নারীরা কেন পুরুষের সহিংসতার শিকার হন
নারীর প্রতি সহিংসতা — এই বাস্তবতা সভ্যতার শুরু থেকেই নানা রূপে আমাদের সমাজে আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর চেহারা পাল্টালেও কখনও তা বন্ধ হয়নি। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন - এর কারণ কী?
পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোয় নারীকে নিয়ন্ত্রণ, দমন বা শাস্তি দেওয়ার প্রবণতা অনেক ক্ষেত্রেই যেন ‘স্বাভাবিক’ আচরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ফলে সহিংসতা শুধু ব্যক্তিগত সংকট নয়, বরং একটি গভীর সামাজিক অসুখে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিত্রটি আরও উদ্বেগজনক। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, সংসার জীবনে শতকরা ৭২ ভাগ নারী কোনো না কোনো সময়ে স্বামীর হাতে মারাত্মক সহিংসতার শিকার হন। সংখ্যাটি শুধু পরিসংখ্যান নয়, এর পেছনে লুকিয়ে আছে ভয়, নিরব কষ্ট আর দীর্ঘদিনের মানসিক আঘাতের গল্প।
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় — পুরুষেরা কেন নারীর প্রতি সহিংস হয়ে ওঠেন? এটি কি কেবল রাগ, ক্ষমতার লড়াই, নাকি এর পেছনে কাজ করে আরও গভীর মনস্তাত্ত্বিক কারণ? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে জাগো নিউজ কথা বলেছে উত্তরা ফ্যান্টাসি চাইল্ড ডেভেলপমেন্টের কনসালটেন্ট সাইকোলজিস্ট তানজিমা বানু সুমির সঙ্গে।

তার মতে, পুরুষ কর্তৃক নারীর প্রতি সহিংসতার পেছনে ব্যক্তিগত মানসিক গঠন, শৈশবের অভিজ্ঞতা এবং সমাজ থেকে শেখা আচরণ — সবকিছুই মিলিতভাবে কাজ করে। তিনি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে এই মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়াগুলো ধীরে ধীরে সহিংস আচরণকে জন্ম দেয় এবং তা সমাজে টিকে থাকে।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে নারীর ওপর সহিংসতা কেন এখনও এত বেশি?
তানজিমা বানু সুমি: নারীর ওপর সহিংসতা মূলত সমাজে গড়ে ওঠা লিঙ্গবৈষম্য, পুরুষতান্ত্রিক ধারণা এবং শেখানো আচরণের ফল। বহু পুরুষ মনে করে নারীর ওপর কর্তৃত্ব বা নিয়ন্ত্রণ তাদের স্বাভাবিক অধিকার। এই সামাজিক বিশ্বাসগুলো প্রজন্ম ধরে স্থায়ী হয়ে মনস্তাত্ত্বিক বৈধতা তৈরি করে এবং সহিংসতাকে কমবেশি স্বাভাবিক করে তোলে।
জাগো নিউজ: পুরুষের সহিংস আচরণের পেছনে কোন মানসিক ধরন বা আচরণগত বিকৃতি সবচেয়ে বেশি কাজ করে?
তানজিমা বানু সুমি: সহিংস আচরণের পেছনে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ‘কগনিটিভ বিকৃতি’। যেমন — রাগকে শক্তি হিসেবে দেখা, নারীর স্বাধীনতাকে হুমকি মনে করা, বা নিজের নিয়ন্ত্রণকে সম্পর্কের কেন্দ্র মনে করা। এসব বিকৃত বিশ্বাস ব্যক্তির আচরণকে আক্রমণাত্মক করে তোলে।
জাগো নিউজ: শৈশবে সহিংসতা দেখা বা ভিকটিম হওয়া কি পরবর্তী জীবনে সহিংস আচরণের ঝুঁকি বাড়ায়?
তানজিমা বানু সুমি: হ্যাঁ। গবেষণায় দেখা যায়, যেসব শিশু পরিবারে সহিংসতা দেখে বা নিজে ভিকটিম হয়, তারা ভবিষ্যত সম্পর্কেও একই আচরণ অনুকরণ করতে পারে। একে বলা হয় ‘সাইকেল অব ভায়োলেন্স’। শৈশবের অভিজ্ঞতা তাদের মস্তিষ্কে সহিংসতাকে সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে স্থাপন করে।
জাগো নিউজ: সম্পর্কে ক্ষমতার অসমতা কীভাবে নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্র তৈরি করে?
তানজিমা বানু সুমি: যখন সম্পর্কে একজনের সিদ্ধান্ত, সম্পদ ও সামাজিক কর্তৃত্ব বেশি থাকে, তখন নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা বাড়ে। এই অসমতা পুরুষকে শ্রেষ্ঠত্ববোধ দেয় এবং নারীকে অধীনস্থ ভাবতে শেখায়। ফলাফল — মানসিক, শারীরিক বা আর্থিক সহিংসতার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।

জাগো নিউজ: স্ট্রেস, আর্থিক চাপ বা ব্যর্থতা — এসব কি সহিংসতার প্রবণতাকে বাড়িয়ে তোলে, নাকি এগুলো কেবল বাহ্যিক কারণ?
তানজিমা বানু সুমি: এসব কারণ সহিংসতার মূল উৎস নয়, বরং ‘ট্রিগার’। যাদের ভেতরে আগে থেকেই রাগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা, হতাশা বা নেতিবাচক মানসিক ধ্যান রয়েছে — তারা চাপের সময়ে দ্রুত সহিংস আচরণ করতে পারে। তবে সাধারণ মানুষ শুধু চাপের কারণে সহিংস হয়ে ওঠে না।
জাগো নিউজ: টক্সিক ম্যাস্কুলিনিটি বা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা কীভাবে সহিংসতাকে সমাজে স্বাভাবিক বা গ্রহণযোগ্য করে তোলে?
তানজিমা বানু সুমি: টক্সিক ম্যাস্কুলিনিটি পুরুষকে শেখায় — কঠোর হতে হবে, রাগ দেখাতে হবে, নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে এবং দুর্বলতা লুকাতে হবে। এই ধারণা সহিংসতাকে ‘পুরুষত্বের’ অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। ফলে সহিংস আচরণকে পরিবার, সমাজ এমনকি আইনব্যবস্থাও কখনো কখনো গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ হয়।
জাগো নিউজ: নারীরা অনেক সময় সহিংস সম্পর্ক থেকে বের হতে দ্বিধা করেন — এর পেছনে কী মনস্তাত্ত্বিক বা সামাজিক কারণ কাজ করে?
তানজিমা বানু সুমি: ভয়, আর্থিক নির্ভরতা, সামাজিক লজ্জা, সন্তানের ভবিষ্যৎ ভাবনা এবং দীর্ঘদিনের মানসিক নির্যাতনে আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া — সবই নারীদের দূরে সরে যেতে বাধা দেয়। অনেক নারী বিশ্বাস করেন — সে বদলাব, এই আশায় সম্পর্ক ধরে রাখেন।
জাগো নিউজ: পুরুষদের আচরণ পরিবর্তনে কাউন্সেলিং বা মানসিক সহায়তা কতটা কার্যকর হতে পারে?
তানজিমা বানু সুমি: পুরুষদের আচরণ পরিবর্তনে কাউন্সেলিং বা মানসিক সহায়তা খুবই কার্যকর। রাগ নিয়ন্ত্রণ প্রশিক্ষণ, কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি, দাম্পত্য কাউন্সেলিং — এসব থেরাপি অনেক পুরুষকে আচরণগত পরিবর্তনে সহায়তা করে। শেখা ভুল চিন্তাগুলো সংশোধন করা গেলে সহিংসতার পুনরাবৃত্তি কমে যায়।
জাগো নিউজ: নারীর আর্থিক স্বনির্ভরতা কি সহিংসতা কমানোর একটি শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে?
তানজিমা বানু সুমি: অবশ্যই। আর্থিক স্বনির্ভরতা নারীদের আত্মবিশ্বাস, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং নিরাপদ বিকল্প তৈরি করে। অর্থনৈতিক ক্ষমতা নারীদের সহিংস সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে ও নিজের অধিকার দাবি করতে শক্ত ভিত্তি দেয়। ফলে সহিংসতার ঝুঁকিও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে।
এএমপি/জেআইএম