ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

পঙ্কজ শীলের গল্প: পাতার শহর

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:২৭ পিএম, ১৫ নভেম্বর ২০২৫

শহরটাকে প্রথম দেখেছিলাম এক শরতের বিকেলে। বাতাসে তখন ঝরাপাতার গন্ধ, চারপাশে হলুদ, বাদামি, লাল, সবুজ—অসংখ্য রঙের মিশেল। যেন রঙের চাদরে ঢাকা একটা নিঃশব্দ নগরী, যেখানে মানুষ আছে, কিন্তু মানুষ নেই; শব্দ আছে, কিন্তু তার উৎস নেই। শহরের প্রতিটি রাস্তায় স্তরে স্তরে পড়ে আছে শুকনো পাতা, ঘরের বারান্দা থেকে শুরু করে টেলিফোন লাইনের তার পর্যন্ত পাতায় ভরে গেছে। কেউ ঝাড়ে না, কেউ তুলে নেয় না। মানুষজন এ শহরে হেঁটে চলে নরম পাতার ওপর দিয়ে—শব্দহীনভাবে। এই নিঃশব্দতা থেকেই যেন শহরটির নাম হয়ে গেছে—পাতার শহর। আমি এখানে এসেছিলাম একদম হঠাৎ, ঠিক জানতাম না কেন এসেছি। হয়তো পালাতে চেয়েছিলাম নিজের ভেতরের কোলাহল থেকে, হয়তো খুঁজছিলাম নিঃশব্দ আশ্রয়। কিন্তু এই শহরে এসে বুঝলাম, নীরবতা আসলে যতটা শান্ত দেখায়, ভেতরে ততটাই ভারী। এখানে প্রতিটি নীরবতা নিজের ভেতরে হাজার গল্প জমিয়ে রাখে, প্রতিটি পাতা কোনো একদিনের ইতিহাস।

শহরের প্রবেশমুখে একটা পুরোনো ফলক—তাতে ম্লান অক্ষরে লেখা: ‘যে কথা হারিয়েছে, সে এখানে ফিরে আসবে’। প্রথমে ভেবেছিলাম, হয়তো কোনো পর্যটন স্লোগান, পরে বুঝলাম এটা আসলে একটা ভবিষ্যদ্বাণী। পাতার শহরে আসা মানে নিজের হারানো কথাগুলো খুঁজে পাওয়া, নিজের ভেতরের ভুলে যাওয়া মানুষটাকে চিনে ফেলা। শহরের প্রতিটি পাতা একেকটা স্মৃতির অংশ। কেউ কেউ বলে, এই শহরের পাতাগুলো নাকি মানুষের হারানো অনুভূতির প্রতীক। কারো ভালোবাসা, কারো অনুতাপ, কারো অপূর্ণতা—সবকিছুই নাকি এসে জমা হয় এই শহরের গাছে, তারপর একদিন পাতা হয়ে ঝরে পড়ে রাস্তায়। আমি প্রথমে বিশ্বাস করিনি, কিন্তু যখন আমার নিজের চারপাশে অদ্ভুত কিছু ঘটতে শুরু করল, তখন সব ব্যাখ্যা একে একে ভেঙে গেল।

প্রথম দিনেই দেখেছিলাম এক মেয়েকে—সাদা পোশাক, কাঁধে হালকা সবুজ ওড়না, চুলে ছায়া-ছায়া আলো। সে দাঁড়িয়ে ছিল এক পুরোনো গাছের নিচে, যেটার পাতা অন্যসব গাছের থেকে আলাদা—পাতাগুলো যেন ঝরে পড়ে না, শুধু রং বদলায়, ঘন সবুজ থেকে রক্তাভে, তারপর সোনালি হয়ে আবার সবুজ। মেয়েটি তাকিয়ে ছিল গাছটার দিকে, চোখে একধরনের মায়া আর দুঃখের মিশেল। আমি কাছে যেতেই সে বলল, ‘এই গাছটা আমার কথা মনে রাখে।’ আমি কিছু বলার আগেই সে মুচকি হেসে চলে গেল, পায়ের নিচের পাতাগুলো তার পদক্ষেপে হালকা শব্দ তুলল, তারপর আবার নীরবতা। আমি অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম গাছটার দিকে, ভাবছিলাম—মানুষের কথাও কি কখনো গাছে রয়ে যায়?

সেদিন রাতে আমি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্বপ্নে দেখি শহরের সব মানুষ একসাথে দাঁড়িয়ে আছে পাতার সমুদ্রে, আর প্রতিটি মানুষ নিজের হাতে একটা করে শুকনো পাতা ধরে আছে। হঠাৎ বাতাসে একটা শব্দ ভেসে আসে—যেন কারো কান্না, কারো হাসি, কারো নাম ধরে ডাকা। আমি বুঝতে পারছিলাম, প্রতিটি পাতা একেকটা কণ্ঠস্বর হয়ে উঠছে, প্রতিটি কণ্ঠস্বর কারো হারানো কথা। সকালে ঘুম ভাঙার পর দেখি আমার বিছানার পাশে একটা পাতা পড়ে আছে—ঠিক যেমনটা স্বপ্নে দেখেছিলাম। তাতে হালকা অক্ষরে লেখা, ‘তুমি কি তোমার কথা খুঁজে পেয়েছো?’ আমি ভয় পাইনি বরং একটা অজানা শান্তি অনুভব করলাম।

শহরের মানুষরা খুব কম কথা বলে। তাদের চোখে একরকম ক্লান্তি, আবার শান্তিও আছে। সবাই যেন অপেক্ষা করছে কিছু একটা ঘটার। এখানে সময় চলে খুব ধীরে, ঘড়ির কাঁটা ঘোরে, কিন্তু তার শব্দ শোনা যায় না। কেউ হাসলে সেটাও যেন নিঃশব্দে ঘটে। একদিন এক বৃদ্ধ বলেছিলেন, ‘এই শহর কথা শোনে না, শুধু অনুভব করে।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে মানুষ কথা বলে কেন?’ তিনি হেসে বললেন, ‘আমরা কথা বলি যেন পাতাগুলো শুনে নিতে পারে, তারপর একদিন হয়তো ঝরে গিয়ে অন্য কারো কানে পৌঁছে দেবে।’ আমি বুঝলাম, এখানে কথা কোনো এক মানুষের নয়, এটা এক চিরস্থায়ী আদান-প্রদান—যা একের মুখ থেকে ঝরে পড়ে অন্যের জীবনে জন্ম নেয়।

দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝতে শুরু করলাম, পাতার শহর শুধু একটা জায়গা নয়, এটা একটা অবস্থা। এখানে আসলে সবাই আসে কিছু হারিয়ে—কারো প্রেম, কারো সময়, কারো স্বপ্ন, কারো কণ্ঠস্বর। আমি এক রাতে হঠাৎ শুনেছিলাম নিজের নাম—কেউ একজন আমাকে ডাকছে গাছের ভেতর থেকে। গাছের কাছে যেতেই বাতাস হালকা কাঁপল, আর মাটিতে ঝরে পড়ল একগুচ্ছ পাতা। তার ভেতরে একটা পাতা আলাদা হয়ে চোখে পড়ল—তাতে লেখা আমার শৈশবের এক কবিতার প্রথম লাইন, যা আমি বহু বছর আগে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি অবাক হয়ে গেলাম। কে জানে, হয়তো আমার ভেতরের শিশুটি এখানেই কোথাও ঘুমিয়ে আছে, পাতার আড়ালে।

আরও পড়ুন
বসুমতি ক্যাফেটেরিয়া
এক শরতের গল্প

শহরের মানুষজন বলে, প্রতি বছর একদিন এই শহরে ঝড় আসে। সেই ঝড়ে সব পুরোনো পাতা উড়ে যায়, আর নতুন পাতা জন্ম নেয়। সেটাই নাকি শহরের পুনর্জন্ম। কিন্তু সেই ঝড়ের আগে কিছু অদ্ভুত ঘটে—মানুষদের স্মৃতিগুলো একে একে ঝরে পড়তে থাকে। কেউ হঠাৎ নিজের নাম ভুলে যায়, কেউ প্রিয়জনের মুখ মনে করতে পারে না, কেউ আবার নিজের ঘর চিনতে পারে না। আমি ভয় পেতে লাগলাম, কারণ বুঝতে পারছিলাম, আমার ভেতরেও কিছু পরিবর্তন ঘটছে। আমার স্মৃতিরা যেন একে একে রং হারাচ্ছে, ঠিক যেমন শুকনো পাতার রং।

একদিন সেই মেয়েটির সঙ্গে আবার দেখা হলো। সে বলল, ‘তুমি জানো, এই শহরে কেউ স্থায়ীভাবে থাকে না। একসময় পাতাগুলো তোমাকেও বিদায় দেবে।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর?’ সে বলল, ‘তারপর হয়তো তুমি অন্য কোথাও গিয়ে নিজের কথা ছড়িয়ে দেবে, আর এখানে রেখে যাবে তোমার স্মৃতির ছায়া।’ তার চোখে তখন একধরনের গভীরতা, যা কোনো ভাষায় বোঝানো যায় না। আমি চুপ করে রইলাম।

দিন কেটে যাচ্ছিল। আমি হাঁটতাম রাস্তায়, পাতার সাগরে, গাছের ছায়ায়। প্রতিটি পাতায় চোখ রাখতাম—হয়তো কোনো একদিন আমার নিজের কথা ফিরে পাবো। তারপর এক বিকেলে, শহরের সবচেয়ে বড় গাছটার নিচে আমি দেখলাম এক পাতা ভেসে পড়ছে বাতাসে। সেটি আমার পায়ের কাছে এসে থামল। তাতে লেখা ছিল—‘তুমি এখন প্রস্তুত।’ আমি বুঝতে পারলাম, কিছু একটা শেষ হতে যাচ্ছে।

সেই রাতেই ঝড় এলো। আকাশ কালো, বাতাসে অজস্র পাতা উড়ে যাচ্ছে। শব্দ নেই, তবু কেমন এক তীব্র আওয়াজ, যেন স্মৃতিরা একসাথে চিৎকার করছে। আমি দৌড়ে গেলাম সেই পুরোনো গাছটার নিচে। মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে, বাতাসে তার চুল উড়ছে, চোখে জল। সে বলল, ‘এটাই শহরের শেষ রাত, কাল সকালে সব নতুন হবে।’ আমি বললাম, ‘তুমি কি থাকবে?’ সে বলল, ‘আমি আছি, কিন্তু আমিও একদিন ঝরে যাব। সবাই ঝরে যায়, শুধু গল্পটা থেকে যায়।’ তার কণ্ঠস্বর মিলিয়ে গেল ঝড়ের ভেতরে।

পরদিন সকালে যখন চোখ খুললাম, শহরটা বদলে গেছে। সব গাছ নতুন পাতা পেয়েছে, রাস্তাগুলো ঝলমল করছে। কিন্তু মানুষগুলো আগের মতো নয়। কেউ কেউ হাসছে, কেউ হেঁটে যাচ্ছে, কেউবা বসে আছে চুপচাপ। আমি বুঝলাম, হয়তো তারা নতুন কথা পেয়েছে, নতুন স্মৃতি। আমি নিজের পকেটে হাত দিলাম—একটা সবুজ পাতা। তাতে লেখা—‘তুমি এখন পাতার শহরের অংশ।’ আমি মুচকি হেসে বাতাসে ছুড়ে দিলাম পাতাটা। সেটা উড়ে গেল দূরে, কোনো এক অজানা আকাশের দিকে।

তারপর থেকে আমি আর শহরের ভেতরে কে কে আসে বা যায়, তা দেখি না। কারণ আমি নিজেই এখন সেই শহরের একজন—নিঃশব্দ, অথচ গল্পভরা। বাতাসে ভেসে বেড়ানো প্রতিটি পাতায় হয়তো আমার একটা অংশ আছে, কারো কানে আমার হারানো কথা পৌঁছে যায় কখনো। আর কেউ যদি এক শরতের বিকেলে এই শহরে এসে বলে, ‘আমি আমার কথা হারিয়েছি’—তবে হয়তো আমি নিজেই কোনো পাতার শরীরে তার কানে ফিসফিস করে বলব, ‘তোমার কথাগুলো এখানেই আছে, একটু মন দিয়ে শোনো।’ পাতার শহর এমনই—যেখানে সব হারানো কণ্ঠ একদিন ফিরে আসে, নীরবতার গভীরে, অদৃশ্য সুরের মতো।

এসইউ/এমএস

আরও পড়ুন