ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

বালিকা বউ : জীবনের বিচিত্র অনুরণন

প্রকাশিত: ০৫:৫৪ এএম, ২১ মার্চ ২০১৬

মায়াবতীর মন, পার্বতীপুর জংশন, সে আমায় ভালোবেসেছিল, এতো কষ্ট কেন, নূরুলের বঙ্গবন্ধু দর্শন, প্রভাতফেরি, মনুমিয়ার শেষ লড়াই, ঘাতক, ‘রুদ্র, আমাদের রুদ্র’, নলিকান্ত বাবুর শেষ বাড়িটা, বালিকা বউ, আমলা কাহিনী, শিরোনাম জানা নেই, এই! প্রিয়তা, একটি অসমাপ্ত প্রেমের গল্প-  কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক মোস্তফা কামালের ‘বালিকা বউ’-এর এই পনেরটি গল্পের বিষয়-বিন্যাস ও  নির্মাণ-কৌশলে নিজের সময় ও পরিবর্তিত বাস্তবতাকে ধরে রেখেছেন।

মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের গ্রাম ও নগর মোস্তফা কামালের গল্পের কাহিনিকে ঋদ্ধ করেছে। নর-নারী সম্পর্ক, একুশের চেতনা, বাল্যবিবাহের ক্ষত এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান অসঙ্গতিকে বর্ণনায় তুলে ধরেছেন তিনি। আর এসব বিষয়ই তার গল্পের আঙ্গিক নির্ধারণ করে দিয়েছে। জীবন ও সময় পরিভ্রমণের ভেতর দিয়ে নতুন নতুন গল্প সৃজন করেছেন তিনি। তার গল্পের বিষয় ও নির্মাণ-কৌশল পুনরাবৃত্তি-মুক্ত। তার প্রতিটি গল্প নিরলস ও কঠোর শ্রমের ফসল। তিনি গল্প বলতে গিয়ে বিষয়বৈচিত্র্য ও গভীরতায় নতুন আবেদন সৃষ্টি করেছেন। কথাবস্তুকে সম্পূর্ণ সংহতরূপে প্রকাশ করেছেন। শব্দ-প্রয়োগ, বাক্য-বিন্যাস, গদ্যের গতি, ছন্দ ও অলঙ্কার প্রয়োগ শুধুই নান্দনিক বিষয় নয়, বিষয়ের বাইরেও নতুন ব্যঞ্জনা তৈরি হয়েছে। তিনি মনে করেন, তার দায়বদ্ধতা মানবজাতির কাছে- সুনির্দিষ্ট অর্থে আপন দেশ ও কালের কাছে। ছোটগল্পে ক্ষুদ্র কলেবরে নিগূঢ় সত্যের ব্যঞ্জনা উদ্ভাসিত হয়। মোস্তফা কামালের গল্পগুলোর আয়তন ক্ষুদ্র- ছয় থেকে দশ পৃষ্টায় তা সমাপ্ত হয়েছে। সেই ক্ষুদ্রায়তনের মধ্যে বৃহতের ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রতিটি গল্পের আরম্ভ ও উপসংহার নাটকীয়।

‘এই! প্রিয়তা’ গল্পের সূচনা এভাবে- ‘ঢাকা শহরের চাঁদের আলোটা সচরাচর দেখা হয় না।’ কিংবা ‘আমলা কাহিনী’র আরম্ভ এভাবে- ‘স্যার, আপনি তো দেখছি সাংঘাতিক ওস্তাদ মানুষ।’  মানবজীবনের কোনো একটি বিশেষ মুহূর্ত, ভাব বা চরিত্রের একটি বিশেষ দিক উজ্জ্বল করে তুলেছেন তিনি কোনো কোনো গল্পে। তখন যেকোনো ধরনের বাহুল্য বর্জনের মাধ্যমে গল্পটি হয়ে উঠেছে রসঘন। কখনো রূপক বা প্রতীকের মাধ্যমে অব্যক্ত কোনো বিষয়ের ইঙ্গিত দিয়েছেন। সর্বোপরি গল্পসমাপ্তির পরেও পাঠকের মনের মধ্যে এর অনুরণন চলতে থাকে। কয়েকটি গল্পে সামাজিক সমস্যা তুলে ধরেছেন মোস্তফা কামাল।
তার ‘বালিকা বউ’ এবং ‘নলিকান্ত বাবুর শেষ বাড়িটা’তে যথাক্রমে কিশোরীর বিবাহ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচারের কাহিনী বিবৃত হয়েছে। ‘বালিকাবউ’-এ কিশোরীর মা’র কোলে ঠাঁই দিয়ে ওই সংকট উত্তরণের প্রয়াস দেখিয়েছেন গল্পকার। অন্যদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের নলিকান্ত আইনের সহায়তা পেলেও শেষ পর্যন্ত তার বন্ধু সাফদার চেয়ারম্যানসহ জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্য দ্বারা আক্রান্ত হয়ে উভয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। প্রগতিশীল মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতারাও জঙ্গিগোষ্ঠীর টার্গেটে পরিণত হয়েছেন সেই বাস্তবতাও গল্পকার এ গল্পে তুলে ধরেছেন।

অন্যদিকে বঞ্চিতদের বেদনার কাহিনী আছে ‘পার্বতীপুর জংশন’ গল্পে। এ গল্পে পেট্রল বোমায় অসহায় ও গরিব মানুষের করুণ পরিণতি দেখিয়েছেন লেখক। স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় দেশের কত মানুষ এখনো সেই দুঃসহ স্মৃতি ও যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে সে খবর কে রাখে? মূলত সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র দক্ষতার সঙ্গে অঙ্কিত হয়েছে ‘বালিকাবউ’ গল্পগ্রন্থের একাধিক গল্পে। আবার তিনি হাস্যরস সৃষ্টিতে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন ‘আমলা কাহিনী’তে। কয়েকটি গল্পে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জীবনের প্রেম ও বিচ্ছেদের কাহিনী প্রাধান্য পেয়েছে। যেমন, ‘একটি অসমাপ্ত প্রেমের গল্প’ এবং ‘সে আমায় ভালোবেসেছিল’ গল্প দুটিতে করুণ সুর চিত্রিত হয়েছে।

‘জনক-জননীর গল্প’ উপন্যাসের মতো মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্প রচনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন মোস্তফা কামাল। ‘নূরুলের বঙ্গবন্ধু দর্শন’ কিশোর মুক্তিযোদ্ধার গল্প। যুদ্ধে পিতাকে হারিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে অস্তিত্ব-সংকটে নিমজ্জিত হওয়ার কাহিনীও এটি। গল্পকারের বয়ানে বঙ্গবন্ধুর ঔদার্য প্রদর্শিত হলেও নূরুলের জীবনে তার সংস্পর্শে আসা সম্ভব হয়নি কখনো। ‘ঘাতক’ গল্পটি নৃশংসতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার জোরালো অভিব্যক্তি তবে তার পরিণতি জানান দিয়েছে শুভবোধের জাগরণে।
সংস্কারমুক্ত বৈজ্ঞানিক জীবনদৃষ্টির মাধ্যমে মোস্তফা কামাল ‘বালিকাবউ’ গল্পগ্রন্থের পনেরটি গল্পে জীবনের আন্তর সত্য প্রকাশ করেছেন। মানবজীবনের অনেক অধ্যায় বা কাহিনী বাস্তবসম্মতভাবে চিত্রিত হয়েছে এ গ্রন্থের গল্পসমূহে। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কাম্য।

বালিকা বউ, মোস্তফা কামাল, আলোঘর প্রকাশনা, ২০১৬, প্রচ্ছদ : শতাব্দী জাহিদ, মূল্য : ২৫০ টাকা।

এইচআর/পিআর