কট্টর সমালোচকই লেখকের প্রকৃত বন্ধু: ইলিয়াস ফারুকী

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:৪৬ পিএম, ২৫ জুলাই ২০২৫

ইলিয়াস ফারুকী একজন কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সংগঠক। তিনি ১৯৫৯ সালে চাঁদপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ‘জিগীষা’ সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদের সভাপতি এবং জাতীয় দৈনিক একুশের বাণী পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার সাহিত্যচর্চা এবং সমকালীন সাহিত্য আন্দোলন নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি ও গল্পকার আশিক বিন রহিম

জাগো নিউজ: আপনার সাহিত্যচর্চার শুরুর দিকের কথা জানতে চাই। কীভাবে লেখালেখির জার্নিটা শুরু হলো?
ইলিয়াস ফারুকী: ছোটবেলা থেকেই অর্থাৎ যখন ২য় শ্রেণির ছাত্র; তখনকার সময় জনপ্রিয় কমিক টারজেন খুব পড়তাম। পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় কীভাবে যেন আমার হাতে রোমানা আফাজের ‘দস্যু বনহুর’ বইটি চলে এলো। বইটি পড়া শুরু করতেই ওটার সাথে মজে গেলাম। শুরু হলো দস্যু বনহুর সিরিজ পড়া। তখনই ‘দস্যু ফয়েজ রাজা’ নামে আরও একটি সিরিজ বই প্রকাশ হওয়া শুরু হলো। ওটাও পড়া শুরু করলাম। একই সাথে পরিচিত হলাম নিহাররঞ্জনের কিরিটি, সেবার কুয়াশা, তিন গোয়েন্দা এবং একবারে চলে এলাম মাসুদ রানায়। আমি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। জীবনের প্রথম উপন্যাস ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের ‘শাপমোচন’ পড়লাম। ১৯৭১ সালের মার্চ কিংবা এপ্রিলে হঠাৎ একদিন নিজের মতো করে কাঁচা হাতে ১৫-২০ লাইনের রহস্য গল্প লিখে বড় বোনকে দেখালাম। তিনি উৎসাহিত করলেন। কিন্তু পরে আর লেখা হলো না।

বিজ্ঞাপন

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর টুকটাক লেখা চলতে থাকলো। কিন্তু ১৯৭৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর। তখন ‘দেশ বাংলা’ নামে ঢাকা থেকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতো। তারা একটি শিশুসাহিত্যের পাতা বের করতো। তো একদিন দেখলাম তারা শীত নিয়ে ছড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছেন। সুতরাং আমিও দুটো ছড়া লিখে ফেললাম, ‘শীত আসলো ভীষণ/ নিয়ে ধনীর ফ্যাশান/ গরীব মরে শীতের জ্বালায়/ হাড় কাঁপুনিতে জীবন যায়/ (তোর কী) নেই একটু মায়া,/ ঐ গরীবের তরে/ তোর প্রকোপে কেন ওরাই শুধু মরে।’ এবং ‘হায়রে ভীষণ শীত/ এই বুঝি তোর রীত/ গরিব ছাড়া অন্য লোকে,/ পড়ে না কেন তোর চোখে?/ রাজ প্রাসাদে তুই বিকার!/ কুড়ে ঘরই কি তোর শিকার।’ (সেই সময়কার পাণ্ডুলিপি থেকে সংগ্রহ) সেই থেকে শুরু, চলছে এখনো। তবে একটি পরিবর্তন হয়েছে। তখন ইলিয়াস পারভেজ নামে লিখতাম; এখন লিখি ইলিয়াস ফারুকী নামে।

জাগো নিউজ: লেখক ও পাঠক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত?
ইলিয়াস ফারুকী: লেখক-পাঠক সম্পর্ক হওয়া উচিত হৃদয়বান কসাইয়ের মতো। অর্থাৎ কসাই পেশার কারণে জবাই করেন কিন্তু চোখে থাকে মায়ার অশ্রু। পাঠকও তেমনই হওয়া উচিত। পাঠক লেখককে তার লেখার কারণেই ভালোবাসবে তা ঠিক, কিন্তু সমালোচনার সময় হবে কসাইয়ের মতো। তবেই লেখকের উৎকৃষ্টতার বৃদ্ধি ঘটবে। যদিও অনেক লেখকই সমালোচনা নিতে পারেন না। আমার বিশ্বাস কট্টর সমালোচকই লেখকের প্রকৃত বন্ধু।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন

জাগো নিউজ: আপনার প্রকাশিত বই কয়টি? প্রথম বই কবে প্রকাশিত হয়েছিল? কেমন অনুভূতি ছিল?
ইলিয়াস ফারুকী: এ পর্যন্ত আমার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পনেরোটি। প্রথম বই প্রকাশের কথা ছিল ১৯৮৪ সালে। সেভাবেই প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু হঠাৎ এক বন্ধু পরামর্শ দিলো। এত দ্রুত যেন বই প্রকাশ না করি। আরও পরিপক্ব হয়ে যেন বই প্রকাশে হাত দিই। কারণ প্রথম প্রকাশনা দুর্বল হলে পরে পস্তাতে হবে। যুক্তিটা আমার মনে ধরলো। তখনই পাণ্ডুলিপি তুলে রাখলাম। এরপর কর্মজীবনে প্রবেশ করে আর বই প্রকাশ করা হলো না। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানো। মান ভালো না-ও হতে পারে—এই ভয়ে যে পাণ্ডুলিপি তুলে রেখেছিলাম; সেই পাণ্ডুলিপি দিয়েই ২০১৬ সালে আমার প্রথম বই, মানে প্রথম কবিতার বই ‘আরশি’ প্রকাশিত হলো। আর অনুভূতির কথা বলছো! বাবা-মার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে বাসর রাতে প্রথমবারের মতো ঘোমটা তুললে যেমন বুকের মাঝে হাতুড়ির আঘাতের মতো হৃৎপিণ্ড কাঁপে, ছাপাখানা থেকে আসা প্রথম বই হাতে নিয়ে আমার অনুভূতি ছিল ঠিক তেমনটাই।

জাগো নিউজ: লেখকের কি সামাজিক দায় থাকে? আপনি কীভাবে সে দায় পূরণ করেন?
ইলিয়াস ফারুকী: লেখকের সামাজিক দায়িত্ব সবার চেয়ে বেশি। লেখকদের উপলব্ধির স্পর্শকাতরতা অনেক প্রখর। সমাজের অঘটনের প্রথম প্রতিবাদ আসে কলম থেকেই। এই যেমন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ নিয়ে উদ্যোগ, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। রবিঠাকুরের ‘মুসলমানি’ গল্প। এসব সামাজিক দায়িত্ব থেকেই উঠে আসা।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

জাগো নিউজ: চাঁদপুরের সাহিত্যচর্চাকে কীভাবে দেখেন?
ইলিয়াস ফারুকী: চাঁদপুরের সাহিত্যচর্চা কিংবদন্তিতুল্য। তুমি নিজেই দেখো সেই মধ্য যুগের কবি দোনা গাজী, যাযাবর থেকে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, বিখ্যাত দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ, মুনতাসীর মামুন, ড. রফিকুল ইসলাম, শঙ্খ ঘোষ, বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম কিংবা এখনো এ প্রজন্মের ফরিদ, মানিক, আশিক, রণি এবং আরও অনেক। চাঁদপুর সাহিত্যের এক উর্বর ভূমি ছিল, আছে এবং থাকবে।

জাগো নিউজ: বাঙালির মাঝে সামগ্রিকভাবে শুদ্ধ বাংলা লেখার চর্চাটা করা যায় কীভাবে?
ইলিয়াস ফারুকী: বাংলা ভাষাকে বলা হয় পৃথিবীর কঠিনতম সুন্দর ভাষা। বাংলা ভাষার বর্ণমালা দেখলেই বোঝা যায় বানানে কেন এত ভুল। এ ছাড়া আমাদের ভাষাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানও এর জন্য কিছুটা দায়ী। আবার সামগ্রিকভাবে ইংরেজির প্রতি প্রেমও এর জন্য দায়ী। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমি মনে করি, প্রথম শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি বাঙালি ছাত্রের জন্য বাংলা পাঠ আবশ্যিক হওয়া উচিত।

জাগো নিউজ: লেখক জীবনের প্রাপ্তির কথা বলুন—
ইলিয়াস ফারুকী: আমি বাংলা ভাষার একজন সৈনিক। নিজেকে বাঙালি বলতে ভালোবাসি। পৃথিবীর যে কোনো দেশে বাংলা বলতে সামান্যতম লজ্জাবোধ কিংবা দ্বিধাবোধ থাকে না। এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী থাকতে পারে?

বিজ্ঞাপন

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।