ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

নারী দিবস ও বাংলা সাহিত্যে নারীবাদী চেতনার প্রতিফলন

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:৪০ পিএম, ০৮ মার্চ ২০২২

আতি-উন-নাহার

নারী মুক্তি নারী স্বাধীনতার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে যুগ যুগ আগে। নারী দিবস পালনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামী ইতিহাস। আজ থেকে বহু বছর আগে ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা।

আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল পুরুষের সমান মজুরি আদায় ও দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবি। এই আন্দোলন চলাকালীন পুলিশ নির্যাতন চালায়। গ্রেফতার হন অনেক নারী। দীর্ঘ ৫০ বছর পর ১৯০৮ সালে পুনরায় নারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু হয়। জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম ১৯০৯ সালে আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

ক্লারা প্রতিবছর ৮ মার্চকে নারী দিবস পালনের ঘোষণা দেন। ১৯১১ সাল থেকে নারীদের সম-অধিকারের দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হয়ে আসছে। ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের ঘোষণা প্রদান করে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মধ্য দিয়ে নারীত্বের উৎসব পালিত হয়। জাতি, ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে নারীদের কৃতিত্বকে স্বীকৃতি জানানোর জন্য এই দিনটি পালিত হয় সারা বিশ্বে।

নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর অধিকার সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে নারী দিবসের তাৎপর্য অনস্বীকার্য। নারী সমাজের ঐক্যবদ্ধতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন আন্তর্জাতিক নারী দিবস। পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে নারীর ক্ষমতায়ন প্রথমে সাড়া জাগায় ব্যাপকভাবে। ফরাসি নারীবাদী দার্শনিক ও লেখক সিমন দ্য বোভোয়ারকে (১৯০৮-১৯৮৬) বলা হয় পাশ্চাত্য নারীবাদী আন্দোলেনের আইনস্টাইন।

নারী সম্পর্কে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও স্মরণীয় উক্তিটি করেন তিনি। ‘কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না বরং হয়ে উঠে নারী’। তিনি চিরকালের শ্রেষ্ঠ নারীদের একজন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দি সেকেন্ড সেক্স’ (১৯৪৯) যার বাংলা অনুবাদ করেছিলেন হুমায়ুন আজাদ ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ নামে।

নারীর উপর নিপীড়ন নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে গ্রন্থটিতে। সিমন দ্য বোভোয়ার এই গ্রন্থটিকে এটিকে নারীবাদের অন্যতম ভিত্তি গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তিনি প্রগতিশীল নারীদের গল্প নিয়ে লেখেন ‘দা থিংস অব দি স্পিরিট কাম ফার্স্ট’(১৯৭৯)। তাই নারীবাদের ইতিহাসে নারী দিবসের প্রাক্কালে সিমন দ্য বোভোয়ারের নাম অবশ্য স্মরণযোগ্য।

অপরদিকে বাঙালি নারী সমাজের অগ্রদূত যিনি নারী সমাজকে মুক্তি দিয়েছেন তিনি হলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২)। তিনি প্রথম বাঙালি নারীবাদী লেখক, ঔপন্যাসিক, সমাজ-সংস্কারক, শিক্ষাবিদ এবং দার্শনিক। বাঙালি নারীদের প্রথম শিক্ষার আলো দেখিয়েছিলেন তিনি। বঙ্গীয় নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম কলম ধরেন। নারীকে পণ্য করণের বিরূদ্ধে তীব্র নিন্দা জানান। মহীয়সী এই নারী বাঙালী নারী জাগরণের অগ্রদূত ছিলেন।

তার রচিত কালজয়ী গ্রন্থ ‘সুলতানাস ড্রিমস’ (১৯০৫) একটি নারীবাদী বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। গ্রন্থটি বিখ্যাত নারীবাদী সাহিত্যের ক্লাসিক নিদর্শন বলে স্বীকৃত। এছাড়াও ‘মতিচূড়’ (১৯০৪, ১৯২২) ‘পদ্মরাগ’ (১৯২৪), ‘অবরোধবাসিনী’ (১৯৩১) তার বিখ্যাত নারীবাদী সাহিত্য। তার প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং লিঙ্গ সমতার কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জন করুক।’

বেগম রোকেয়া তার প্রবন্ধে হাস্যরস আর ব্যঙ্গ বিদ্রুপের সাহায্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান বর্ণনা করেছেন। তিনি তৎকালীন নারী সমাজের পশ্চাৎপদতা ও নারীদের শিক্ষাহীনতার চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন: ‘এই বিংশ শতাব্দীর সভ্যজগতে আমরা কি? দাসী! পৃথিবী হইতে দাস ব্যবসায় উঠিয়া গিয়াছে শুনিতে পাই, কিন্তু আমাদের দাসত্ব গিয়াছে কি? ’(স্ত্রী জাতির অবনতি, মতিচূড়, প্রথম খন্ড) নারী জাগরণের অগ্রপথিক বেগম রোকেয়ার প্রতি বাঙালি নারী সমাজ চির ঋণী।

বর্তমান বিশ্বে নারী পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান। তাই নারী পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণ ব্যতিরেকে সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়। সাহিত্য সমাজের দর্পণ। যুগে যুগে কালে কালে সমাজের সব ঘটনাই সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে। নারীকে অন্ধকারাচ্ছন্ন জগত থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যের সূচনালগ্ন থেকে সেই প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে স্বাধীন পেশাজীবী নারীদের উল্লেখ আছে।

সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির নানা পেশার নারীর চরিত্র উন্মুক্ত করেছেন পদকর্তাগণ। তাঁতি, ডোম, ডোমিনি, গণিকা ইত্যাদি পেশার উল্লেখ পাই চর্যাপদে। এই ডোমিনি আর গণিকা শ্রেণির নারীরা নাচে গানে ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পারদর্শী ছিলেন। প্রাচীনযুগের সাহিত্য চর্যাপদে নারীদের স্বাধীন পেশা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বাঙালি জীবনযাত্রার পরিচয় বহন করে।

এরপর লক্ষ্য করি মধ্যযুগের সাহিত্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য। যেখানে প্রধান নারী চরিত্র রাধা। বৈষ্ণব পদাবলীতেও রাধা চরিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। এই রাধা চরিত্রে আমরা পাচ্ছি কখনো অধ্যাত্মচেতনা, কখনো নাগরিক চেতনা, কখনো লৌকিক রূপ। নারীর এই বিচিত্র রূপ সমাজে নারীর বিভিন্নরূপে অবস্থানকেই নির্দেশ করে।

মধ্যযুগের বাংলা কাব্যের আরও একটি নিদর্শন হচ্ছে মঙ্গলকাব্য। মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল। মঙ্গল কাব্যের রচয়িতারা অনেক ক্ষেত্রে জীবনবাদী। প্রতিবাদী নারী বেহুলা মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান চরিত্র। সমাজ প্রদত্ত চাপিয়ে দেওয়া শ্বাশুড়ির অপবাদ অন্যায় দোষারোপ বেহুলা মেনে নেয়নি। বেহুলা প্রতিবাদ করে বলেছে, ‘নাগিনী দংশিল প্রভু মোরে কর রোষ।/ তোমার ছয় পুত্র মৈল সেও কি আমার দোষ।’(মনসামঙ্গল কাব্য)

মনসামঙ্গল কাব্যের আর একটি প্রতিবাদী চরিত্র মনসা। নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় মনসার মা অন্ত্যজ শ্রেণিভুক্ত হওয়ায় সমাজ তাকে ত্যাগ করে। তাই মনসা জীবনের এই প্রেক্ষাপটে, অত্যাচার অনাচারের মুখে বিদ্রোহী হয়ে উঠে। মনসার মতো পুরুষতন্ত্রকে প্রতি আক্রমণ করার মতো দৃষ্টান্ত খুব বেশি নেই বাংলা সাহিত্যে।

ধর্মমঙ্গলে বীরাঙ্গনা নারীর চরিত্রে এক দুঃসাহসী নারীকে দেখতে পাই। ধর্মমঙ্গলের কবিরা সমাজের অবহেলিত অস্পৃশ্য নারীর মধ্যে বীরত্ব ও আদর্শবান বাঙালি নারী চরিত্র নির্মাণ করেছেন। চন্ডীমঙ্গল কাব্যের আর একটি চরিত্র ফুল্লরা। চিরন্তন বাঙালি নারী সমাজের প্রতিনিধি ফুল্লরা। মধ্যযুগের আর একটি উল্লেখযোগ্য কাব্য ‘মৈমনসিংহগীতিকা’।

‘মৈমনসিংহগীতিকা’র নারী চরিত্রগুলোকে স্বাধীন প্রেমিকারূপে দেখা যায়। এরা সকলেই পল্লী বাংলার নারী। সমাজের তথাকথিত নিষেধ অস্বীকার করে তারা আপন প্রেমের জয়গান করেছে। নারীবাদী চেতনার আধুনিক রূপ এসকল নারীর মধ্যে প্রতিফলিত। মহুয়া, মলুয়া মদিনা পালায় প্রেমের জয়গান করা হয়েছে। দৌলতকাজীর চন্দ্রানী, আলাওলের পদ্মাবতী বাঙালি নারীর আদর্শ প্রতিমা। বাংলা রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ‘ইউসুফ-জলিখা’ কাব্যের জলিখা এক সাহসী প্রেমময়ী নারী। মধ্যযুগের কাব্যে যা এক বিরল দৃষ্টান্ত।

মধ্যযুগের সমাজে নিগৃহীত নিপীড়িত অবস্থার মধ্যে থেকেও সাহিত্যে নারীবাদী, প্রতিবাদী, প্রেমময়ী নারী চরিত্র সৃজনে কবিরা ছিলেন অটল ও অবিচল। যা সত্যিই প্রশংসনীয়। এক কথায় মধ্যযুগের প্রেক্ষাপটে যা ছিল বিস্ময়কর। মধ্যযুগের কবিরা পুরুষ হলেও নারীর ব্যথা-বেদনার কথা পূর্ণ স্বাধীন সত্তা দিয়ে তৈরি করেছেন। বাংলা সাহিত্যে সমৃদ্ধ মধ্যযুগের কাব্যে আমরা অনন্য সাধারণ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রময়ী নারী চরিত্র রূপায়ন লক্ষ্য করি।

ঊনবিংশ শতকে মানবতাবোধের উদার আদর্শ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধের তীব্র অনুভূতি থেকে মাইকেল এগিয়ে এসেছিলেন বাংলার নারী মুক্তির চেষ্টায়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যকে বলা যায় নারীমুক্তির কাব্য। বাঙালি সমাজে নারী মুক্তির প্রাণ পুরুষ বিদ্যাসাগরকে তিনি এই কাব্য উৎসর্গ করেছেন। এই কাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো কবি একটি সম্পূর্ণ নারী জগৎ গড়ে তুলেছেন।

এখানে ১১টি পত্রকাব্যে নারীর মনকেই কবি প্রাধান্য দিয়েছেন। নারীর দুঃখ, সুখ, কামনা, বাসনা, আবেগ, উত্তাপ, হিংসা, ঈর্ষা এই পত্রকাব্যে বর্ণিত হয়েছে। আধুনিক নারী চিত্তের মুক্তির সুর বাজিয়েছেন তিনি। এভাবে আমরা মাইকেল মধুসূদনের কাব্যে নারী স্বাধীনতার প্রতিফলন ও নারীবাদী চেতনা দেখতে পাই। মধুসূদনের প্রথম প্রতিবাদী নারী প্রমিলা বীরবেশে স্বামী মিলনের জন্য যাত্রা করেছে, চিত্রাঙ্গদা স্বামীর বিরূদ্ধে বিদ্রোহী হয়েছে ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’, বাংলা সাহিত্যে প্রথম প্রতিবাদী নারীর উক্তি বলে অনেকে মনে করেন।

বিংশ শতাব্দীতে কবি নজরুল ‘নারী’ কবিতায় নারী পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চত করার কথা বলেছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন ‘নারী’ কবিতায়। পুরুষদের সর্বেসর্বা মনোভাবকে দলিত করে তার কবিতায় তুলে এনেছেন, দ্বিধাহীন কন্ঠে উচ্চারণ করেছেন সাম্যের বাণী: ‘সাম্যের গান গাই, আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোন ভেদাভেদ নাই।’ (নারী, সাম্যবাদী)

নারী মুক্তি আর নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্রে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাদের অন্যতম হচ্ছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ সমগ্র নারী জাতিকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে জোর দিয়েছেন। তার রচিত ‘কালান্তর’ প্রবন্ধ গ্রন্থের ‘নারী’ প্রবন্ধে খুব জোরালোভাবে তিনি একথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘কালের প্রভাবে মেয়েদের জীবনের ক্ষেত্র এই যে, স্বতই প্রসারিত হয়ে চলেছে, এই যে মুক্ত সংসারের জগতে মেয়েরা আপনিই এসে পড়ছে, এতে করে আত্মরক্ষা এবং আত্মসম্মানের জন্য তাদের বিশেষ করে বুদ্ধির চর্চা, বিদ্যার চর্চা, একান্ত আবশ্যক হয়ে উঠল।’

‘মহুয়া’ কাব্যের ‘সবলা’ কবিতায় নারীর বলদৃপ্ত আত্মঘোষণায় রবীন্দ্রনাথের প্রশ্ন:
‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার,
কেহ নাহি দিবে অধিকার,
হে বিধাতা..নত করি মাথা প্রান্তে কেন রব জাগি?’

মানসিকভাবে চির স্বাধীন এই নারীকে রবীন্দ্র কাব্যে বার বার দেখা যায়। বিদায় অভিশাপ এর দেবযানী, চন্ডালিকার চন্ডাল কন্যা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ । রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’(১৯৩৬)র বিদ্রোহী সত্তা চিত্রাঙ্গদা। মনিপুর রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা। রাজেন্দ্র নন্দিনী চিত্রাঙ্গদা অর্জুনকে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন:
‘আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্র নন্দিনী।
নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী
পূজা করি মোরে রাখিবে উর্ধ্বে
সে নহি নহি,
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে
সে নহি নহি। যদি পার্শ্বে রাখ মোরে
সঙ্কটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে সহায় হতে,
পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।’

নারীকে যদি প্রকৃত কর্মসঙ্গীনি রূপে দেখা হয় তবেই তাকে তার সামাজিক অবস্থানে সুদৃঢ় করা যায়। কবিতার মর্মবাণী এটাই।

পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি বিদ্রোহ করেছে রবীন্দ্রনাথের মৃণাল চরিত্র। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘স্ত্রীর পত্রে’র মৃণাল গৃহত্যাগী হয়ে স্বামীকে চিঠি লিখে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আধুনিক নারীবাদী মৃণালের মত মেয়েরা প্রতিবাদ করেই বাঁচে। একটা বীজকে খুব বেশিদিন মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা যায় না। তাই বলা যায় পুরুষবান্ধব এই সমাজে অসহায় বিন্দুরা(স্ত্রীর পত্র) যেমন আছে তেমনি প্রতিবাদী মৃণালরাও কম নেই। তারা সমাজের সকল অন্যায়ের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ করে। ‘স্ত্রীরপত্র’ পাশ্চাত্য নারীবাদের ছায়ায় রচিত । নারীর সামাজিক স্বাধীনতার কথা ব্যক্ত হয়েছে গল্পটিতে।

নরওয়েজিয়ান কালজয়ী নাট্যকার হেনরিক ইবসেন এর বিখ্যাত নাটক ‘এ ডলস হাউস’এর নোরা চরিত্র এক আধুনিক নারীবাদী চেতনার প্রতীক। নিজের আত্মপরিচয় জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়া এক নারী নোরা। বিস্তৃত উন্মুক্ত পৃথিবীর অবারিত স্বাধীনতার দিকে পা বাড়িয়েছিলো নোরা হেলমার। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতি তীব্র প্রতিবাদ ব্যক্ত হয়েছে নোরা চরিত্রে। আমরা রবীন্দ্রনাথেও নারীবাদী সাহিত্যের পাশ্চাত্য প্রভাব লক্ষ্য করি।

অপরদিকে রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’(১৯২৯) উপন্যাসের কুমুদিনী একজন বিদ্রোহী নারী। কুমুদিনীর মুক্তি তার প্রেম নয় তার স্বাধীনচিত্ততা, তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতার মধ্যে নিহিত ছিল। কুমুদিনী –মধুসূদনের দাম্পত্য সম্পর্কের ফাটল এর মূলে ছিল উভয়ের চিন্তাভাবনার পার্থক্য। তাদের দাম্পত্য জীবনে কুমুদিনীর আধুনিক নারীবাদী সত্তার প্রতিফলন ঘটেছে।

‘ঘরে বাইরে’ (১৯১৬) উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ নারী স্বাধীনতা ও অধিকার বিষয়ক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। বিমলা চরিত্রে তিনি আধুনিক নারীর প্রতিরূপ নির্মাণ করেছেন। বিমলার ঘর থেকে বাইরে বের হওয়া এক অসামান্য সৃষ্টি। আধুনিক মনের মানুষ নিখিলেশ স্ত্রীকে পরিধান করিয়েছে আধুনিক পোশাক, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে ছিল বদ্ধ পরিকর।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রাপ্তি ছিল বিমলা চরিত্র বিকাশের একটি উল্লেখযোগ্য ধাপ। এ প্রসঙ্গে নিখিলেশের মন্তব্য: ‘বিশ্বের মধ্যে জ্ঞানে, শক্তিতে প্রেমে পুনর্বিকশিত বিমলাকে দেখার বড় ইচ্ছা ছিল।’ স্বামীর আন্তরিক ইচ্ছায় সে ঘরের সীমাবদ্ধ পরিসর থেকে বাইরের বিস্তৃত জগতে পদচিহ্ন রেখেছিল। স্বামীর উৎসাহে সামাজিক বিধি নিষেধ অবজ্ঞা করে প্রচলিত প্রথা ভেঙে বিমলা মুখোমুখি হয়েছিল বর্হিজগতের।

আমরা আরও লক্ষ্য করি রবীন্দ্রনাথ তার ভ্রমণসাহিত্য ‘ইয়ুরোপ প্রবাসীর পত্রে’ দেশের নারীদের করুণ অবস্থার জন্য সহানভূতি প্রকাশ করেছেন। এসব কিছুর পেছনে তিনি পুরুষের আধিপত্যবাদ ও স্বার্থপরতাকে মূল কারণ হিসাবে দেখেছেন।

রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সের সৃষ্টি ‘ল্যাবরেটরী’ গল্পে সোহিনীর বিদ্রোহ রবীন্দ্র রচনার পূর্বাপর সতীত্ব, পতীত্ব ও দাম্পত্য প্রেমের একমাত্রিক ধারণাকে ভেঙে চূড়ে ফেলে দিয়েছে। প্রেমের বহুমাত্রিক ধারণা রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ প্রান্তে পাঠককে অভিভূত করে। এভাবে সমগ্র রবীন্দ্র সাহিত্যে কাব্য, নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ সর্বত্রই পাশ্চাত্যের নারীবাদী সাহিত্যচিন্তার প্রভাব দেখতে পাই।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ভাবনা এবং বাংলা সাহিত্যের প্রতিবাদী নারী চরিত্রের মর্মবাণী আজ একই কথা বলছে। সমগ্র বিশ্বের নারী মানবতার সঙ্গে সুর মিলিয়ে গাইছে সমস্বরে:‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা, চির বিজয়িনী জাগো জয়ন্তিকা।’

লেখক: সিনিয়র প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়

তথ্য নির্দেশ:
বাংলা সাহিত্যে নারী: মাসুদুল হক।
সিমন দ্য বোভোয়ার: মাহমুদ শাহ কোরেশী
রোকেয়া রচনাবলী: আব্দুল কাদির সম্পাদিত,বাংলা একাডেমি

কেএসকে/জিকেএস

আরও পড়ুন