ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

বই নিয়ে কথোপকথন

শহরের জলজ ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার মর্মান্তিক প্রতিচ্ছবি: হেলিমুল আলম

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০২:৫৬ পিএম, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫

ঢাকা একসময় ছিল খাল, পুকুর ও নদীর শহর—জলের এক জীবন্ত নেটওয়ার্ক, যা পরিবেশ ও সংস্কৃতিকে একসূত্রে বেঁধে রাখতো। আজ সেই নেটওয়ার্ক দ্রুত বিলীন হয়ে যাচ্ছে—দখলদারি ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের চাপে সংকুচিত হয়ে পড়ছে তার অস্তিত্ব। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিক ও লেখক মোহাম্মদ হেলিমুল আলম এই ক্ষয়ক্ষতির ইতিহাস নথিবদ্ধ করে আসছেন। ঢাকার পুকুর নিয়ে একটি এবং খাল নিয়ে আরেকটি—এই দুটি গবেষণাধর্মী বই শহরের পরিবেশ ও নগর ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে উঠেছে। একান্ত সাক্ষাৎকারে জাগো নিউজের সঙ্গে তিনি কথা বলেন তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের সূচনা, শৈশবের ঢাকা ও জলপথের স্মৃতি, এবং সেসব সংরক্ষণের জন্য তাঁর অটল অঙ্গীকার নিয়ে।

জাগো নিউজ: আপনি ঢাকার হারিয়ে যাওয়া জলপথ নিয়ে দীর্ঘদিন লিখছেন। শহরটা একসময় কেমন ছিল?
আলম: আমি বড় হয়েছি মিরপুর সেকশন-১২ এলাকায়। তখনকার ঢাকা আজকের চেয়ে একদমই আলাদা ছিল—খোলা জায়গা, খেলার মাঠ আর চারপাশে অসংখ্য পুকুর। আমি সাঁতার শিখেছিলাম হারুন চেয়ারম্যানের পুকুরে। আমাদের আশেপাশে অন্তত চারটি পুকুর ছিল, যেখানে আমরা প্রায়ই সময় কাটাতাম সাঁতার কেটে আর মাছ ধরে।

আমার স্কুল এমডিসি মডেল ইনস্টিটিউটের সামনে ছিল একটি বিশাল আকারের পুকুর। সেখানে আমি পানির নিচে ডুব দিয়ে ছোট ছোট ঝিনুক তুলতাম, অনেক সময় মুক্তা খোঁজার চেষ্টাও করতাম—যদিও কখনো পাইনি। তবু সেই খোঁজাখুঁজি ছিল ভীষণ আনন্দের।

আজও চোখে ভাসে সেই দৃশ্য—যেদিন পুকুরটি ভরাট করা হচ্ছিল; সেদিন হাজারেরও বেশি মানুষ নেমে পড়েছিল মাছ ধরতে। বড় বড় রুই, কাতলা, মৃগেল—সব রকম মাছ ধরা পড়েছিল। সেই মুহূর্তগুলো এখনো স্মৃতিতে গেঁথে আছে। পুকুর আর খাল তখন শুধু জলাধার ছিল না—ওগুলো ছিল সমাজজীবনের কেন্দ্রবিন্দু। এগুলো পরিবেশকে শীতল রাখতো, মাটিকে সজীব করতো, আর আশেপাশের মানুষের জীবনধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো।

জাগো নিউজ: আর এখন?
আলম: দুঃখজনকভাবে, সেই পুকুরগুলোর আর কোনো অস্তিত্ব নেই—অপরিকল্পিত নগরায়ণের পেটে একে একে সবই বিলীন হয়ে গেছে। এমডিসি মডেল ইনস্টিটিউটের পাশের যে পুকুরটি একসময় প্রাণে ভরা ছিল, আজ তা বাড়িঘরের নিচে চাপা পড়ে আছে। হারুন চেয়ারম্যানের পুকুরটির জায়গায় এখন গড়ে উঠেছে একটি ব্যস্ত বাজার। এটি শুধু আমার ব্যক্তিগত স্মৃতির ক্ষয় নয়—এটি গোটা শহরের জলজ ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার এক মর্মান্তিক প্রতিচ্ছবি।

জাগো নিউজ: এই ক্ষতি কতটা ব্যাপক?
আলম: ২০০৩ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের ২৮টি ওয়ার্ডে প্রায় ৬৫টি পুকুরসহ আরও বহু জলাধার শনাক্ত করা হয়েছিল। আমি নিজে প্রতিটি স্থানে গিয়েছি, স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। আজ অনেক পুকুর সম্পূর্ণ হারিয়ে গেছে, আর যেগুলো টিকে আছে সেগুলোর বেশিরভাগই আবর্জনায় ভরা, উপেক্ষিত—বা ‘ফাঁকা জমি’ হিসেবে বিবেচিত, যেন ভরাটের অপেক্ষায়।

২০২২ সালের ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ডিএপি) অনুযায়ী, রাজউকের আওতাধীন ১,৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৩,৪৬৪টি পুকুরের অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে—এর মধ্যে প্রায় ২০০টি কেন্দ্রীয় ঢাকায়। কিন্তু মাঠপর্যায়ের গবেষণায় দেখা যায়, অনেকগুলোই ইতোমধ্যে দখল বা ভরাট হয়ে গেছে।

জাগো নিউজ: এসব পুকুর ও খাল এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?
আলম: এটি কেবল পরিবেশগত বিষয় নয়, এটি নগরজীবনের মৌলিক নিরাপত্তার সঙ্গেও জড়িত। পুকুর হলো প্রাকৃতিক জলাধার—বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, ভূগর্ভস্থ পানির পুনঃসঞ্চয়, বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং অগ্নিনির্বাপণে জরুরি পানির উৎস হিসেবে এদের ভূমিকা অপরিসীম। জলাশয়গুলো হারিয়ে যাওয়ার ফলে ঢাকায় জলাবদ্ধতা, বন্যা ও তাপমাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে—যা বিশেষ করে বর্ষাকালে তীব্রভাবে অনুভূত হয়।

জাগো নিউজ: আপনি এই বিষয় নিয়ে দুটি বই লিখেছেন। সেগুলো সম্পর্কে কিছু বলবেন?
আলম: ঢাকার পুকুর নিয়ে আমার বই ‘Oasis Lost to Urban Sprawl: An In-Depth Look into Dhaka’s Lost Ponds’ মূলত শহরের হারিয়ে যাওয়া জলাধারগুলোর একটি প্রামাণ্য দলিল। এটি ২০১৭ সালে দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ভিত্তিতে লেখা। নগর করপোরেশনের মানচিত্র অনুসারে আমি অন্তত ১০০টি পুকুরের স্থানে গিয়ে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করেছি। পরে আরও গবেষণা ও নথিপত্র যুক্ত করে ২০২৩ সালে বইটি প্রকাশ করি। স্থানীয় প্রবীণদের কাছ থেকে পাওয়া বহু স্মৃতি ও গল্প এতে সংযোজন করা হয়েছে।

আমার আরেকটি বই ‘Dhaka’s Canals on Their Dying Breath: An In-Depth Look at How the Capital’s Waterways Are Being Choked’ ঢাকার খালগুলো নিয়ে লেখা। এটি মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধান, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের ধারাবাহিক রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়েছে। একসময় ঢাকায় নৌকা চলতো, মানুষ জলপথে যাতায়াত করতো—আর আজ সেই খালগুলোর অনেকটাই নর্দমায় পরিণত হয়েছে।

আরও পড়ুন
আমি আমার মতো করে চলেছি: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় 
কট্টর সমালোচকই লেখকের প্রকৃত বন্ধু: ইলিয়াস ফারুকী 

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) ২০২২ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, ১৮৮০ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে প্রণীত ক্যাডাস্ট্রাল জরিপ মানচিত্রে ঢাকায় ১৭৫টি খাল, লেক ও চ্যানেল চিহ্নিত ছিল। গত ৮০ বছরে এর মধ্যে ৮০টি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে, ১৫টি সংকুচিত হয়েছে। বর্তমানে টিকে আছে প্রায় ৭১টি খাল।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৫ সালে ঢাকার কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ২০.৫৭ শতাংশ এলাকা জলাশয় ছিল, যা ২০২৩ সালে নেমে এসেছে মাত্র ২.৯ শতাংশে। দখল, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবই এই বিপর্যয়ের প্রধান কারণ। সরকারি ভুল পরিকল্পনায় বহু খাল ধ্বংস হয়েছে—বক্স কালভার্টের নিচে অন্তত ১০টি খাল চাপা পড়েছে, ওয়াসার পাড় বাঁধাই প্রকল্পে আরও প্রায় ১৩টি খাল সংকুচিত হয়েছে এবং পশ্চিমের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ শহরের চারপাশের নদীর সঙ্গে খালগুলোর স্বাভাবিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে।

আমার বইয়ে এসব নীতিগত ভুল তুলে ধরা হয়েছে। সেই সঙ্গে বেঁচে থাকা প্রায় ৭০টি খালের বিস্তারিত বিবরণ, মানচিত্র ও চিত্র সংযোজন করা হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, সচেতনতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এখনো অনেক খাল ও পুকুর পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব।

জাগো নিউজ: অন্য শহরগুলো থেকে শেখার কিছু আছে কি?
আলম: সিউল, সিঙ্গাপুর ও টোকিওর মতো শহরগুলো মাটিচাপা পড়া জলপথ পুনরুজ্জীবিত করে নগরের সহনশীলতা, জীববৈচিত্র্য ও সামগ্রিক জীবনমান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করেছে। ঢাকাও একই পথ অনুসরণ করতে পারে—যদি সময়মতো সিদ্ধান্ত নেয় এবং দূরদর্শী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।

খাল ও পুকুর পুনরুদ্ধার শুধু একটি পরিবেশগত উদ্যোগ নয়, এটি এক ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনও। এর মাধ্যমে আরও শীতল ও সবুজ পাড়া-মহল্লা গড়ে উঠবে, জলাবদ্ধতা কমবে এবং এমন জনপরিসর ফিরে আসবে; যেখানে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে এবং একে অপরের সঙ্গে নতুনভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে।

জাগো নিউজ: বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনার সবচেয়ে বড় উদ্বেগ কী?
আলম: সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ। একসময় খালগুলো ঢাকার প্রাকৃতিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতো। সেগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার পর জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সাংস্কৃতিকভাবে আমরা জলাশয়ের গুরুত্বও ভুলে গেছি। পুকুর ছিল সামাজিক কেন্দ্র, খাল ছিল মানুষের চলাচলের পথ। এখন মানুষ এগুলোকে কেবল জমি হিসেবে দেখছে। এই মানসিকতার পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি।

জাগো নিউজ: ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় অর্জন কী?
আলম: আমার কাছে সবচেয়ে বড় অর্জন হলো মানুষের ভালোবাসা। একবার একটি হাউজিং কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলাম, যারা কিছু পরিবারের চলাচলের পথ দেওয়াল তুলে বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রতিবেদন প্রকাশের পরদিনই কোম্পানিটি দেওয়াল ভেঙে দেয়। পরে এলাকার মানুষ আমাকে লিখিতভাবে ধন্যবাদ জানান—সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, সাংবাদিকতা সত্যিই সার্থক।

অবশ্য, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিগুলোও আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। এ পর্যন্ত ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি থেকে পাঁচবার বেস্ট রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি, পাঁচটি পৃথক সিরিজ প্রতিবেদনের জন্য—এর মধ্যে একটি ছিল মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক। এ ছাড়া ওয়াটার রিপোর্টার্স ফোরাম বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সামাজিক সংগঠন টাচিং সোলস ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকেও একটি ফেলোশিপ পেয়েছি।

তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমার কাছে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অর্জন হলো ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩। আমার প্রথম বইয়ের জন্য গবেষণা বিভাগে পুরস্কারটি পেয়ে আমি লেখক হিসেবে নিজের অস্তিত্বের স্বীকৃতি অনুভব করেছি। এটি আমার জীবনের এক বিশেষ মাইলফলক।

জাগো নিউজ: ঢাকার বাসিন্দাদের জন্য আপনার বার্তা কী?
আলম: আমি চাই মানুষ পুকুর ও খালকে শুধুই অতীতের অংশ হিসেবে না দেখে ভবিষ্যতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখুক। জলবায়ু পরিবর্তন, পানির সংকট, নগরের জলাবদ্ধতা—এসব সমস্যার সমাধানে প্রাকৃতিক জলাশয় অপরিহার্য। সবচেয়ে বড় কথা, উন্নয়ন মানে শুধু সড়ক বা ভবন নয়; এটি টেকসই পরিবেশ ও সংস্কৃতির সংরক্ষণও। আমার লেখার মাধ্যমে যদি মানুষ এই উপলব্ধি পায়, তবে আমি সফল। একটি পুকুর বা খাল শুধু পানি নয়—এটি স্মৃতি, সমাজ এবং টিকে থাকার শক্তি। আমরা যদি এগুলো হারাই, তবে নিজেদেরও একটি অংশ হারাবো।

এসইউ

আরও পড়ুন