গোলাম রববানীর তিনটি একুশের কবিতা
একুশের গান প্রথম সেই কবিতা
ওরে ফাগুন আমের মুকুল বহে দখিন হাওয়া;
ওরে ফাগুন কাঞ্চন শিমুল লাল গোলাপের মায়া।
ফাগুন ওড়ে নরম খোঁপায় হরেক রকম ফুল,
ফাগুন নাচে নবীন বুকে ফাগুন পাখির বোল।
ওরে ফাগুন মরণ আগুন চল্লিশ অধিক রত্ন,
বর্ণমালা রক্তিম আজও সুন্দর রব বিষণ্ন!
ফাগুন মানে নগ্নদেহ ঝরা পাতার কাঁপন,
একুশ তারিখ ফেব্রুয়ারির এসো করি যতন।
ফাগুন এলে চোখে পড়ে ভুল বানানের দৃষ্টি,
ফেব্রুয়ারি, শহীদ মিনার, বাংলা মায়ের সৃষ্টি!
ফাগুন মানে মায়ের ভাষা আমার বাংলা ভাষা
ফুলের মতো পবিত্র মা অনন্তকাল আশা।
ফাগুন মানে মায়ের ছেলে—ছেলের মায়ের কান্না,
চল গাই আজ একুশের গান প্রথম সেই কবিতা...
****
বাংলা ভাষা কণ্ঠে এলে
বাংলা ভাষা কণ্ঠে এলে মন কেমনের দিনে—
ফাগুন হাওয়ায় উড়তে থাকে গন্ধে সারা গায়ে।
বাংলা ভাষা কণ্ঠে এলে নীরব থাকা একরাত্রি
একটা প্রদীপ জ্যোৎস্না জ্বালে—দোলে সিন্ধু নদী!
বাংলা ভাষা কণ্ঠে এলে নবজাতক আগামী—
দুখিনী এই বর্ণমালার ঠোঁটে চুম্বন মারে!
প্রসব করে কথামালায় নতুন নতুন বিদ্যার্থী;
বনায়ন আর নগরায়ণ—ফুল ফুটে আর ঝরে।
বাংলা ভাষা কণ্ঠে এলে বাঙ্গাল বাংলা গানে
লাল সবুজের কেতন যদ্দুর—যেন ঠিকই এদ্দুর
বাতাসের বুক একবুক সমান ভালোবাসায় নাচে
চোখে নাচে বসন্তকাল ফেব্রুয়ারি সত্তা তার।
বাংলা ভাষা কণ্ঠে এলে বিষাদের সুর ওঠে
কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে রক্তে রঞ্জিত পথ ভাসে
ছড়ায় জুড়ায় ঘুমের জগত ছোট্ট শিশুর চোখে
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ প্রভাতফেরির ভোরে।
বাংলা ভাষা কণ্ঠে এলে কণ্ঠস্বর যে কাঁপে
তবু আজও বাংলা ভাষা নির্মম আহত খুব যে—
কবে পাবে মুক্তি অসীম দগদগে ঘা যে;
ভাষায় ত্রাসন ভাষায় শাষণ মুক্তি পাবে কবে?
****
একুশের কবিতা
একুশ শব্দটি সেই থেকে আমাদের চেতনার ফুল,
সেদিন ফাগুন ছিল—রমনা, কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে
লালে লালে আগুন রঙা লগন ছিল—ফেব্রুয়ারির
বাতাসজুড়ে হাওয়া ছিল তপ্ত, রাজপথে লেগেছিল রক্ত।
জীবনের কোনো মানে নেই—তবু বলীয়ান হয়ে—
না শোকে, না ক্রোধে—তেজোদীপ্ত রক্তফোঁটা আহ্বানে
ধ্যানমগ্ন আগুনের ফুলকির মতো প্রতিজ্ঞাবাক্যে
ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সোনার ছেলে সেই উদ্দামতা নিয়ে
সেদিন অপেক্ষার প্রহর ছিল, প্রতীক্ষার অসমাপ্ত গল্প
চিরতরে দরজা জানালা বন্ধ হ’য়ে হলো অন্ধ—
অন্ধকারের ঘরে নিত্যনতুন চোখে আলো জ্বেলে
শিক্ষার আলো নিয়ে একুশের উঠোন পেরিয়ে আজ—
মাকে মা বলতে পারি, আব্বাকে আব্বা ডাকতে পারি
সেদিন মায়া-মমতা দূরে ঠেলে, পাষাণভেদী হৃদয়ে
প্রেম-ভালবাসা, অকালসন্ধ্যা স্বাগত জানিয়েই—
শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি-ইতিহাস—বাংলা মায়ের ভাষা!
জবজবে ছোপে বুলেট ঝাঁঝরা টাটকা রক্তের দাগে
আজ বাংলা কবিতা বিশ্ব কবিতার বিশ্বমঞ্চে
মর্যাদার আসনে আমাদের ঐতিহ্য ধারণ পারে
সাহিত্য ও কবিতার জন্য—কোলখালি মায়েদের জন্যে
সুখের দিনের দুঃখের বিষয় বাতাসের নাকে নাকে
বন্ধ হয়ে আসে নিশ্বাস প্রশ্বাস মাতৃভাষার এই
দুর্দিনে—বাংলা ভাষার এই করুণ হাহাকারে
ভাষার সেই নির্বাসন যেন আজ নবনির্বাসনে ফিরে!
স্বদেশের ভাষা যেন গিলে বিদেশি ভাষার ক্ষুধার্তে
বিদেশি ভাষা কেন বাংলা ভাষার এই শক্ত অবস্থানে!
এসইউ/জিকেএস