সুখী হওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায়
মনকে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন করে মেডিটেশন, মানুষকে করে সুখী। ছবি: এআই
ডা. দিওয়ান ওয়াসিফ জালাল
একটি ঘর বসবাসের উপযোগী রাখতে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হয়। ঠিক তেমনি মনকে প্রতিদিন পরিচ্ছন্ন করতে হয়। কারণ প্রতিদিন নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যদিয়ে মনের ভেতরে রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা জমতে থাকে। যা পুঞ্জিভূত হয়ে একদিকে রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি করে, অন্যদিকে প্রশান্তি ও সাফল্য অর্জনকে বিঘ্নিত করে। মনকে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন করে মেডিটেশন। মানুষকে করে সুখী। এটিই হয়তো সুখী হওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায়।
মেডিটেশন বা ধ্যান হলো মন ও ব্রেনকে সুপরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহারের একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। একে মনের ব্যায়ামও বলা যায়। বলা যায় মনের যত্ন নেওয়ার একটি প্রক্রিয়া। কারণ একজন মানুষ যেটুকু সময় মেডিটেশন করেন, সেটুকু সময় তিনি নিজের মনের সঙ্গে সুন্দর একটি সময় কাটান। এই সময়ে মনের যত ক্ষত যেমন দুঃখ, হতাশা, অনুশোচনা থাকলে তা সারানোর চেষ্টা চলে, মনে কোনো নেতিবাচক অনুভূতি, যেমন রাগ-ক্ষোভ থাকলে তা পরিষ্কার করেন।
এখনকার যুগযন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে ধ্যান আরও বেশি দরকারি। পণ্য আগ্রাসন ও অসুস্থ প্রতিযোগিতার মুখে আমরা ইদানীং নিজেকে হারাতে বসেছি। ক্রমাগত চাওয়া-পাওয়ার এক নিদ্রাহীন প্রতিযোগিতা আমাদের ক্লান্ত, বিমর্ষ ও হতাশ করে তুলছে। নিজের দিকে তাকাতে আমরা ভুলে গেছি। মেডিটেশন নিজের দিকে তাকাতে, নিজেকে ভালবাসতে ও নিজের প্রতি মনোযোগী হতে শেখায়।

ম্যাথিউ রিকার্ড। লেখকের ওয়েব সাইট থেকে
নেপালি ফরাসি লেখক ম্যাথিউ রিকার্ডের নাম অনেকে শুনে থাকবেন। তার বয়স যখন ৭৫ বছর, তখন তাকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। তিনি নিয়মিত ধ্যান করেন। গবেষণায় দেখা গেছে, ধ্যান বা মেডিটেশনের সময় তার মস্তিষ্কের বাম প্রি-ফ্রন্টাল করটেক্স তৎপর হয়ে ওঠে। এতে অবিশ্বাস্যরকম বাড়ে সুখানুভূতির মাত্রা। তার সুখী জীবনের পেছনে রয়েছে সাড়ে ৩ দশকের মেডিটেশন চর্চা। এটি গবেষকদেরই অভিমত। তার বয়স এখন ৭৯ বছর।
আমাদের দেশের জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত ডা. এম আর খান। বাংলাদেশে শিশুচিকিৎসার সূচনা ও বিকাশে তিনি ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য এক ব্যক্তিত্ব। কোয়ান্টাম মেথড কোর্সের ৩২৮ ব্যাচে পর্যবেক্ষক হিসেবে তিনি অংশ নেন। চার দিন, ৪০ ঘণ্টার পুরোটা সময় তিনি কোর্সে ছিলেন। বছরখানেক পর ৩৪৩তম ব্যাচে তিনি কোর্সটি রিপিট করেন, পুরো চার দিন। কোর্সে অংশ নেওয়া কতটা জরুরি সে প্রসঙ্গে পরে তিনি বললেন, ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানের মানুষ হিসেবে আমি জানি, আমাদের মস্তিষ্কে যে লক্ষ-কোটি নিউরন আছে, তার অধিকাংশই আমরা ব্যবহার করি না। কিন্তু এগুলোকে কীভাবে উজ্জীবিত করতে হয়, কাজে লাগাতে হয়, কোর্সের বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনায় তা বলে দেওয়া হয়।’ এমন সব ব্যক্তিত্বের জীবন ও উদ্ধৃতি সামনে নিয়ে এলে আমরা বুঝতে পারি যে, সুস্থতা, সুখ ও সাফল্যের অধিকারী হওয়ার জন্যে মেডিটেশন কত জরুরি।
মেডিটেশন করলে শতকরা ৭৫ শতাংশ মনোদৈহিক রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন যে-কেউ। কোনো রকম ওষুধ ছাড়াই। কারণ, মন ভালো তো, সব ভালো। আর মেডিটেশন মনকে ভালো রাখে, ফলে শরীরটাও ভালো থাকে। এ জন্য যিনি মেডিটেশন করেন না, তারচেয়ে যিনি মেডিটেশন করেন, তার সুস্থ থাকার ক্ষমতা চার গুণ বেশি।
শুধু সমস্যা থাকলেই মেডিটেশন করতে হবে এমন নয়। বরং সফল মানুষেরা মেডিটেশন করেন। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিল্পপতিরা মেডিটেশন করেন। রাষ্ট্রনায়ক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, প্রশাসকরাও করেন। কেন করেন? প্রশান্তির জন্যে, মস্তিষ্ককে আরো ভালোভাবে বেশি বেশি ব্যবহার করার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রে মেডিটেশন করা মানুষের খাতায় নাম লিখিয়েছেন ফোর্ড মটরসের প্রধান ধনকুবের বিল ফোর্ড, সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর দম্পতি, দেশটির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং হলিউডের নামি-দামি সব শোবিজ তারকা। তাদের তো অর্থ, খ্যাতি, ক্ষমতা কোনো কিছুরই অভাব নেই। তারপরও কেন মেডিটেশন করেন তারা? প্রশান্তির জন্যে। ব্রেনকে আরো সুন্দরভাবে কাজে লাগানোর জন্য, আরো সফল হওয়ার জন্য।
আমাদের দেশেও মেডিটেশন চর্চা এখন বেশ ফলপ্রসূ। ১৯৯৩ সাল থেকে মেডিটেশন কোর্স কোয়ান্টাম মেথডে অংশ নিয়েছেন দেশের বরেণ্য চিকিৎসাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, সমাজতাত্ত্বিক, ধর্মবেত্তা, কবি, লেখক, শিল্পীসহ সফল ব্যবসায়ী, সমাজপতি ও শোবিজ তারকারা। তারাও মেডিটেশন করছেন প্রশান্তির জন্যে, সফল হওয়ার জন্যে। কেননা মেডিটেশন ব্রেনের এমিগডালা অংশের তৎপরতাকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যক্তির আবেগকে সংহত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। কারো কোনো নেতিকথা, নেতি আচরণ, নেতি ঘটনা সেই ধ্যানীর প্রশান্তিকে, আনন্দকে, মনের সুখকে কেড়ে নিতে পারে না। যে কারণে মেডিটেশন চর্চাকারীদের টেনশন করার প্রবণতা কম, রেগে যাওয়া বা ক্ষুব্ধ হওয়ার প্রবণতা কম থাকে। আসলে একজন ধ্যানী যেভাবে নিজের রাগ-ক্ষোভকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তা সত্যিই চমৎকার। ধ্যানীরা প্রো-অ্যাক্ট করেন সবসময়, অর্থাৎ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সর্বোত্তম করণীয় করার চেষ্টা করেন।

জাতীয় অধ্যাপক এম আর খান। ছবি: সংগৃহীত
পবিত্র কোরানে আল্লাহ বলেছেন, (হে নবী!) ওদের বলো, আমি তোমাদের একটি পরামর্শ দিচ্ছি, এককভাবে বা যৌথভাবে আল্লাহর সামনে সচেতন হয়ে দাঁড়াও। নিজের গভীরে ধ্যানে নিমগ্ন হও (৩৪ : ৪৬)। পবিত্র বেদ-এ আছে, যোগ-ধ্যানের মাধ্যমেই আমরা অর্জন করি জ্ঞান, সৌন্দর্য ও ক্ষমতা (যজুর্বেদ ১১.২)। পবিত্র ধম্মপদে আছে, উচ্ছৃঙ্খল ও মূর্খ ব্যক্তির শত বছরের জীবনের চেয়ে প্রাজ্ঞ ও ধ্যানীর একদিনের জীবন উত্তম (সহস্সবগ্গো ১১১)। পবিত্র বাইবেলে আছে, সদাপ্রভুর সন্তুষ্টির উদ্দেশে যখন আমি ধ্যানমগ্ন হই, তখন আমি মহানন্দে বিরাজ করি (গীতসংহিতা ১০৪ : ৩৪)।
এ জন্যেই মেডিটেশন করতে হবে প্রতিদিন। দুবেলা করতে পারলে বেশ ভালো। তা না পারলে দিনে অন্তত একবার। বিশেষ করে সকালে ঘুম ভাঙার পর, দিনের কাজ শুরুর আগে। তখন মনকে কথা শোনানোটা সুন্দর হয়। একটি নতুন দিন যে আমরা পেয়েছি প্রভুর কাছ থেকে, তা সুন্দরভাবে কাজে লাগানোর জন্যেই এই মেডিটেশন চর্চা। মেডিটেশনে মনের বাড়িতে গিয়ে সকালে কী কাজ করব, কার সাথে দেখা করব, কোন কাজ কতটুকু এগিয়ে নেবো, কাকে ফোন করব, কার সঙ্গে কী কথা সেরে নেবো, ইত্যাদির একটি ছক বা কাজের তালিকা করে ফেলতে পারি। একইভাবে দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা ও রাতের পরিকল্পনাও করে ফেলার সুযোগ পাই মেডিটেশনে। এতে কী হয়? কাজগুলো নিয়ে মনে মনে চিন্তা করতে করতে আমরা মানসিকভাবে কাজের সাথে একাত্ম হয়ে যাই। তারপর বাস্তবে যখন কাজগুলো করতে যাই, তখন দেখা যায়, কাজে মনোযোগ বেড়ে গেছে, কাজের প্রতি টান বাড়ছে। কাজটা শেষ পর্যন্ত সুন্দরভাবে করা যাচ্ছে।
মেডিটেশন চর্চায় পড়াশোনা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারছেন শিক্ষার্থীরা। অনেকেই নামাজে মনোযোগ বাড়াতে পারছেন। নামাজ পড়ে তৃপ্তি পেয়েছেন এমন অনুভূতির কথাও জানিয়েছেন অনেকে। কেউ যদি দিনে দুবেলা আধঘণ্টা করেন মেডিটেশন করেন, তাহলে তিনি দিনের ২৩ ঘণ্টাকে আরো সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে পারবেন। শিশু থেকে শুরু করে ৮০ বছর বয়সী, যে কেউ মেডিটেশন করে উপকৃত হতে পারেন। মেডিটেশনে সময় ব্যয় করা হচ্ছে ফলপ্রসূ সময় ব্যয়। কেননা মেডিটেশন মনের জট খুলতে সাহায্য করে। করণীয় বুঝতে সহজ হয়। বিশ্বাসের সাথে নিজের কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারেন। নিয়মিত ধ্যানচর্চার ফলে একজন মানুষ হয়ে উঠতে পারেন ভালো মা-বাবা, ভালো স্বামী-স্ত্রী, ভালো ভাই-বোন, ভালো বন্ধু, ভালো সন্তান, সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ।
আধুনিক বিশ্বও এখন ঝুঁকছে মেডিটেশনের দিকে। জাতিসঙ্ঘ ২১ ডিসেম্বরকে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস ঘোষণা করেছে। মেডিটেশন এবং এর উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। সবাইকে মেডিটেশন দিবসের শুভেচ্ছা।
লেখক : ফিজিশিয়ান অ্যান্ড হেলথ কাউন্সেলর, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশেন
আরএমডি/জেআইএম