একের পর এক অগ্নিকাণ্ড
তদন্ত কমিটির সুপারিশের শেষ নেই, বাস্তবায়ন ‘শূন্য’
বছরের পর বছর কমিটি হয়, বাস্তবায়ন হয় না কমিটির সুপারিশ/জাগো গ্রাফিক্স
গত অক্টোবর মাসে তিনটি বড় অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী হয়েছে দেশের মানুষ। ১৪ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুরে পোশাক ও কেমিক্যাল কারখানার আগুনে প্রাণ যায় ১৬ জনের। এর দুদিন পর চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের একটি কারখানা ভস্মীভূত হয়। সবশেষ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুনে ক্ষতি হয় শত শত কোটি টাকা।
দেশজুড়ে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে এমন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে—এসব দুর্ঘটনা কি শুধু অবহেলার ফল, নাকি এর পেছনে আছে অন্য কিছু?
প্রতিটি বড় অগ্নিকাণ্ডের পর গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। তারা কারণ অনুসন্ধান ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে নানান সুপারিশ দেয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের হার শূন্য বলা চলে। ফলে দায় নির্ধারণ বা জবাবদিহির কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাম্প্রতিক বছরগুলোর অগ্নিদুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা প্রস্তাব করতে উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু ওই কমিটির সুপারিশও আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
আগুনে মানুষের সবচেয়ে বেশি সমস্যা অসচেতনা ও সাবধান না হওয়া। ফায়ার সেফটি প্ল্যান না করলে আমরা বহুতল ভবনের অনুমতি দিচ্ছি না। কারণ ফায়ার সেফটি প্ল্যানের মধ্যে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র কী কী রাখতে হবে সেগুলো রয়েছে।- ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টাফ অফিসার (মিডিয়া) মো. শাহজাহান শিকদার
সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রতিবেদনে সরকারি কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের উদাসীনতা ও জবাবদিহির অভাবের বিষয়টি উঠে আসায় বাস্তবায়নে অনীহা দেখা দেয়।
বছরের পর বছর তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তাদের পরামর্শ ও সুপারিশ কাগজেই সীমাবদ্ধ। ফলে অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঘটছে, হারাচ্ছে প্রাণ ও সম্পদ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন- সুপারিশ বাস্তবায়ন ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত না হলে এ অগ্নিকাণ্ডের মিছিল থামবে না।

তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে ‘বিট পুলিশিং’র কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, রাজউক, বিদ্যুৎ বিভাগসহ দশটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘অগ্নিনিরাপত্তা সচেতন কমিটি’ গঠনের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু এক বছর পার হলেও এ বিষয়ে সরকারের কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (অগ্নি অধিশাখা) মোহাম্মদ শফিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি নতুন যোগদান করেছি। বিগত সময়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সুপারিশ বাস্তবায়নের ব্যাপারে আমি বলতে পারবো না। তবে বর্তমানে যেসব অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে সেগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নে কাজ করা হবে।’
আরও পড়ুন
পাঁচ বছরে দেশে ৯৯০ ‘উদ্দেশ্যমূলক’ অগ্নিকাণ্ড
নভেম্বরেই নতুন ইউনিফর্ম পাচ্ছে পুলিশ
এক আগুনেই গেলো ১৬ প্রাণ, কবে টনক নড়বে কর্তৃপক্ষের?
‘তথ্য গোপনের ফাঁদে’ বারবার মৃত্যুর মিছিলে ফায়ার ফাইটাররা
অতীতের সরকারগুলোর মতো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও কেন এসব বাস্তবায়ন করছে না—এমন প্রশ্নে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অগ্নি অনুবিভাগ) মোহাম্মাদ মফিজুর রহমান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি অথরাইজড নই, তাই কিছু বলতে পারবো না।’
গত ১৫ বছরের অগ্নিকাণ্ড ও তদন্ত কমিটির অনুসন্ধান-সুপারিশ
২০২৪ সালের ৪ এপ্রিল গঠিত তদন্ত কমিটি ২০১০ সাল থেকে বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ড পর্যন্ত অন্তত ৩১টি বড় অগ্নিদুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ২০২২ সালের ৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুন (নিহত ৪৯), ২০২১ সালের ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুড লিমিটেড কারখানা (নিহত ৫২), ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ার (নিহত ২৫) ও ২০২৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের গ্রিনকাজি কটেজ ভবন (নিহত ৪৬ জন)।
রাষ্ট্র যন্ত্রটাই ঠিকমতো কাজ করছে না। বিভিন্ন অধিদপ্তর বা বিভাগ থেকে সুপারিশগুলো যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু মন্ত্রণালয়গুলোতে ফাইল বন্দি অবস্থায় রয়ে যাচ্ছে।- ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহম্মেদ খান
কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, সরকারি ও বেসরকারি ১১টি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনে উদাসীনতা ও গাফিলতির কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি ক্রমাগত বাড়ছে।
কমিটির সুপারিশে বলা হয়- অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এজন্য প্রত্যেক বিট পুলিশিং এলাকার ভিত্তিতে ‘অগ্নিনিরাপত্তা সচেতন কমিটি’ গঠনের প্রস্তাব করা হয়, যাতে থাকবেন স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা, ফায়ার সার্ভিস প্রতিনিধি, রাজউক বা স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিভাগের কর্মকর্তা, কাউন্সিলর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মার্কেট কমিটির প্রতিনিধিরা।

এছাড়া আবাসিক ভবন ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নিরাপদ গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে রেটিকুলেশন সিস্টেম চালুর প্রস্তাব দেয় কমিটি। পাশাপাশি শহর ও শিল্পাঞ্চলের পুকুর-জলাধার সংরক্ষণের ওপর জোর দিয়ে বলা হয়, আগুন নেভাতে এসব জলাধার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবু একের পর এক ভরাট হয়ে যাচ্ছে। তাই এসব জলাধারের তালিকা তৈরি করে সরকারি গেজেটে প্রকাশ ও সংরক্ষণের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, অগ্নিকাণ্ডের পেছনে মূলত বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে অবহেলা, অনিরাপদ সংরক্ষণ, রাসায়নিক পদার্থের বিপজ্জনক ব্যবহার এবং স্থাপনার মালিকদের দায়িত্বহীনতা দায়ী।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভবন নির্মাণ সংস্থা, রাজউক ও অন্যান্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থা, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি।
সুপারিশে বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপকতার কারণ
নির্মাণকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান স্থাপনা নির্মাণের সময় অনুমোদিত নকশা অনুসরণ না করা এবং নকশা অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত নকশার যথাযথ বাস্তবায়ন তদারকি না করা, নির্মাণকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ফায়ার সেফটি প্ল্যান উপেক্ষা করা, অধিকাংশ উঁচু আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও গোডাউনগুলোতে ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা রাখা, বিদ্যুৎ লাইন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না করা, নকল বা মানহীন তার ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জমাদি ব্যবহার করা এবং অনুমোদিত লোডের চেয়ে বেশি লোড ব্যবহার করা।
এছাড়া অগ্নিকাণ্ডে বেশিরভাগ মানুষের মৃত্যু ঘটে ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে। এক্ষেত্রে ভবনের ক্যাটাগরি অনুযায়ী বহির্গমন পথ/লিফট না থাকা, পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন না রাখা এবং স্থাপনার ফায়ার করিডোর ও সব সিঁড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত না রেখে সেখানে বিভিন্ন মালামাল রেখে যাতায়াতে বিঘ্ন সৃষ্টি করা, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অননুমোদিত জায়গায় কেমিক্যাল গোডাউন স্থাপন এবং সেখানে কেমিক্যাল ও দাহ্য মজুত রাখা, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের নীতিমালা অনুযায়ী স্থাপনায় ফায়ার এক্সটিংগুইশার স্থাপন না করা এবং স্থাপন করলেও এর কার্যকারিতা নিয়মিত পরীক্ষা না করা, বাসিন্দা, সিকিউরিটি গার্ড, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অগ্নিনির্বাপণের মৌলিক জ্ঞান যেমন- ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহার, গ্যাস সিলিন্ডারের আগুন নেভানো পদ্ধতি তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োগ করতে না পারা, স্ট্রিট ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন না করা ও আগুন লাগার নিকটবর্তী স্থানে পর্যাপ্ত পানির সরবরাহ বা জলধারা না থাকা।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরও বহুবার অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে সুপারিশ দিয়েছে। কিন্তু অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। এ প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টাফ অফিসার (মিডিয়া) মো. শাহজাহান শিকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগুনে মানুষের সবচেয়ে বেশি সমস্যা অসচেতনা ও সাবধান না হওয়া। ফায়ার সেফটি প্ল্যান না করলে আমরা বহুতল ভবনের অনুমতি দিচ্ছি না। কারণ ফায়ার সেফটি প্ল্যানের মধ্যে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র কী কী রাখতে হবে সেগুলো রয়েছে।’
জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহম্মেদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাষ্ট্র যন্ত্রটাই ঠিকমতো কাজ করছে না। বিভিন্ন অধিদপ্তর বা বিভাগ থেকে সুপারিশগুলো যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু মন্ত্রণালয়গুলোতে ফাইল বন্দি অবস্থায় রয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘পরবর্তীসময়ে মন্ত্রণালয় থেকে ফলোআপ করা হয় না। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও আজ আছে কাল দেখা যাচ্ছে আরেক মন্ত্রণালয়ে চলে যাচ্ছেন। এতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চূড়ান্ত কাজের কাজ হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে।’
শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের তদন্তে ওইদিন রাতেই সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। কমিটি অগ্নিকাণ্ডের কারণ, ক্ষয়ক্ষতি ও কার কী দায়-দায়িত্ব ছিল তা নির্ধারণ করবে। গত ১৯ অক্টোবর কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ড তদন্তে স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনির নেতৃত্বে সাত সদস্যের কোর কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে আগামী ৫ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। একইদিন বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে।
ঘটনা তদন্তে গত ২০ অক্টোবর পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। পাঁচ সদস্যের এই তদন্ত কমিটির সভাপতি করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে। কমিটির সদস্যদের ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
এখন দেখার বিষয় কমিটির সুপারিশ আগের মতোই ফাইল বন্দি থাকবে নাকি আমলে নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া নেওয়া হবে। সময় এলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
টিটি/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম