনের মতো জুলাই যোদ্ধা ছিল। এখন আছে শতাধিক। তারা ছাড়া হাসপাতালে অন্য কারো প্রবেশের পরিবেশও নেই।

চিকিৎসক, স্টাফ ও জুলাই যোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত তারা কয়েক ভাগে বিভক্ত। কেউ চায়, আরেকটু তৃপ্তির জন্য আমাদের ইউরোপ আমেরিকা পাঠাক। দেখি, সেখানকার চিকিৎসকরা কী বলেন! আবার কেউ বলে যা হারাবার তা তো হারাইছি, সরকার আমাদের কিছু করে দিক। কর্ম-ব্যবসা বা বাড়িঘর, একেকজনের একেকটা নেই। সেগুলো করে দিলেই হয়।

এসইউজে/এমএএইচ/জিকেএস