ওষুধ-জনবল সংকটে ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতাল, চিকিৎসাসেবা ব্যাহত
ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতাল
রাজধানীর পুরান ঢাকার বংশালে অবস্থিত দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীন ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালে চলছে নানা অনিয়ম। সময়মতো চিকিৎসক না আসা, চিকিৎসকের অভাব, ওষুধ সংকট, টেকনিশিয়ান দিয়ে দাঁতের চিকিৎসাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে এই হাসপাতালের বিরুদ্ধে। যদিও আধুনিক অবকাঠামোর হাসপাতালটিতে নেই অর্থ সংকট। প্রতি মাসে হাসপাতাল পরিচালনায় গুনতে হচ্ছে কোটি টাকা। তবে জনবল আর ওষুধ সংকটে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা।
গত রোববার (১১ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টায় সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের নিচতলায় মেডিসিন, গাইনি ও প্রসূতি, প্যাথলজি, চর্ম ও যৌন, দন্ত, নাক, কান ও গলা বিভাগের সামনে অপেক্ষা করছেন ২০ থেকে ২৫ জন রোগী। তবে বেশিরভাগ চিকিৎসককেই এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর হাসপাতালে আসতে দেখা যায়। হাসপাতালটিতে সার্জারি চিকিৎসক মাত্র একজন। তিনিও সকাল সাড়ে ৯টায় হাসপাতালে আসেন। হাসপাতালে ঢুকেই অস্ত্রোপচার করতে অপারেশন থিয়েটারে যান। এসময় তার রুমের সামনে ১০ থেকে ১৫ জন রোগীকে অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়।
হাসপাতালটিতে প্রয়োজনীয় ওষুধও মিলছে না। বেশ কয়েক মাস ধরে হাসপাতালে আগত রোগীরা প্রয়োজনীয় ওষুধ পাচ্ছেন না। সেবা নিতে এসে রোগীদের ফিরে যেতে হচ্ছে ওষুধ ছাড়া। চিকিৎসক দেখিয়ে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে ফার্মেসিতে গেলে অধিকাংশ রোগীকে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট ও নাপা সিরাপ দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে দুস্থ-অসচ্ছল রোগীদের। কারণ, অধিকাংশ ওষুধ তাদের বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, যে ওষুধের দাম কম, এখান থেকে সেটি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বেশি দামি ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। এছাড়া সাতদিনের ওষুধ লিখে দিলেও পাওয়া যায় দুইদিনের, বাকি ওষুধ কিনতে হয় বাইরে থেকে।
এ বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, চাহিদার তুলনায় কম সরবরাহ থাকায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অর্থবছরে একবার দেওয়া হয় ওষুধ। শেষ হয়ে গেলে নতুন ওষুধ পেতে বাজেট সংশোধন করে আবেদন করতে হয়। সেটিও পেতে তিন থেকে চার মাস সময় লাগে।
এছাড়া প্রতিষ্ঠার ২২ বছরেও পূর্ণাঙ্গ সেবা চালু করা সম্ভব হয়নি হাসপাতালটিতে। তিন বিভাগ ছাড়া বন্ধ ইনডোর সেবা। তিনতলা বিশিষ্ট ১৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে বর্তমানে রোগী ভর্তি রয়েছেন ৩২ জন। ১০ শয্যার এসি-নন এসি কেবিন থাকলেও সেগুলোতে এখন রোগী ভর্তি নেই। নেই ব্লাড ব্যাংক, সিটি স্ক্যান ও এমআরআই মেশিন। এক্স-রে মেশিন থাকলেও তা বন্ধ। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার বেশিরভাগই করা হচ্ছে আশপাশে গড়ে ওঠা বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। অভিযোগ রয়েছে, এসবের কমিশন পাচ্ছেন চিকিৎসকরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুরান ঢাকার মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে ১৯৮৯ সালে ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতাল চালু করা হয়। তখন নাম ছিল শ্রমজীবী হাসপাতাল। পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীনে এনে ১৫০ শয্যায় উন্নীত করে নাম দেওয়া হয় ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতাল।
হাসপাতালটির শয্যা সংখ্যার বিপরীতে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও কর্মচারী মিলিয়ে ১৬৬টি পদ রয়েছে। তবে বর্তমানে এর ৬০ শতাংশই খালি। জনবল চেয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হলেও সাড়া মিলছে না। হাসপাতালটিতে চোখের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও নেই, টেকনিশিয়ান দিয়ে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
মেডিকেল অফিসারের ১৯টি পদ থাকলেও বর্তমানে ১২ জন চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। স্টাফ নার্স ৩১ জনের বিপরীতে রয়েছেন ৮ জন। নার্সিং এইড ১০টি পদ থাকলেও সেবা দিচ্ছেন মাত্র একজন। এমনকি চিকিৎসকরা অবসরে যাওয়ার পরও নতুন কাউকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।
সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বকুল নামের এক রোগীকে বহির্বিভাগ থেকে চিকিৎসা নিয়ে বের হতে দেখা যায়। চিকিৎসক তার ব্যবস্থাপত্রে ৬ ধরনের ওষুধ লিখেছেন। তবে হাসপাতালের ফার্মেসি থেকে শুধুমাত্র প্যারাসিটামল ট্যাবলেট দিয়ে তাকে বিদায় করে দেওয়া হয়।
তিনদিন ধরে জ্বরে ভুগছেন আলী আজগর। সেবা নিতে এসেছেন এই হাসপাতালে। চিকিৎসক চারটি ওষুধ লিখলেও একটি দিয়ে বিদায় করে দেওয়া হয় তাকে। হাসপাতালটির ফার্মেসির সামনে এক ঘণ্টা অবস্থান করে এমন একাধিক দৃশ্য চোখে পড়ে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফার্মেসির দায়িত্বরত কর্মচারী জানান, ওষুধের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। রোগীর ব্যবস্থাপত্রে যেসব ওষুধ লেখা হচ্ছে সবগুলো নেই। সিটি করপোরেশনকে অনেকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে এখনও ওষুধ আসেনি।
এদিকে, এই হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসার জন্য ২০২০ সালের অক্টোবরে পাঁচটি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ স্থাপন করা হয়েছিল। এরপর গত বছরের এপ্রিলে ১৫টি হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) স্থাপন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু আইসিইউ ও এইচডিইউ এখনও চালু করা সম্ভব হয়নি। জনবল সংকট থাকায় এগুলো যথাযথ পরিচর্যা না করায় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় এখান থেকে আইসিইউ ও এইচডিইউ সরিয়ে নিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একাধিক চিঠি দেওয়া হয়। গত মাসেও একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ এখনো লক্ষ্য করা যায়নি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালটির পরিচালক আম্মতে নূর ওয়াহিদা সুলতানা বলেন, প্রয়োজনীয় অনেক ওষুধ এখন হাসপাতালে মিলছে না। ওষুধ সংকট দেখা দিয়েছে। চাহিদার তুলনায় ওষুধ অপ্রতুল। বছরে একবার বাজেট থাকে। অর্থ বছরের তিন-চার মাস আগেই অনেক ওষুধ শেষ হয়ে যায়। আমরা সমন্বয় করার চেষ্টা করি। তবে অর্থবছরের শেষের তিন মাস চালাতে পারি না।
এদিকে, হাসপাতালটিতে দাঁতের চিকিৎসায় আধুনিক সব যন্ত্রপাতি, সুসজ্জিত কক্ষসহ সব সরঞ্জাম থাকলেও নেই চিকিৎসক। তবে বন্ধ নেই চিকিৎসাসেবা। দন্ত চিকিৎসকের অবসরের পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পরামর্শে ওই চেয়ারে দিব্যি বসে গেছেন টেকনিশিয়ান শারমিন সুলতানা। দীর্ঘ তিনমাস ধরে নিয়মিত রোগী দেখছেন তিনি। লিখছেন ব্যবস্থাপত্রও! হাসপাতালটিতে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ জন রোগী দাঁতের চিকিৎসা নিতে আসেন।
এ বিষয়ে হাসপাতালটির পরিচালক আম্মতে নূর ওয়াহিদা সুলতানা বলেন, তিন মাস হয়েছে দন্ত চিকিৎসক অবসরে গেছেন। নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। সাময়িক সময়ের জন্য শারমিনকে দন্ত চিকিৎসকের চেয়ারে বসানো হয়েছে। দাঁত ব্যাথাসহ কয়েকটি চিকিৎসাসেবা তিনি দিচ্ছেন। তবে দাঁতের জটিল কোনো চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না বলে দাবি করেন পরিচালক।
এএএম/কেএসআর/এএসএম