দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন
এশিয়ায় আমেরিকার সবচেয়ে পুরোনো মিত্রও কেন চীনের দিকে ঝুঁকছে?
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও থাইল্যান্ডের রাজা মহা ভাজিরালংকর্ণ/ ছবি: চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
এশিয়ায় আমেরিকার সবচেয়ে পুরোনো মিত্র হিসেবে পরিচিত থাইল্যান্ড এখন দ্রুত চীনের দিকে ঝুঁকছে। রাজনীতি, অর্থনীতি ও নিরাপত্তা তিন ক্ষেত্রেই এর প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দীর্ঘদিন ধরে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে সমতা বজায় রাখলেও এখন থাইল্যান্ডের ঝোঁক যে শক্তিশালী প্রতিবেশী চীনের দিকেই বেশি, দেশটির সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো তা স্পষ্ট করে দিচ্ছে।
গত ১২ নভেম্বর থাইল্যান্ড সরকার দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে শে ঝিজিয়াংকে চীনে প্রত্যার্পণ করে। তিনি মিয়ানমারে অনলাইন জুয়া ও বড় আকারের প্রতারণা চক্র পরিচালনার অভিযোগে বহুদিন ধরে চীনের কাছে ‘ওয়ান্টেড’। থাই রাজা মহা ভাজিরালংকর্ণের চীন সফরের আগের দিনই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যা দুই দেশের ঘনিষ্ঠতার বড় ইঙ্গিত বলে বিশ্লেষকদের মত।
গত আগস্টে ব্যাংককের একটি আর্ট গ্যালারি তিব্বতি, উইঘুর ও হংকংয়ের শিল্পীদের প্রদর্শনী সরিয়ে নেয়। কূটনৈতিক চাপের দাবি অস্বীকার করলেও স্থানীয় গণমাধ্যমে বলা হয়, চীনা দূতাবাসের আপত্তির পরই গ্যালারি এই সিদ্ধান্ত নেয়।
আরও পড়ুন>>
ক্ষমতাচ্যুত হলেন থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী
সীমান্তে ‘ভূতের শব্দ’ বাজিয়ে ভয় দেখাচ্ছে থাইল্যান্ড, দাবি কম্বোডিয়ার
বিদেশি পর্যটক বাড়াতে বিনামূল্যে প্লেনের টিকিট দেবে থাইল্যান্ড
এরও আগে ২০১৪ সাল থেকে আটক থাকা ৪০ উইঘুর পুরুষকে চীনে ফেরত পাঠায় থাইল্যান্ড। যদিও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ কয়েকটি দেশ তাদের আশ্রয় দিতে চেয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র তখন প্রকাশ্যে হতাশা প্রকাশ করে। তখন ব্যাংকক দাবি করে, উইঘুরদের অন্য কোথাও পাঠালে চীনের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের ভয় ছিল।
ব্যবসা ও বিনিয়োগ: পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সহযোগিতা
চীনা কোম্পানিগুলো এখন থাইল্যান্ডের শিল্পপার্ক, অবকাঠামো ও দ্রুতগতির রেল প্রকল্পে বিপুল বিনিয়োগ করছে। নরেসুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক পল চেম্বার্সের সাম্প্রতিক নথিতে বলা হয়, ২০২৩ সালে ফেউ থাই পার্টি ক্ষমতায় এসে পর্যটন ও বিনিয়োগ বাড়াতে চীনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে।
চীন–থাইল্যান্ড দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে ১২২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা ২০২৪ সালের পুরো বছরের (১১৬ বিলিয়ন) চেয়ে বেশি।
থাইল্যান্ডের পর্যটন আয় দেশটির মোট জিডিপির ১২ শতাংশ। গত বছর ৩ কোটি ৫৫ লাখ আন্তর্জাতিক পর্যটকের মধ্যে ৬৭ লাখই ছিলেন চীনা। তবে ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে সেই সংখ্যা নেমে আসে ৩৪ লাখে। চীনা তারকা ওয়াং জিংকে মিয়ানমারের প্রতারণা চক্রে অপহরণ ও পাচারের ঘটনার পর নিরাপত্তা নিয়ে চীনা পর্যটকদের ভয় বেড়ে যাওয়াই এর প্রধান কারণ। এখন প্রতারণা শিল্প দমনে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ শুরু করেছে।
অস্ত্র বাণিজ্যেও চীনা প্রভাব
২০১৪ সালে থাইল্যান্ডে সামরিক অভ্যুত্থানের পর যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা কমিয়ে দিলে সেই শূন্যতা দ্রুত পূরণ করে বেইজিং। দেশটিকে কম দামে সাবমেরিন, সাঁজোয়া যান, ট্যাংক ও ক্ষেপণাস্ত্রসহ নানা সরঞ্জাম দিয়েছে চীন। ছিল না গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কোনো ধরনের ‘নির্দেশনা’।
লোই ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে থাইল্যান্ড চীনের কাছ থেকে ৩৯ কোটি ৪০ লাখ ডলারের অস্ত্র কিনেছে, যা যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা ২০ কোটি ৭০ লাখ ডলারের অস্ত্রের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮০ লাখ ডলারে, যা ২০২৩ সালে যা ১০ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
আমেরিকার সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছেদ নয়
১৮৩৩ সালে স্বাক্ষরিত ‘অ্যামিটি অ্যান্ড কমার্স চুক্তি’র মাধ্যমে শুরু হওয়া থাইল্যান্ড–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এখনো টিকে আছে। দুই দেশ মিলে আয়োজিত ‘কোবরা গোল্ড’ মহড়া এশিয়া অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বহুজাতিক সামরিক অনুশীলন। প্রায় ৩০টি দেশ এতে অংশ নেয়, থাকে হাজার হাজার মার্কিন সৈন্যও।
যুক্তরাষ্ট্র থাইল্যান্ডের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি ভবিষ্যতে এতে প্রভাব ফেলতে পারে।
চীনের কাছে যাওয়ার ঝুঁকি
চীনের সঙ্গে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতার কারণে থাইল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে, সস্তা চীনা পণ্যে বাজার সয়লাব হওয়ায় একাধিক কারখানা বন্ধের মুখে রয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭০ শতাংশের বেশি থাই সিইও মনে করেন, চীনা পণ্য স্থানীয় শিল্পকে আরও বিপদে ফেলবে।
ঝুঁকি কমাতে থাইল্যান্ডের অর্থমন্ত্রী একনিতি নিত্তিতানপ্রাপাস চীনা সস্তা পণ্যের ওপর ১ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন, যা আগামী ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। চীনের প্রভাবের জোয়ারে এটি এক বিরল প্রতিরোধমূলক সিদ্ধান্ত।
কেএএ/