চার মামলায় ভোগান্তি
ভালো চাকরি পাচ্ছেন না কোটা সংস্কার আন্দোলনের কর্মীরা
ছবি জাগো নিউজ
কোটা সংস্কার আন্দোলন সমকালীন বাংলাদেশে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সফল আন্দোলন। সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে কোটা পদ্ধতির সংস্কারই ছিল এই আন্দোলনের মূল দাবি। অতিরিক্ত পাওনা হিসেবে যখন প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল হয় তখন হাসি ফোটে সাধারণ চাকরিপ্রার্থীদের মুখে। কিন্তু অগণিত চাকরিপ্রার্থীর জন্য যারা সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, মাঠে থেকেছেন তারা নিজেরাই এখন ভালো চাকরি পাচ্ছেন না। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই জানা গেছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত চারটি মামলা চলমান। জামিনে থাকলেও মামলার আসামিদের পোহাতে হচ্ছে নানা ভোগান্তি। সরকারি-বেসরকারি চাকরিপ্রাপ্তি, এমনকি ব্যবসা করে চলাও কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল রাজধানীর শাহবাগে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে দায়িত্বরত পুলিশকে মারধর, কর্তব্যকাজে বাধা, পুলিশের ওয়াকিটকি ছিনতাই ও ভিসির বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনার অভিযোগে চারটি মামলা করা হয়। এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি। আর ভিসির বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র সিকিউরিটি অফিসার এসএম কামরুল আহসান বাদী হয়ে আরও একটি মামলা করেন।
বর্তমানে মামলাগুলো তদন্ত করছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এসব মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এ পর্যন্ত ৪১ বার সময় নিয়েছে তদন্ত সংস্থা। এরপরও কোনো প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। প্রতিবেদন দাখিল না হওয়ায় মামলার আসামিরা ভালো চাকরিও পাচ্ছেন না বলে মন্তব্য করেছেন তাদের আইনজীবী।
অন্যদিকে তদন্ত সংস্থা বলছে, মামলাগুলোর তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হলেই আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
আরও পড়ুন: কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের মামলা থেকে অব্যাহতির দাবি
মামলার নথি থেকে জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনের চার মামলায় ২০ জন গ্রেফতার হন। পরে ২০১৮ সালের ২০ আগস্ট আদালত তাদের জামিন মঞ্জুর করেন। বর্তমানে তারা জামিনে আছেন।
জামিনে থাকা আসামিরা হলেন গণ অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান, ফারুক হোসেন, মশিউর রহমান, মাসুদ আলম মাসুদ, সাইদুর রহমান, আবু সাঈদ ফজলে রাব্বী, আলী হোসেন, আতিকুর রহমান, রাকিবুল হাসান, তরিকুল ইসলাম, সাখাওয়াত হোসেন, আলী হোসেন, মাজহারুল ইসলাম, রবিন হুসাইন, মাহফুজুর রহমান, জাকারিয়া, সৈয়দ মোহাম্মদ আমানুল্লাহ, সোহেল ইসলাম, মাসুদ সরকার ও জসিম উদ্দীন আকাশ।
কোটা সংস্কার আন্দোলন- ফাইল ছবি
প্রতি মাসে মামলার ধার্য তারিখে তারা আদালতে হাজিরা দেন।
উপাচার্যের বাসভবনে হামলা
মামলার বিবরণে বলা আছে, ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল রাতে শতাধিক অজ্ঞাত মুখোশধারী সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারী দেশীয় অস্ত্র, লোহার রড, পাইপ, হেমার ও লাঠি নিয়ে উপাচার্য ভবনে প্রবেশ করে। মালামাল ভেঙে চুরমার ও লুটতরাজ করে তারা। দুটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয় ও দুটি গাড়ি ভাঙচুর করে। আসামিরা উপাচার্যকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালায়। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল এবং সরকারকে বিব্রত করার অপপ্রয়াস চালায়।
আরও পড়ুন: মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালসহ তিন দফা দাবি
এ ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র সিকিউরিটি অফিসার এসএম কামরুল হাসান বাদী হয়ে মামলা শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেন।
এ মামলার আসামি রাশেদ খান, মাসুদ আলম মাসুদ, সাইদুর রহমান, আবু সাঈদ ফজলে রাব্বী, আলী হোসেন, আতিকুর রহমান ও রাকিবুল হাসান বর্তমানে জামিনে।
পুলিশের কাজে বাধা
মামলার বিবরণে বলা আছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল আসামিরা লোহার রড, পাইপ, হ্যামার, লাঠি নিয়ে শাহবাগ থানাধীন টিএসসি মোড় থেকে দোয়েল চত্বর মোড় পর্যন্ত অবৈধ জনতাবদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কারের আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে মিশে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশের সরকারি কাজে বাধা প্রদান এবং জনসাধারণের যানবাহন ভাঙচুর করে। এছাড়া আশপাশের দোকানপাট, স্থাপনায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ক্ষতিসাধন করে। মূল্যবান জিনিসপত্র রাস্তায় এনে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এ ঘটনায় শাহবাগ থানা পুলিশ বাদী একটি মামলা করে।
এ মামলার আসামিরা হলেন ফারুক হোসেন, তরিকুল ইসলাম, মাসুদ আলম মাসুদ, সাখাওয়াত হোসেন, আবু সাঈদ ফজলে রাব্বী, রাকিবুল হাসান ও আলী হোসেন। এ মামলার সবাই বর্তমানে জামিনে।
ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল আসামিরা পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দিয়ে আক্রমণ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও পুলিশ-জনসাধারণকে জখম করে। এ ঘটনায় শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক ভজন বিশ্বাস বাদী হয়ে মামলা করেন।
এ মামলার আসামিরা হলেন সোহেল ইসলাম, মাসুদ সরকার, মশিউর রহমান, জসিম উদ্দীন আকাশ, আলী হোসেন, আবু সাঈদ ফজলে রাব্বি, রাকিবুল হাসান ও মাসুদ আলম মাসুদ।

এখন মামলার ভোগান্তিতে আন্দোলনকারীরা-ফাইল ছবি
এছাড়া সরকারি কাজে বাধা, আক্রমণ ও বলপ্রয়োগের অভিযোগে আরেকটি মামলা করে পুলিশ। এ মামলার আসামিরা হলেন মাজহারুল ইসলাম, রবিন হুসাইন, মাহফুজুর রহমান, জাকারিয়া ও সৈয়দ মোহাম্মদ আমানুল্লাহ।
আরও পড়ুন: শিক্ষক নিয়োগে কোটা সংস্কারের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি
এ বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. জাইদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, প্রকৃত আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ নিরীহ মেধাবী ছাত্ররা বছরের পর আদালতে হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন। মামলার তদন্ত শেষ না হওয়ায় তারা ভালো চাকরিও পাচ্ছেন না। ঘটনার সঠিক তদন্ত করে আদালতে পুলিশ রিপোর্ট দেওয়া হোক। ন্যায়-অন্যায় আদালতের মাধ্যমে প্রমাণিত হবে।
এ বিষয়ে মামলার তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) হুমায়ুন কবীর জাগো নিউজকে বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সময় সংঘাতের মামলাগুলোর তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হলেই আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবো।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে সামনের সারিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ফারুক হাসান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমরা যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলাম তারা হামলা, মামলা, হেনস্তার শিকার হয়েছি। আমাদের সাথে যারা মামলার আসামি হয়েছে তাদের চাকরির পরীক্ষায় পাস করেও শেষ জায়গায় গিয়ে বাদ পড়তে হয়৷ তাদের এ অবস্থা দেখে আমি নিজেও চাকরির পরীক্ষায় অংশ নেইনি।
এদিকে আমার চাকরির বয়সও শেষ হয়ে যাচ্ছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন করার কারণেই আমাদের চাকরি করার যে অধিকারটি ছিল সেটি হারিয়েছি।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত আহ্ববায়ক মো. রাশেদ খান বলেন, চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি ছিল। এ দাবি আদায় করতে আমরা নেতৃত্ব দিয়েছি। যার জন্য আমাদের জেল-জুলুমসহ অসংখ্য নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। চাকরিতে প্রবেশের যে স্বপ্ন ছিল তা বিনষ্ট হয়েছে। আমাদের সাথে যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল বা ছিল তাদের সবারই একই অবস্থা। তারপরও আমরা সুখী এজন্য যে, নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে হলেও শিক্ষার্থীদের দাবি আদায় করতে পেরেছি।
তিনি আরও বলেন, হাজিরা দিতে দিতেই আমাদের জীবনের অনেক সময় চলে যাচ্ছে। আন্দোলনের পাঁচ বছর পরও আমাদের মামলার ঘানি টানতে হচ্ছে। আমাদের যারা বেসরকারি চাকরি বা ছোট ব্যবসা করছে তাদের অবস্থাও খুবই খারাপ৷ আমরা অবিলম্বে এসব মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাই।
জেএ/এএসবিডি/এসএইচএস/জেআইএম