শাপলা চত্বরে হত্যা: নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানালেন প্রেস সচিব
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম/ছবি ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
২০১৩ সালের ৫ মে রাতে সংঘটিত শাপলা চত্বরের বর্বরতার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা জানালেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
সোমবার ( ৮ ডিসেম্বর) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি তার অভিজ্ঞতার বিস্তারিত তুলে ধরেন।
ফেসবুকে তিনি লেখেন, ২০১৩ সালের ৫ মে রাতে প্রথমবারের মতো শাপলা চত্বর অভিযানের মৃত্যুসংবাদের খবর আসতে শুরু করে। পল্টন, বিজয়নগর, নাইটিঙ্গেল মোড় ও মতিঝিলের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ চলছিল। সে সময় এএফপির ঢাকা অফিস ছিল দিলকুশা-মতিঝিলের তৎকালীন শিল্প ব্যাংক ভবনে (বর্তমানে বিডিবিএল ভবন)। অফিসের জানালা থেকে দেখা যাচ্ছিল শাপলা চত্বরে এবং আশপাশের প্রধান সড়কজুড়ে লক্ষাধিক হেফাজত সমর্থকের সমাবেশ। মধ্যরাতের দিকে শাপলা চত্বরে একটি বা দুইটি মরদেহ আসে। কোথায় বা কীভাবে তাদের মৃত্যু হয়েছে- প্রথমে কিছুই পরিষ্কার ছিল না।
তিনি লেখেন, রাত ৮টার দিকে আমরা প্রথম বড় সংবাদ পাই- ছয় হেফাজত সমর্থকের মরদেহ এসেছে। যাদের প্রত্যেকের মাথায় গুলি লেগেছিল। শাহিদবাগ-মালিবাগের বারাকা জেনারেল হাসপাতালে তাদের মরদেহ নেওয়া হয়। আমার সহকর্মী কামরুল এ তথ্য নিশ্চিত করতে বারবার হাসপাতালে ফোন করেন। অনেক চেষ্টার পর হাসপাতাল ব্যবস্থাপক মৃত্যুর ঘটনা নিশ্চিত করেন। খবরটি তাৎক্ষণিকভাবে ‘রেড অ্যালার্ট’ শিরোনামে ছাপানোর ইচ্ছে থাকলেও নিউ দিল্লিতে থাকা আমাদের ব্রিটিশ সম্পাদক দ্বিতীয় নিশ্চিত সূত্র না পাওয়া পর্যন্ত সংবাদ প্রকাশ না করার নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর দেখা যায় আমাদের হিসেব স্থানীয় পত্র-পত্রিকা বা টেলিভিশনে প্রকাশিত হতাহতের সংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি।
শফিকুল আলম লেখেন, পরদিন কাকরাইলে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে আরও মরদেহের তথ্য পাওয়া যায়। সংখ্যা বাড়তেই থাকে। এরপর নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর-সিদ্ধিরগঞ্জ অঞ্চলে বড় ধরনের হত্যাকাণ্ডের খবর আসে। ভোরে পুলিশের অভিযানে ছত্রভঙ্গ হওয়া হেফাজত সমর্থকদের অনেকেই হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন, কারণ গণপরিবহন বন্ধ ছিল। আমরা জানতে পারি, এ সময় বিজিবি সদস্যরা তাদের লক্ষ্য করে সরাসরি গুলি ছোড়েন। গুলিতে প্রায় ২০ জন নিহত হয়। আমরা নারায়ণগঞ্জের সব হাসপাতালেই মরদেহগুলো শনাক্তে সন্ধানে অব্যাহত রাখি। পুলিশ ও বিজিবি কেউ বিস্তারিত বলতে রাজি না হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে।
স্ট্যাটাসে প্রেস সচিব আরও লেখেন, ঢাকায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতারা, আইজিপি ও ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ অভিযানে কারও মৃত্যুর খবর দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। তারা দাবি করেন- দেশকে ‘তালেবানীকরণ’ থেকে রক্ষা করা হয়েছে এবং ন্যূনতম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু মৃতের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। যখন পুলিশের পক্ষ থেকে মাত্র সাতজনের মৃত্যুর কথা বলা হচ্ছিল, তখন আমাদের তালিকা ইতোমধ্যে ৪৯-এ পৌঁছায়। আমরা জানতাম- সরকার আমাদের তথ্য চ্যালেঞ্জ করবে। তাই প্রতিটি মৃত্যুর ক্ষেত্রে আমরা উৎসের নাম প্রকাশ করি, যা প্রতিবেদনকে আরও প্রমাণসমৃদ্ধ করে তোলে, যদিও তা উপস্থাপনাকে জটিল করে।
তিনি লেখেন, ‘শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড’ মূলত মতিঝিল কেন্দ্রিক ওই অভিযানে সংঘটিত মৃত্যুকে বোঝাতে ব্যবহৃত একটি পরিচিত টার্ম। পরবর্তীতে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার- এ সংখ্যা আনুমানিক ৬০ বলে উল্লেখ করা হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচও স্বাধীন অনুসন্ধানে প্রায় একই তথ্য নিশ্চিত করে। পরে জানা যায়- সেই রাতে পল্টন ও আশপাশের এলাকায় বহু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল ক্ষমতাসীন দলের যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র সদস্যদের হাতে। তাদের মধ্যে দুজনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম- জাহিদ সিদ্দিক তারেক ও রিয়াজ মিলকি। পরবর্তীতে তারেক নিজেই মিলকিকে এক বাজারের সামনে গুলি করে হত্যা করে, যা সিসিটিভিতে ধরা পড়ে। পরে র্যাবের অভিযানে ‘ক্রসফায়ারে’ তারেক নিহত হয়।
শেষে প্রেস সচিব লেখেন, এরপর এগারো বছর ধরে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে আওয়ামী লীগ বারবার একই পদ্ধতি অনুসরণ করে- দলীয় যুব ও ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে হামলা, ভয়ভীতি ও হত্যা চালিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের জুলাইয়ে জনতার তীব্র প্রতিরোধের মুখে সেই চক্র থেমে যায়।
এমইউ/এএমএ/জেআইএম