সাংবাদিকতার নৈতিকতা অটুট রেখে এআই ব্যবহারের আহ্বান প্রেস সচিবের
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এআই ব্যবহার নিয়ে প্রশিক্ষণ কর্মশালার সমাপনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম/ছবি: জাগো নিউজ
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দ্রুত বদলে দিচ্ছে সাংবাদিকতার চেনা কাঠামো। এতে কাজের গতি যেমন বেড়েছে, তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে ভুল তথ্য, ভুয়া ছবি ও ডিপফেকের ঝুঁকি। এ বাস্তবতায় সাংবাদিকতার মূল নৈতিকতা অটুট রেখে নতুন প্রযুক্তিটি ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) শফিকুল কবির মিলনায়তনে ‘এআই-পাওয়ার্ড জার্নালিজম: অপারচুনিটি, রিস্ক অ্যান্ড ডিজিটাল সিকিউরিটি’ শীর্ষক প্রশিক্ষণের সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনি এ আহ্বান জানান। টেক প্রতিষ্ঠান ও খেলাধুলাবিষয়ক বিশ্বের প্রথম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গেমপ্লিফাই.এক্সওয়াইজেড-এর পৃষ্ঠপোষকতায় ডিআরইউ সদস্যদের জন্য দুই দিনব্যাপী এ কর্মশালা হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে শফিকুল আলম বলেন, সাংবাদিকতা এআই-নির্ভর হোক বা না হোক, এর গোল্ডেন স্ট্যান্ডার্ড বা মৌলিক নীতিমালা কখনোই বদলাবে না। প্রতিটি তথ্যের সুনির্দিষ্ট সূত্র থাকতে হবে এবং প্রতিটি উদ্ধৃতি হতে হবে শতভাগ নির্ভুল। এ জায়গায় কোনো আপসের সুযোগ নেই।
প্রেস সচিবের মতে, সঠিকভাবে ব্যবহার করা হলে এআই সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত সক্ষমতা বহুগুণ বাড়াতে পারে। আগে যেখানে একজন সাংবাদিকের উৎপাদনশীলতা ৩০ শতাংশের মতো ছিল, সেখানে এখন তা ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। এআই টুলের সহায়তায় একজন সাংবাদিক একাই কোনো নির্দিষ্ট খাত যেমন শিপিং, কৃষি গবেষণা বা জলবায়ু নিয়ে বড় আকারের ওয়েবসাইট বা তথ্যভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম পরিচালনা করতে পারেন। এতে যেমন ক্যারিয়ারের নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে, তেমনি গভীর ও বিশেষায়িত সাংবাদিকতার ক্ষেত্রও প্রসারিত হচ্ছে।
তবে এআইয়ের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হিসেবে তিনি তুলে ধরেন ভুয়া ছবি, ভিডিও ও ফটোকার্ডের অপব্যবহার। তিনি বলেন, এআই ব্যবহার করে দীর্ঘ বক্তব্যকে এমনভাবে কাটছাঁট ও বিকৃত করা যায়, যা দেখে বা শুনে সাধারণ মানুষের পক্ষে আসল বক্তব্য বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ধরনের কনটেন্ট সমাজে বিভ্রান্তি তৈরি করছে এবং পরিকল্পিতভাবে জনমতকে প্রভাবিত করার হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে।
শফিকুল আলম বলেন, ‘ডিপফেকের কারণে এখন প্রতিনিয়ত ফটোকার্ডের অত্যাচার শুরু হয়েছে। আমিই এর শিকার হয়েছি। আমার ২৭ মিনিটের বক্তব্য এমনভাবে জোড়াতালি দিয়ে এক মিনিটে নামিয়ে আনা হয়েছে, যা অবিশ্বাস্য। তাই যারা এআই জানেন না, তাদের সাংবাদিকতা করা উচিত নয়। এআই জানা এখন আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। আর যতদিন আমরা প্রযুক্তিগতভাবে স্বনির্ভর না হবো, ততদিন সাংবাদিকদের ফ্যাক্টচেকারের ভূমিকা পালন করতে হবে।’
তিনি অভিযোগ করেন, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা এক্সের মতো বড় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো বাকস্বাধীনতার যুক্তি দেখিয়ে অনেক সময় ঘৃণা ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছে। অথচ এসব প্ল্যাটফর্মের কার্যকর দায়বদ্ধতা নেই। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো ঘৃণামূলক প্রচারণার কারণে রোহিঙ্গাদের মতো সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জীবন বিপন্ন হয়েছে এবং ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। নিজস্ব প্রযুক্তিগত স্বাধীনতা না থাকায় অনেক দেশই এসব বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।

এআইয়ের অপব্যবহার গণতন্ত্রের জন্যও বড় হুমকি হয়ে উঠছে বলে মনে করেন শফিকুল আলম। তিনি জানান, নির্বাচন প্রভাবিত, সামাজিক অস্থিরতা তৈরি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলার মতো ঘটনা বাড়ছে। এ কারণে এআই ব্যবহারে নৈতিকতা ও কার্যকর নজরদারি জরুরি হয়ে উঠেছে।
প্রেস সচিব বলেন, ‘এআই লিটারেসি বা শিক্ষা একটি বাধ্যতামূলক বিষয়। এটি ছাড়া বর্তমানে সাংবাদিকতা করা অসম্ভব। এটি কেবল ক্যারিয়ারের উন্নতির জন্য নয়, বরং ভুয়া তথ্য ও ডিপফেক শনাক্ত করে গণতন্ত্র ও সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার জন্যও প্রয়োজন।’
যারা বলেন যে তারা এআই জানেন না- বর্তমান সময়ে তাদের পক্ষে সাংবাদিকতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে বলে উল্লেখ করেন শফিকুল আলম। তিনি ডিআরইউর দুই হাজারের বেশি সদস্যসহ সব সংবাদকর্মীর প্রতি আহ্বান জানান, যেন তারা এআই শেখেন- একদিকে কাজের মান বাড়াতে, অন্যদিকে ভয়ংকর ভুয়া তথ্য দ্রুত শনাক্ত করতে।
এআইকে তিনি তুলনা করেন একটি ধারালো ছুরির সঙ্গে। তার ভাষায়, এটি দিয়ে যেমন দ্রুত কাজ শেষ করে জীবন সহজ করা যায়, তেমনি অসাবধানতায় এটি ভুল হাতে পড়লে বড় ধরনের ক্ষত বা সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। তাই এই ছুরি চালানোর সঠিক বিদ্যা বা লিটারেসি অর্জন করাই এখন সাংবাদিকদের মুক্তির পথ।
ডিআরইউ সভাপতি আবু সালেহ আকনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল। আরও বক্তব্য দেন তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ সম্পাদক মাহমুদ সোহেল এবং গেমপ্লিফাই.এক্সওয়াইজেডের সিইও মাহফুজুর রহমান।
সমাপনী বক্তব্যে ভারতীয়সহ ভিনদেশি আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত প্রযুক্তিগত জ্ঞান কাজে লাগানোর আহ্বান জানান ডিআরইউ সভাপতি।
যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল থেকে জুমে যুক্ত হয়ে গেমপ্লিফাই.এক্সওয়াইজেডের প্রতিষ্ঠাতা মশিউর রহমান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাব থেকে বেরিয়ে সুস্থ ধারার একটি পরিবেশ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। এজন্য গণমাধ্যমকর্মীদের তথ্য যাচাইয়ে আরও সতর্ক হতে হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ভবিষ্যতে যৌথ উদ্যোগে আরও কাজ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে দুই দিনের প্রশিক্ষণের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কুইজ প্রতিযোগিতা হয়। এতে ডিআরইউ সদস্য সাইফ, গাজী আনোয়ার ও আল আমিন আজাদ পুরস্কৃত হন।
টিটি/একিউএফ/এমএস
সর্বশেষ - গণমাধ্যম
- ১ সাংবাদিকতার নৈতিকতা অটুট রেখে এআই ব্যবহারের আহ্বান প্রেস সচিবের
- ২ প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলা গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় সরাসরি আঘাত
- ৩ নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি মতিন, সম্পাদক ইমন
- ৪ ‘এআই সাংবাদিকের বিকল্প নয়, শক্তি বাড়ানোর হাতিয়ার’
- ৫ পত্রিকা অফিসে হামলা-সাংবাদিক হেনস্তার প্রতিবাদে ডিআরইউর মানববন্ধন