‘নাপা’ সিরাপ খেয়ে শিশুমৃত্যু: রিড ফার্মার পুনরাবৃত্তি নয়তো?
দুই শিশুর মৃত্যুর পর নাপা সিরাপ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড উৎপাদিত নাপা সিরাপ খেয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামে একই পরিবারের দুই শিশুর মৃত্যুর অভিযোগের ঘটনা দেশবাসীর মনে ১৩ বছর আগে রিড ফার্মাসিউটিক্যালসের তৈরি ভেজাল প্যারাসিটামল খেয়ে ২৮ শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
রিড ফার্মাসিউটিক্যালসের উৎপাদিত ওই প্যারাসিটামল সিরাপে চামড়া ও বস্ত্র তৈরির কারখানায় ব্যবহৃত ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান ডাই ইথাইলিন গ্লাইকল ব্যবহৃত হয়েছিল। ক্ষতিকর ওই ওষুধ খেয়ে কিডনি বিকল হয়ে ২৮ শিশুর মৃত্যু হয়। আশুগঞ্জের দুর্গাপুর গ্রামের দুই শিশুর মৃত্যু নাপা সিরাপ নাকি অন্য কোনো কারণে হয়েছে, তা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন জাগছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এরই মধ্যে দেশের সব বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তাকে নিজ নিজ নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় অবস্থিত পাইকারি ও খুচরা ফার্মেসি পরিদর্শন করে নির্দিষ্ট ব্যাচের নাপা সিরাপ (প্যারাসিটামল ১২০ মি.গ্রা./৫ মি.গ্রা., ব্যাচ নম্বর ৩২১১৩১২১, উৎপাদন তারিখ ১২/২০২১, মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ ১১/২০২৩) নমুনা পরীক্ষা ও বিশ্লেষণের জন্য কেন্দ্রীয় ওষুধ পরীক্ষাগারে পাঠানোর নির্দেশনা দিয়েছে। এছাড়া পৃথক দুটি কমিটি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ওষুধ কারখানা সরেজমিনে পরিদর্শন করে নির্দিষ্ট ব্যাচের নাপা সিরাপ উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও ঘটনাস্থল আশুগঞ্জে সরেজমিনে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য ছুটে গেছে।
ওষুধ শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু দুটির মৃত্যু কি নাপা সিরাপে হয়েছে নাকি অন্য কোনো কারণে, তা সঠিকভাবে জানতে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। যে দুটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে তারা কয়েকদিন ধরে জ্বরে ভুগছিল বলে জানা গেছে। এক্ষেত্রে জ্বর ছাড়া অন্য কোনো অসুখ ছিল কি না, ওই সময় অন্য আরও কোনো ওষুধ সেবন করেছে কি না, যে নাপা সিরাপ সেবনের কথা বলা হচ্ছে সে ওষুধটি কী পরিমাণ অর্থাৎ কয় চামচ খেয়েছিল, খাওয়ার কতক্ষণ পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল, হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা কী চিকিৎসা দিয়েছিলেন, তখন কি শিশুদের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল ছিল, হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার কতক্ষণের মধ্যে মৃত্যু হলো- তা জানা জরুরি।
মৃত্যুর পর মরদেহ ময়নাতদন্তের সময় বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে পাকস্থলি, লিভার, কিডনি, হার্ট এবং ব্রেনের নমুনা সংগ্রহ ও তা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।
এছাড়া নির্দিষ্ট যে ওষুধটি খেয়ে শিশুর মৃত্যু হয়েছে সেটির নমুনা সংগ্রহ করে দ্রুত ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। স্বচ্ছতার প্রয়োজনে একাধিক ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষা করা যেতে পারে বলে তারা অভিমত ব্যক্ত করেন।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আইয়ুব হোসেন জানান, নাপা সিরাপ খেয়ে দুই শিশুর মৃত্যুর অভিযোগটি খতিয়ে দেখতে এরই মধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে অধিদপ্তর। সারাদেশ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে আনার পাশাপাশি দুজন পরিচালকের নেতৃত্বে দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তিনি জানান, একটি কমিটি আশুগঞ্জের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবে। আরেকটি টিম গাজীপুরে বেক্সিমকোর ওষুধ কারখানা পরিদর্শন করে নির্দিষ্ট ব্যাচের উৎপাদিত ওষুধ কী অবস্থায় রয়েছে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে।
নাপা সিরাপ খেয়ে দুই শিশুর মৃত্যু প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো সায়েদুর রহমান বলেন, শিশু দুটির মৃত্যু সিরাপ খেয়ে হয়েছে নাকি অন্য কোনো কারণে হয়েছে, এ সম্পর্কে এখনই কোনো মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। যে ওষুধটি খেয়ে মৃত্যু হয়েছে সেটি পরীক্ষা করা ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এর পাশাপাশি শিশু দুটির আগে কোনো জটিল রোগের ইতিহাস রয়েছে কি না তা জানা প্রয়োজন।
এদিকে বিবিসি বাংলার সঙ্গে আলাপকালে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের একজন মুখপাত্র রাব্বুর রেজা বলেছেন, নাপা সিরাপের যে ব্যাচটি নিয়ে কথা উঠেছে তার সব ডাটা যাচাই করে তারা দেখেছেন, যে মান তারা অনুসরণ করেন, তার কোনো ব্যতিক্রম সেখানে হয়নি। এই ব্যাচের সিরাপ থেকে বিপদের কোনো আশঙ্কা থাকার কথাই নয়।
তিনি বলেন, ডিসেম্বর মাসে তৈরি ব্যাচটির ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ বোতল বিক্রি হয়েছে। কিন্তু কোনো অভিযোগ আসেনি।
ওই কর্মকর্তা বলেন, যে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কেনা হয়েছে সেখানে বেক্সিমকো কোনো ওষুধ কখনই বিক্রি করেনি। কারণ ওই দোকানের কোনো লাইসেন্স নেই।
গত ১০ মার্চ রাতে আশুগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামে ইয়াছিন খান (৭) ও মোরসালিন খান (৫) নামে দুই শিশুর মৃত্যু হয়।
এমইউ/এমএইচআর/জিকেএস