‘রাতের ভোটের কারিগর’
নূরুল হুদা কমিশনে বাতিল করা হয় খালেদা জিয়ার প্রার্থিতা

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে ভোটের আগের রাতেই ব্যালটে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে সিল মারার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এই কারণে রাতের ভোট হিসেবে পরিচিত পায় ওই নির্বাচন। ফলও হয় একতরফা। নির্বাচনে ২৯৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট পায় ২৮৮টি।
অপরদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট পায় মাত্র আটটি আসন। তখনকার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা কমিশন বিষয়টি জানার পরও ব্যবস্থান নেয়নি। উলটো ধামাচাপা দেয়। এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকেও ভোটের মাঠ বিরত রাখে রাতের ভোটের কুশীলব কে এম নূরুল হুদা।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
শুধু তাই নয়, ২০১৭ সারের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করা নূরুল হুদা ওইসব ঘটনায় বিব্রত ছিলেন না। বরং তিনি নাকি সফলভাবেই জাতীয় নির্বাচনসহ ছয় হাজারের বেশি বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন করেছেন বলে দাবি করেন। অথচ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অস্বাভাবিক ভোট পড়ে। কমপক্ষে ১৯৭টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ে। আর অন্তত ১ হাজার ৮৮৯টি কেন্দ্রে ভোট পড়ে ৯৫ থেকে ৯৯.৯৯ শতাংশ।
বাংলাদেশে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিশাল ব্যবধানে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তবে এই নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের শেষ নাই। রাতের ভোট হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির জন্য দায়ী করে বিএনপির করা মামলায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদাকে গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ। বিএনপির চেয়ারপারসন খালাদা জিয়ার তিনটি আপিল আবেদনই নামঞ্জুর করে হুদা কমিশন। ফলে কেএম নূরুল হুদার কমিশন খালেদা জিয়াকে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে বিরত রাখে।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর কমিশনের সদস্য মাহবুব তালুকদার বিদায় বেলায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের ব্যর্থতার গ্লানি ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি। জাতীয় নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের অস্তিত্ব ছিল না। যদিও নূরুল হুদা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে বলে দাবি করেন।
২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর প্রথমবারের মতো এই নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল, ফলে সে বিবেচনায় ২০১৮ সালের এই জাতীয় নির্বাচনের একটা ভিন্ন দিক ছিল। তবে দলীয় সরকারের অধীনে নিয়ন্ত্রিত এবং একচেটিয়াভাবে নির্বাচন করার অভিযোগ ওঠে। এই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন এবং অভিযোগের পাল্লা অনেক ভারী হয়।
বিজ্ঞাপন
ভোটের দিন সারাদেশে সব ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু অনেক নির্বাচনী এলাকা থেকে বিএনপি এবং তাদের জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বেশ কিছু প্রার্থী ভোটের আগের রাতেই ভোটকেন্দ্র নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে নানা অভিযোগ তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। তাদের অভিযোগ ছিল, রাতেই বিভিন্ন কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোটের প্রার্থীর সমর্থকেরা ব্যালট পেপারে সিল মেরেছে। প্রায় সারারাতই বিরোধী প্রার্থীরা বিভিন্ন মিডিয়ায় টেলিফোন করে এমন অভিযোগ করছিলেন। তবে আগের রাতে সিল মারার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন কমিশনও এমন অভিযোগ মানতে রাজি হয়নি।
ভোট কেন্দ্রগুলো নিয়ন্ত্রিত ছিল
ঢাকার কেন্দ্রগুলোতে বাইরে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল সকাল থেকেই। অনেক কেন্দ্রের বাইরের পরিবেশ দেখে ভেতরের অবস্থা বোঝার উপায় ছিল না। ভোট শুরুর ঘণ্টাখানেক পর থেকেই অনেক কেন্দ্রের ভেতরে আওয়ামী লীগ বা তাদের জোটের প্রার্থীর সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে দেখা যায়।
বিজ্ঞাপন
সংসদ নির্বাচন ২০১৮ ফলাফল
আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জোটসঙ্গীরা ২৮৮টি আসন পায়। আর বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট পায় মাত্র সাতটি। বাকি তিনটি আসন পায় অন্যান্যরা। অনেক ভোট কেন্দ্রে একশো ভাগ ভোট পড়ে বলে ফলাফলে দেখা যায়। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর বাইরে অন্য কেউ ভোট পাননি অনেক কেন্দ্রে।
খালেদা জিয়াকে ভোটের মাঠ থেকে বিরত রাখার প্রধান কারিগর নূরুল হুদা
বিজ্ঞাপন
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচনের মাঠে রাখার জন্য মত দেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তবে কে এম নুরুল হুদা আপিল গ্রহণের বিপক্ষে মত দেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন কারাবন্দি খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল করে নুরুল হুদা। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন বলে মত দেন। কিন্তু ভিন্ন মত পোষণ করেন কমিশনার রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাহাদাত হোসেন। এরপর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদাও এই তিন নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। ফলে নির্বাচন কমিশনের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে খালেদা জিয়ার আপিল খারিজ হয়ে যায়। প্রায় ২০ মিনিট সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর মনোনয়নপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে ধরেন কে এম নূরুল হুদা।পরে বগুড়া-৬, ৭ ও ফেনী-১ আসনে খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়।
এদিকে বিতর্কিত ২০১৪ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনাররাও টার্গেটে রয়েছেন। যে কোনো সময়ে তাদেরকে আটক করতে পারেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গতকাল রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন আয়োজনকারী সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে বিএনপি। এদিন রাতে রাতে কে এম নূরুল হুদা আটক হন। যে কোনো মুহুর্তে বাকিরাও আটক হতে পারেন বলে জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
আওয়ামী লীগের দলীয় ও একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচন করে ‘ডামি ভোট’ উপাধি পায় কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। ওই কমিশনের বেশির ভাগ কার্যক্রম নিয়ে চরম বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। ওই নির্বাচনে ভোটের হার নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়। ভোটের দিন বেলা ৩টা পর্যন্ত ২৭ দশমিক ১৫ ভাগ ভোট পড়ে বলে জানানো হলেও ১ ঘণ্টার ব্যবধানে ভোটের হার ৪০ শতাংশ বলে উল্লেখ করা হয়। অবশ্য ভোটের হার ঘোষণার সময় সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল প্রথমে ২৮ শতাংশ ভোট পড়ার কথা বলে পরে তা সংশোধন করে ৪০ শতাংশের কথা বলেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বেকায়দায় পড়ে আউয়াল কমিশন। নতুন সরকারের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করে তারা কোনো সাড়া পায়নি। পরে গণমাধ্যমে একটি খোলা চিঠি লেখেন সিইসি হাবিবুল আউয়াল। তাতেও সাড়া না মিললে ৫ সেপ্টেম্বর সিইসিসহ অন্য কমিশনাররা পদত্যাগ করেন। এরপর থেকে হাবিবুল আউয়াল লোকচক্ষুর অন্তরালে অবস্থান করছেন। ওই কমিশনের নির্বাচন কমিশনার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান, মো. আলমগীর, রাশেদা সুলতানা ও মো. আনিছুর রহমান।
ভোট ছাড়াই ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগীদের বিজয়ী ঘোষণা করে বিতর্কিত নির্বাচনের নজির গড়েন কাজী রকিবউদ্দীন কমিশন। শেখ হাসিনার আমলে দলীয় সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচনের এ নজির গড়ে ওই নির্বাচন কমিশন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগ, তাদের সহযোগীসহ মাত্র ১২টি দল অংশ নিয়ে সরকার গঠন করে। ওই কমিশনের সিইসি ছিলেন কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। তার আমলে চারটি সিটি করপোরেশন ছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোও ছিল বিতর্কিত। কিন্তু তাতে তার অনুশোচনা দেখা যায়নি। বিদায়ি সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন-‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া দোষের কিছু নয়, আইনে আছে। আর কেউ মাঠ ছেড়ে দিলে তো প্রতিপক্ষ গোল দেবেই। এটা রাজনীতির খেলা। ওই সময়ে নির্বাচন কমিশনার ছিলেন মোহাম্মদ আব্দুল মোবারক, মোহাম্মদ আবু হাফিজ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাবেদ আলী ও মো. শাহনেওয়াজ।
নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুসারে ওই নির্বাচনে ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ১৬৭ ভোটারের মধ্যে ১৫৩ আসনে চার কোটি ৮০ লাখ ২১ হাজার ৯৮৩ ভোটারের ভোট দেওয়ার সুযোগই ছিল না। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীও ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি। বাকি ১৪৭ আসনের চার কোটি ৩৯ লাখ ৪৩ হাজার ১৮৪ ভোটারের মধ্যে ৬০ শতাংশ ভোটার ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।
বিজ্ঞাপন
এমওএস/এমএসএম
বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ - জাতীয়
- ১ বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতা রিয়াদের নেতৃত্বে ওই বাসায় যায় চাঁদাবাজরা
- ২ বাবার চোখের সামনে ছেলের প্রাণ কেড়ে নিলো বেপরোয়া ট্রাক
- ৩ দগ্ধ রোগীদের সর্বোত্তম চিকিৎসাসেবা দিতে সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ
- ৪ দগ্ধদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিশ্চিত করার নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার
- ৫ তরুণরাই ডিজিটাল রূপান্তরের প্রধান চালিকাশক্তি: ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব