ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিবিধ

বন্যার পদধ্বনি : সতর্ক হতে হবে এখনই

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:৫৫ পিএম, ০২ জুন ২০২৫

সিরাজুল ইসলাম

বছর ঘুরে আবারো বর্ষা মৌসুম আমাদের সন্নিকটে। তীব্র গরম আর দাবদাহে পুড়ে যাওয়া প্রকৃতিতে নেমে আসতে শুরু করেছে শান্তির ধারা। আকাশ থেকে ক্ষণে ক্ষণে নেমে আসছে যেন শান্তির বাণী। কিছুদিনের মধ্যেই সারা দেশে শুরু হবে আমনের নতুন মৌসুম, কৃষকেরা মনের আনন্দে মেতে উঠবেন রোপা আমনের চাষে। মাঠে মাঠে ভরে উঠবে সবুজ ধানের ক্ষেত, চারদিকে যেন ঢেউ খেলে যাবে সবুজের সমুদ্র। বর্ষার পানির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠবে কচি ধানের সবুজ চারা। এই বর্ষায় প্রকৃতি যেন তার আপন রূপ ফিরে পাবে; পত্র-পল্লবিত হয়ে উঠবে আমাদের চারপাশ।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

গোলাপের যেমন কাঁটা থাকে, তেমনি বর্ষারও আছে মন্দ দিক। বর্ষার আগমনে চির সবুজ আমাদের এই দেশে যেমন আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়, তেমনি অতি বৃষ্টি কিংবা উজানের ঢলে দেশ প্লাবিত হয়। এর সাথে যোগ হয় প্রতিবেশী ভারত থেকে ছেড়ে দেয়া বাড়তি পানি। এতে বন্যা হয়ে ওঠে প্রাণঘাতী। বহু মানুষের মৃত্যু হয়, তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ মাঠ-ঘাট, ভেসে যায় মাছের ঘের-বাওড়, নষ্ট হয় কৃষকের অতি যত্নের ফসল।

বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে এবার অনেকটা আগেভাগে। এবার বৃষ্টি একটু বেশিই হচ্ছে। জ্যৈষ্ঠ পার হওয়ার আগেই বন্যাভাব দেখা দিয়েছে উত্তরপূর্ব সীমান্তবর্তী শেরপুর জেলায়। বন্যার পানি ছুঁই ছুঁই করছে নেত্রকোণা ও সুনামগঞ্জেও। ২৯ মে বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমগুলো দেশের ছয় জেলায় বন্যার পূর্বাভাস জানিয়ে খবর দিয়েছে। খবরে বলা হয়েছে- বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপের ফলে দেশের বেশিরভাগ জেলায় ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এতে দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের ছয় জেলা- ফেনী, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টির আভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

পানি উন্নয়ন বোর্ড বলেছে, ভারি বৃষ্টির প্রভাবে চট্টগ্রাম বিভাগের গোমতী, মুহুরি ও ফেনী নদীর পানি বাড়তে পারে। আর মুহুরি নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। পরের একদিনে এসব নদীর পানি কমে যাওয়ার আভাসও দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। নিম্নচাপের প্রভাবে টানা বৃষ্টিপাতে কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি বাড়ছে। তবে তা এখনও বিপৎসীমার নিচে রয়েছে বলে জানিয়েছে পাউবো। শুক্রবার সন্ধ্যায় কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, টানা বর্ষণ এবং ভারত থেকে নেমে আসা পানিতে গোমতীর পানি কিছুটা বেড়েছে। তবে এখনও বিপৎসীমার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা এডিবির উদ্ধৃতি দিয়ে এতে বলা হয়, কেবল ২০১৪ সালের বন্যায় অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দুইশ ২০ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় দেড় শতাংশ। এই বিশাল ক্ষতি ঠেকাতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই গবেষণা করে বের করতে হবে বন্যা মোকাবেলার উপায়। প্রাথমিকভাবে তো নাব্যতা হারানো খাল ও নদী খনন করাই যায়।

বিভিন্ন খবরে বলা হয়েছে, আগামী ২ দিনে মুহুরি ও ফেনী নদীতে পানি বাড়তে পারে। এই সময়ে মুহুরি নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। ফেনী জেলার মুহুরি নদীর নিম্নাঞ্চলে বন্যা-পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। বন্যার পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের সারিগোয়াইন, যাদুকাটা, মনু, ধলাই, খোয়াই ও সোমেশ্বরী নদীর পানি আগামী ৩ দিন বাড়তে পারে এবং এই সময়ে নদীগুলোর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এই সময়ে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোণা জেলার এসব নদীর নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি আগামী ৩ দিন বাড়তে পারে এবং তিস্তা নদী সতর্কসীমায় প্রবাহিত হতে পারে। পদ্মা নদীর পানিও বাড়ছে এবং ৫ দিন পর্যন্ত বাড়তে পারে। তবে তাতে বন্যা পরিস্থিতিরই সৃষ্টি হবে না।

এই যে বন্যা কিংবা বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া- এমন অবস্থায় বন্যাপ্রবণ এলাকার লোকজনের বিশেষ কিছু করণীয় রয়েছে। এসব কাজে সরকারের পক্ষ থেকেও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন- নদ-নদী ও খালের ওপর যে-সব ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ রয়েছে সেগুলোকে দ্রুত মেরামত করা। বেড়িবাঁধের প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি।

বন্যা মোকাবেলায় সরকারি সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় প্রশাসন থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও নির্দেশনা মেনে চললে নিরাপদ থাকা সহজ হয়। বন্যা শুরুর আগেই স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, থানা বা উপজেলা প্রশাসনের হটলাইন নম্বর সংরক্ষণ করে রাখা দরকার। কোথায় আশ্রয়কেন্দ্র আছে, কীভাবে সেখানে পৌঁছাতে হবে- এসব তথ্য আগে থেকেই জেনে নিতে হবে।

বিজ্ঞাপন

বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়ার আগে সবচেয়ে দ্রুত যে কাজ করা দরকার তাহলো- শুকনো খাবার যেমন চিড়া, মুড়ি, বিস্কুট সংগ্রহে রাখা। গবাদি পশুর জন্য খড় ও অন্যান্য খাদ্য নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় আবহাওয়া অফিস, রেডিও বা মোবাইলের মাধ্যমে বন্যা ও আবহা্ওয়া সম্পর্কিত সর্বশেষ তথ্য জানতে হবে।
বন্যার সময় যেহেতু নিম্নাঞ্চল দ্রুত পানিতে ডুবে যায় সে কারণে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে নিরাপদ এবং উঁচু স্থান ঠিক করতে হবে। স্থানীয় স্কুলকলেজ, মাদ্রাসা কিংবা আশ্রয়কেন্দ্র সম্পর্কে আগেই জেনে রাখা উচিত। কোন পথে গেলে সহজে আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছানো যাবে তা পরিকল্পনা করে রাখা দরকার। প্রয়োজনে এলাকার লোকজনকে সাথে নিয়ে স্কুলকলেজ মাদ্রাসা ও আশ্রয়কেন্দ্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। একইভাবে গবাদি পশুর জন্যও উঁচু স্থানে আশ্রয় তৈরি করার ব্যবস্থা করতে হবে।

কখনো কখনো বন্যার পানি অতি দ্রুত প্রবেশ করে। সেজন্য নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য হাতে খুব কম সময় থাকে। ফলে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে আগেই জরুরি ব্যাগ প্রস্তুত রাখা দরকার যাতে যেকোনো সময় ঘর ছাড়া সম্ভব হয়। এমন ব্যাগে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (জাতীয় পরিচয়পত্র, জমির কাগজ, জন্মনিবন্ধন), শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ, টর্চলাইট, মোবাইল চার্জার ও কিছু নগদ টাকা রাখা উচিত। নারীদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসামগ্রী এবং শিশুদের খাবার ও ডায়াপার রাখাও গুরুত্বপূর্ণ।

বন্যার পানির মধ্যে বিদ্যুৎ বা গ্যাস সংযোগ চালু থাকলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। ফলে বিপদ এড়াতে ঘর ছাড়ার আগে সংযোগগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। এ বিষয়ে পরিবারের সব সদস্যকে আগে থেকেই প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন।

বিজ্ঞাপন

পরিশেষে একটি কথা উল্লেখ করতে চাই, তাহলো- গত বছরের আগস্টে আওয়ামী সরকারের পতনের পর আমাদের দেশের নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামসহ ১১টি জেলা বন্যাকবলিত হয়। অভিযোগ রয়েছে- সে সময় যেমন ভারতের উজান থেকে ঢল নেমে এসেছিল, তেমনি ভারত ইচ্ছা করে বাঁধ খুলে ডুবিয়ে দেয় বিস্তীর্ণ এলাকা। এ সময় ভারী বৃষ্টি ও ভারতের উজানের পানিতে যে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয় তাতে অন্তত দুইজন নারীসহ ১৫ জন মারা যান। এছাড়া, ক্ষতিগ্রস্ত হন ৪৮ লাখের বেশি মানুষ।

বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে গত আগস্টে গ্রান্থাম রিসার্চ ইন্সটিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্যা এনভায়রনমেন্ট ও সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিসি থেকে একটি সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ মানুষ বন্যার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া ১৯৭১ থেকে ২০১৪ সাল অর্থাৎ ৪৩ বছরে হওয়া ৭৮টি বন্যায় ৪১ হাজার ৭৮৩ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আর এতে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ১২শ ২০ কোটি ডলারের।

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা এডিবির উদ্ধৃতি দিয়ে এতে বলা হয়, কেবল ২০১৪ সালের বন্যায় অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দুইশ ২০ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় দেড় শতাংশ। এই বিশাল ক্ষতি ঠেকাতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই গবেষণা করে বের করতে হবে বন্যা মোকাবেলার উপায়। প্রাথমিকভাবে তো নাব্যতা হারানো খাল ও নদী খনন করাই যায়।

বিজ্ঞাপন

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এইচআর/জিকেএস

বিজ্ঞাপন