ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

কার্টুন আঁকলে, মিম বানালে মামলা দেওয়ার চর্চা বন্ধ করতে হবে

জাগো নিউজ ডেস্ক | প্রকাশিত: ১১:১৫ এএম, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫

দেশের কার্টুনিস্ট, মিমারদের হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া হয় মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সারা হোসেন বলেছেন, একটা মানুষ কার্টুন আঁকলে, মিম বানালে তার নামে মামলা দেওয়া ও জেলে পাঠানোর চর্চা থেকে আমাদের বের হতে হবে। শুধু নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র সম্ভব হয় না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মানুষের মতামতকে সম্মান করতে হয়।

শনিবার (৬ ডিসেম্বর) সকালে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘স্যাটায়ার, মিম ও কার্টুন: মতপ্রকাশ নাকি মর্যাদাহানি’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় সারা হোসেন এসব কথা বলেন।

সারা হোসেন আরও বলেন, গণতান্ত্রিক চর্চার সবচেয়ে বড় উপাদান হলো অন্যদের কথা শোনা। তর্ক-বিতর্কে জড়ানো। তাদের কথাও শোনা যাদের কথা আপনার সহ্য হয় না, নিজের ওই সহনশীলতা চর্চা করা।

মিম কার্টুনের গুরুত্ব হচ্ছে, যাদের সঙ্গে সমান ক্ষমতার জায়গায় আপনি নেই, তাদের আপনি প্রতিরোধ করতে পারছেন, তাদের প্রশ্ন করতে পারছেন। সেজন্য সমাজে মিম ও কার্টুনের একটা স্পেস থাকা দরকার। কিন্তু তার মধ্যে সম্প্রতি এই মামলাটা দিয়ে এইগুলোকে সংকীর্ণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

স্যাটায়ারধর্মী ফেসবুক পেজ ‘e-আরকি’ এর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, স্যাটায়ার, মিম, কার্টুন বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে দীর্ঘদিন ধরে মতপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিগত সরকারের আমলেও যখন নানান বাধার কারণে মূলধারার বেশিরভাগ গণমাধ্যম নীরব ছিল তখনও ঝুঁকি নিয়ে সরকারের সমালোচনা করে গেছে মিম, স্যাটায়ার ও কার্টুন পেজগুলো। জুলাই গণভ্যুত্থানের সময়েও আমরা দেখেছি, আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল মিম, কার্টুন ও স্যাটায়ার। মিম, কার্টুন, গ্রাফিতি আর স্যাটায়ারে ভরে উঠেছিল শহরের দেয়াল। জুলাইয়ের পরও থেমে থাকেনি স্যাটায়ার। ক্ষমতাবানদের নিয়মিত প্রশ্ন করে গেছেন স্যাটায়ারিস্ট, মিমার, কার্টুনিস্টরা। হ্যাঁ, তাদের নিজস্ব 'হাতিয়ারের' মাধ্যমেই।

গত ২ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি সাদিক কায়েম বাদী হয়ে বেশকিছু মিম, স্যাটায়ার ও কার্টুন পেজের নামে মামলা দায়ের করেছেন। মিম পেজগুলোর নামে এই মামলা মতপ্রকাশ ও বাক-স্বাধীনতাকে নতুন এক হুমকির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাই, মিম, স্যাটায়ার, হিউমার, কার্টুন ও মর্যাদাহানির মধ্যে পার্থক্যটুকু জানার লক্ষ্যে নাগরিক কোয়ালিশন ও eআরকি যৌথভাবে স্যাটায়ারিস্ট, মিমার, রাজনীতিবিদ, কার্টুনিস্ট, হিউমারিস্ট, সাংবাদিক, আইনজীবী, অ্যাক্টিভিস্টের অংশগ্রহণে শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত হয় মতবিনিময় সভা।

কার্টুন আঁকলে, মিম বানালে মামলা দেওয়ার চর্চা বন্ধ করতে হবে

সভায় আলোকচিত্রী শহীদুল আলম বলেন, একটা সমাজে পরিবর্তন তখনই আসে যখন মানুষ ক্ষমতাবানদের প্রশ্ন করতে পারে। ক্ষমতাবানদের জবাবদিহিতার আওতায় আসতে হয়। তবে দুঃখজনক আমরা এই সংস্কৃতি থেকে অনেক দূরে আছি। বর্তমানে যারা সব থেকে ক্ষমতাবান রয়েছেন তাদের আরও উদার হওয়া উচিত।

শিক্ষাবিদ ও লেখক সুমন রহমান বলেন, তাদের (ক্ষমতাবানদের) বুঝতে পারা উচিত ছিল যখনই তাদের নিয়ে মিমগুলো ধারালো হয়ে উঠছে বা তাদের নিয়ে করা ক্যারিকেচার, কার্টুনগুলো আমাদের অন্য কারও কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে, সেটা তাদের (ক্ষমতাবান) জন্য একটা পরিষ্কার সিগন্যাল হওয়া উচিত।

সংগঠক প্রাপ্তি তাপসী বলেন, আপনি যখন এমন একটা রাষ্ট্রে বসবাস করবেন, যেখানে গণতন্ত্র এখনও পরিপূর্ণ না, সেখানে স্যাটায়ার, মিম করার অধিকার থাকবে না। অধিকার না থাকলে সমালোচনাটা করব কী দিয়ে? সমালোচনাই যদি করা না যায় তাহলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবে কীভাবে?

কার্টুনিস্ট মেহেদী হকের কথায় উঠে আসে সভ্যতার সঙ্গে সমালোচনা নিতে পারার সম্পর্ক। তার ভাষায়, আপনি যতটুকু সভ্য ততটুকু সহ্য করার ক্ষমতা আপনার থাকবে।

কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব হাসি, হাস্যরস ও স্যাটায়ারের গুরুত্ব তুলে ধরে অনুরণন করেন ফরাসি স্যাটায়ারিস্ট নিকোলাস চ্যাম্ফোর্টের বাণী, যে দিনটা আপনি হাসতে পারবেন না, সে দিনটা আপনার বৃথা গেল।

তিনি আরও বলেন, হিউমার এবং স্যাটায়ার বোঝার ক্ষেত্রে বর্তমানের তরুণ প্রজন্ম অনেক শার্প। বর্তমানের কার্টুনিস্টরাও ভালো কাজ করছেন। কিন্তু স্যাটায়ার করায় পেজগুলোর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়াটা ঠিক হয়নি। আমার ৪৮ বছর বয়সী সাময়িকী উন্মাদ পত্রিকার নামে এক কোটি টাকার মামলা হয়েছিল। পরে আমি গিয়ে মামলাকারীকে আমার কার্টুনটি বুঝাই। এরপরে তিনি মামলা তুলে নেন। অবশ্য মামলা তুলে নেওয়ার পরে দুইবছর তার বাসায় নিয়মিত আমাকে ফ্রিতে পত্রিকা পাঠাতে হয়েছে।

মিম গবেষক সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ তুলে ধরেন মিম, স্যাটায়ার আটকে দেওয়ার ভয়াবহতা। তার ভাষায়, আপনি যখন মিম, কার্টুন আটকে দেন, তখন মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। শেখ হাসিনাও সেটা বোঝেন নাই।

লেখক ও গবেষক ফিরোজ আহমেদ বলেন, যে মামলাটা হয়েছে এই মামলাগুলোর মাধ্যমে স্যাটায়ার ও নারী নিপীড়ন ও হেনস্থাকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। এবং স্যাটায়ারকে হেনস্থার সঙ্গে তুলনা করে আবারও পুরোনো রেজিমের মতো যেকোনো বিরোধীতাকে মুখ বন্ধ করার একটা বন্দোবস্ত তৈরি করা হচ্ছে।

স্যাটায়ারের সীমা ঐ পর্যন্ত যেখান থেকে যৌন নিপীড়ন শুরু হয়, যেখান থেকে হুমকি শুরু হয়, যেখান থেকে হেনস্থা শুরু হয়। এর আগ পর্যন্ত আপনাকে স্যাটায়ার সহ্য করে যেতে হবে।

এই ধরনের ঘটনায় দেখা যায়, আদালতের অপরাধ প্রমাণ হওয়ার আগে, আদালত থেকে শাস্তি দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি একটা বিশাল শাস্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। আইনি হেনস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। আমি আশা করব যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাদের জন্য একটা বন্দোবস্ত রেখে যাবে যেখানে এই ধরনের মামলা প্রমাণ হওয়ার আগে কেউ যেন মাসের পর মাস গ্রেফতার না থাকেন, তাকে যেন আইনি হেনস্থার শিকার হতে না হয়। একই সঙ্গে যারা মামলাটি করছেন, যেসব আইনি কর্মকর্তা এই ধরনের মামলায় কার্টুনিস্ট, মিমার, স্যাটায়ারিস্টদের হেনস্থা করছেন তাদের যেন জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়। যারা মানুষকে এই ধরনের নিপীড়নের মধ্যে ফেলছেন তাদের কী শাস্তি হবে তারও একটা ব্যবস্থা হওয়া দরকার, বলে মন্তব্য করেন ফিরোজ আহমেদ।

সমাপনী বক্তব্যে eআরকির সম্পাদক ও স্যাটায়ারিস্ট সিমু নাসের বলেন, যে অবস্থা আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমরা যারা ইন্ডিভিজুয়্যাল ক্রিয়েটর আছি বা প্রাতিষ্ঠানিক ক্রিয়েটর আছি তারা কি ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে এরপর কাজ করবে? আজকে যে কার্টুনটা বা মিমটা কোনোভাবে কারও অবমাননাকর মনে হচ্ছে না বা কুরুচিপূর্ণ মনে হচ্ছে না কিন্তু ৫ বছর পর যদি কারও এমন মনে হয় সে কি তাহলে মামলা করতে পারবে? এই ভাবনাটা নিয়েই যদি কাজ করতে হয় তাহলে ক্রিয়েটররা তো কিছু ক্রিয়েটই করতে পারবে না। আইন বলছে, কুরুচিপূর্ণ মিম বা কার্টুন করা যাবে না, এই কুরুচিটা আসলে কে নির্ধারণ করবে? পুলিশ নির্ধারণ করবে? আদালত নির্ধারণ করবে নাকি যে মামলা করছে সে নির্ধারণ করবে?

ক্রিয়েটিভিটির কোনো বাঁধা থাকা আসলে উচিত নয়। কোনো আইনি কাঠামোই যেন আমাদের সৃজনশীল চিন্তায় দেয়াল না হয়ে দাঁড়ায়। বলেন সিমু নাসের।

সভায় উপস্থিতগণ দ্ব্যর্থকণ্ঠে বলেন, কার্টুন, মিম ও স্যাটায়ারের ওপর এই হয়রানিমূলক মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা হোক। কনটেন্ট নির্মাতা শিক্ষার্থী, পেশাজীবীদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা হোক। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের কাছে সবাই আহ্বান জানান, বাক-স্বাধীনতা রক্ষায় রাষ্ট্রের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ আমরা সবসময়ের জন্য দেখতে চাই।

এমএমএআর/জেআইএম