ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

মধ্যপ্রাচ্যে ভাষা না জানার খেসারত দিচ্ছেন বাংলাদেশি কর্মীরা

রায়হান আহমেদ | প্রকাশিত: ১০:০৩ এএম, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫

চলতি বছরের ৫ এপ্রিল ফ্রি ভিসায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে যান লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা আল-আমিন। চুক্তি অনুযায়ী দালাল কাজের প্রতিশ্রুতি দিলেও গত তিন মাসে কাজ জোগাড় করতে পারেননি তিনি। সৌদি কোম্পানি ও বাংলাদেশি বিভিন্ন নিয়োগদাতার দ্বারে দ্বারে ঘুরেও পাননি কাজ। এজন্য আরবি ভাষা না জানা ও দক্ষতার অভাবকে দায়ী করেন আল-আমিন।

গত ৫ ডিসেম্বর জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘ভাষা শিখে আসিনি। কিন্তু দেশে থাকতে রাজমিস্ত্রি থেকে শুরু করে অ্যালুমিনিয়ামের কাজ মোটামুটি করেছি। বিভিন্ন কারখানায়ও কাজ করেছি। এখানে ভাষা না জানা ও বোঝার কারণে বিপদে পড়েছি। আমি যেসব কাজ পারি সেসব বুঝিয়ে বলতে পারি না। প্রতিবেশীর সঙ্গে একবার এক কারখানায় গেলেও সেখানে একদিন কাজ করার পর তারা বাদ দিয়ে দেয়। ভাষা না জানার কারণে অনেক দুর্ব্যবহার সহ্য করেছি।’

শুধু আল-আমিন নন, মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত লাখো কর্মী প্রবাস জীবনে এমন পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন। আরবি ভাষা না বোঝা কিংবা নিজে না বলতে পারার খেসারত দিচ্ছেন তারা। সরকারের পক্ষ থেকেও বিশেষ উদ্যোগ নেই এ সমস্যা সমাধানে।

চলতি বছরের মার্চ মাসে কাজের উদ্দেশ্যে কাতার যান নোয়াখালীর বাসিন্দা ইয়াসির হামিদ। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘আত্মীয়ের কাছ থেকে ভিসা নিয়েছি। বলেছে একটি দোকানে কাজের ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু যাওয়ার পর তারা কাজের ব্যবস্থা করে দেয়নি। পরিস্থিতি এমন হয়েছে, নিজের কাজ নিজেকে খুঁজতে হচ্ছে। নতুন হওয়ায় আমার ভাষাগত দক্ষতা নেই বললেই চলে। পরিচিত বাংলাদেশিদের বলা হলেও কেউ চাকরি ম্যানেজ করে দিতে পারেনি।’

আরও পড়ুন
বিদেশে থাকায় অধরা মানবপাচারের মূলহোতারা
নিজেরাই প্রশিক্ষণ দিয়ে বিনা খরচে কর্মী নেবে জাপান
সচল হচ্ছে ইরাকের শ্রমবাজার, যাওয়ার অপেক্ষায় ২ হাজার কর্মী
ভাষা ও দক্ষতায় পাস করলেই নামমাত্র খরচে জাপান

তিনি বলেন, ‘আমি এসএসসি পাস করে এসেছি, ভাষার প্রয়োজনীয়তা দেশে থাকতে বুঝিনি। একটা কার্পেটের দোকানে কাজের সুযোগ হলেও কাস্টমারের বাসায় গিয়ে মাপ নিয়ে আসা, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অর্ডার কনফার্মসহ এমন বিষয় হ্যান্ডেল করতে না পারায় সেই চাকরিটা একমাসও করতে পারিনি। এখন মাঝে মধ্যে কনস্ট্রাকশনের কাজে যাই, না পারলেও করি। তবুও নিজের খরচ চালাতে কষ্ট হচ্ছে।’

দালালরা মাত্র তিন মাসের ভিসায় কর্মীদের নিয়ে আসেন। পরে কাজও দেন না, ইকামাও করে দেন না। ফলে প্রথম দিকে শ্রমিকরা কাজ পান না, অনেক দক্ষতা থাকলেও ভাষা না জানার কারণে ভালো চাকরি ও বেতন পান না।–সৌদির পান্ডা কোম্পানিতে কাজ করা তৌহিদুর রহমান

বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর যাওয়া বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের সিংহভাগের গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। বিশেষ করে উপসাগরীয় সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, ওমান ও আরব আমিরাত। এসব দেশের প্রধান ভাষা আরবি হওয়ায় ন্যূনতম ভাষাগত দক্ষতা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রায় ৯৫ শতাংশ দেশগুলোতে ভাষা না শিখে যান। এতে নানান চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে তারা বিদেশে কাজ করেন। আরবি ভাষা শেখায় কর্মীদের আগ্রহ কম। পাশাপাশি সরকারের উদ্যোগও পর্যাপ্ত নয়।

এ ভাষাগত অদক্ষতার ফল ভোগ করতে হচ্ছে বিদেশের মাটিতে। স্থানীয়দের সঙ্গে যোগাযোগে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই দক্ষ কাজের সুযোগ হারিয়ে কম বেতনের ‘অড জব’ করতে বাধ্য হন। এতে ব্যক্তি পর্যায়ে আয় কমে যায়, আর দেশের রেমিট্যান্সেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

মধ্যপ্রাচ্যে আরবি ভাষা জানা বাংলাদেশি শ্রমিকদের ভাষ্য, এক বছর থাকার পর কর্মীরা ন্যূনতম আরবি ভাষা বুঝতে শুরু করেন। যেহেতু এজেন্সির প্রতারণা বাড়ছে, এখানে এলে কর্মীরা কাজ পান না, ইকামা করে দেওয়া হয় না- সেক্ষেত্রে প্রথম ছয় মাস টিকে থাকা কিংবা চাকরি পাওয়ার জন্য ন্যূনতম আরবি শিখে আসা উচিত।

প্রবাসে প্রথম ৩ মাস হিমশিম খাচ্ছেন শ্রমিকরা

সৌদি আরবের বিখ্যাত পান্ডা কোম্পানিতে গত ছয় বছর ধরে কাজ করছেন তৌহিদুর রহমান। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘বিদেশে যারা নির্দিষ্ট কোম্পানিতে কাজের ভিসায় আসে, তাদের ভাষা নিয়ে ভুগতে হয় না। কোম্পানির ডিমান্ড অনুযায়ী শ্রমিক নেয়। কিন্তু এখন অধিকাংশ দালাল আর সাপ্লাই কোম্পানির খপ্পরে পড়ে। ফলে প্রতিশ্রুত কাজ না পেয়ে তারা কাজ খুঁজতে গিয়ে ভাষা না জানার কারণে নানা ভোগান্তির শিকার হন।’

তিনি বলেন, ‘দালালরা মাত্র তিন মাসের ভিসায় কর্মীদের নিয়ে আসেন। পরে কাজও দেন না, ইকামাও করে দেন না। ফলে প্রথম দিকে শ্রমিকরা কাজ পান না, অনেক দক্ষতা থাকলেও ভাষা না জানার কারণে ভালো চাকরি ও বেতন পান না।’

আমরা আরবি ভাষার কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছি। প্রথম দিকে ২৬টি টিটিসিতে শুরু করবো। তিন মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ এটা। যেন ন্যূনতম কথা বলার মতো অবস্থান হয়, অ্যারাবিয়ানদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। এক্ষেত্রে কর্মীদেরও আগ্রহী হতে হবে।- জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ দপ্তরের ব্যুরোর পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও পরিচালনা) প্রকৌশলী মো. সালাহউদ্দীন

মধ্যপ্রাচ্যে থাকা কয়েকজন শ্রমিক জাগো নিউজকে জানান, সাধারণত ছয় মাস কিংবা এক বছর পর কর্মীরা মোটামুটি ভাষা বোঝেন। ধীরে ধীরে পারস্পরিক যোগাযোগ করার মতো সক্ষমতা অর্জন করেন। কিন্তু প্রথম দিকে এসেই অসহনীয় ভোগান্তিতে পড়তে হয় ভাষার অদক্ষতা ও দালালদের কারণে।

সৌদির জেদ্দা শহরে বসবাস করা আলমগীর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘দালাল এনে আর কেজ দেয়নি। তিন মাস পর ইকামা না দেওয়ায় অবৈধ হয়ে যাই। এখানে প্রথম দিকে সৌদির কার্ড না থাকায় রাস্তায় বের হলে পুলিশে ধরতো, আরবি-ইংরেজি কিছুই পারি না। দুবার মাফ চেয়ে ছাড়া পেয়েছি। কাজ নেই, টাকা নেই- নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়েছে। দেশ থেকে যদি কিছুটা ভাষা শেখার ব্যবস্থা আর দালালরা প্রতারণা না করতো তাহলে খুব ভালো করে চাকরি করতে পারতাম।’

তিনি বলেন, ‘এজেন্সিগুলো শুধু আমাদের এনে ছেড়ে দেয়, আর কোনো খোঁজ-খবর রাখে না। আমাদের ইকামা দেওয়া, কার্ড করে দেওয়া, কাজ পাইয়ে দেওয়া- কোনো কিছুই তারা করে দেয় না। এসব কিছু সামলাতে শুরুর দিকে ভাষা জানতে হয়। না হলে ভোগান্তিতে পড়তে হয়।’

আরবি ভাষা শেখানোর উদ্যোগ নেই বিএমইটির
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সবশেষ পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশ যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ৩৯ লাখ ৭৮ হাজার ৫৬২ জন। এর মধ্যে উপসাগরীয় অঞ্চলের ছয়টি দেশে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ৩২ লাখ আট হাজার ৮৮ জন। এছাড়া চলতি (২০২৫ সাল) বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে উপসাগরীয় অঞ্চলের ছয়টি দেশে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ৮ লাখ ২৩ হাজার ১৭৭ জন। এর মধ্যে শুধু সৌদি গেছেন ৬ লাখ ৭০ হাজার ৭৬৭ জন।

এর আগে ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সৌদি আরবে ২৩ লাখ ৫৮ হাজার ৯৫ জন। কাতারে গেছেন এক লাখ ৬৯ হাজার ৯৬৮ জন, কুয়েতে ৯৩ হাজার ৬৮৪ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে দুই লাখ এক হাজার ৭০২ জন, ওমানে তিন লাখ ৮৪ হাজার ৬১৬ জন ও বাহরাইনে ২৩ জন কর্মী গেছেন।

বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি সিংহভাগ উপসাগরীয় আরবিভাষী এই ছয়টি দেশে হলেও বাংলাদেশে ১১০টি টিটিসি সেন্টারের কোথাও নেই আরবি ভাষার প্রশিক্ষণ। বিএমইটির ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে বিভিন্ন ভাষা শেখানোর উদ্যোগ থাকলেও নেই আরবি ভাষা শিক্ষক এবং আধুনিক শিখনব্যবস্থা। ফলে কর্মীরা বিদেশ যাত্রার আগে প্রয়োজনীয় ভাষা দক্ষতা অর্জন করতে পারছেন না।

ন্যূনতম যোগাযোগ সক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে আরবি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অধিক সংখ্যক দক্ষ ভাষা শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে কোনো আরবি ভাষার শিক্ষক আনা যেতে পারে।- অভিবাসন ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর

বিএমইটিএর অধীনে নোয়াখালী জেলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ ওয়ালিউল্লাহ মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের এখানে আরবি শেখানো হয় না। ভাষা শিখে গেলে তো শ্রমিকদের জন্য ভালো। কিন্তু সেই উদ্যোগ নেই। কর্মীরা বিদেশ যাওয়ার আগে আমাদের তিনদিনের পিডিও (প্রি-ডিপার্চার ওরিয়েন্টশন) কোর্সের সময় একটা ছোট আরবি ভাষার বই দেওয়া হয়। এই বইয়ে ন্যূনতম যোগাযোগের জন্য আরবি ভাষা রয়েছে। ইনিশিয়ালি মুভ করার জন্য কর্মীরা আরবির পাশাপাশি বাংলা দেখে কথা বলতে পারবে। তবে আমরা বিএমইটিকে চিঠি দিয়েছি আরবি ভাষা শিক্ষার কার্যক্রম শুরু করার জন্য।’

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ দপ্তরের ব্যুরোর পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও পরিচালনা) প্রকৌশলী মো. সালাহউদ্দীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা আরবি ভাষার কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছি। প্রথম দিকে ২৬টি টিটিসিতে শুরু করবো। তিন মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ এটা। যেন ন্যূনতম কথা বলার মতো অবস্থান হয়, অ্যারাবিয়ানদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। এক্ষেত্রে কর্মীদেরও আগ্রহী হতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের বিদেশ যেতে ইচ্ছুক কর্মীরাও ভাষা শেখা ও দক্ষতার প্রতি অমনোযোগী। যেসব ভাষা চালু আছে, সেখানেও কর্মীদের উপস্থিতি কম।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিবাসন ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘ন্যূনতম যোগাযোগ সক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে আরবি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অধিক সংখ্যক দক্ষ ভাষা শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে কোনো আরবি ভাষার শিক্ষক আনা যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আরবি ভাষার ও আঞ্চলিক ভাষা আছে, বহু শ্রমিক ছোট শহরে গেলে এসব ভাষা বোঝেন না। সেজন্য আরব দেশ থেকে ১৫ থেকে ২০ বছর কাজ করে দেশে চলে এসেছেন, এমন লোকদেরও প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকার চাইলে আরব দেশগুলোতে যেতে আরবি ভাষাকে বাধ্যতামূলক করতে পারে, সেক্ষেত্রে ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার জন্য কর্মীদের আরবি ভাষার সার্টিফিকেট জরুরি করতে হবে। অভিবাসন ব্যবস্থা টেকসই রাখতে হলে ভাষা শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এখনই। এক্ষেত্রে আমাদের কর্মীরা যারা আরব দেশগুলোতে যেতে ইচ্ছুক তাদের অবশ্যই আরবি ভাষা শেখার মানসিকতা থাকতে হবে। এজন্য শ্রমিকদের সচেতন হওয়া খুবই জরুরি। তারা চাইলে বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে ভাষা শিখতে পারে।’

আরএএস/এএসএ/এমএফএ/এমএস