অসময়ে সড়কে ঝাড়ু, ধুলাদূষণে অতিষ্ঠ ঢাকা দক্ষিণের নাগরিকরা
জাগো নিউজ গ্রাফিক্স
রোববার (২৮ জানুয়ারি) রাত ৯টা। পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোড। সড়কে রিকশা, ঠেলাগাড়ি, ভ্যান ও পিকআপের জটলা। এর মধ্যে দুপাশে সারিবদ্ধভাবে সব ধরনের দোকানপাট খোলা। ঘুরে ঘুরে নিজেদের পছন্দমতো পণ্য কেনাকাটা করছেন ক্রেতারা। অনেকে অফিস-আদালত বা কর্মস্থলে কাজ শেষে হেঁটে, রিকশায় করে ফিরছেন বাসায়।
এরই মধ্যে হাতে ঝাড়ু নিয়ে সড়ক পরিচ্ছন্নতা শুরু করলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পরিচ্ছন্নতাকর্মী সংগীতা দাস। মুহূর্তেই ধুলা বাতাসে উড়ে চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেলো। ধুলা থেকে বাঁচতে মুখে হাত, মাস্ক, রোমাল চেপে ছুটতে থাকেন পথচারীরা। পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে বকতে থাকেন দোকানিরাও।
পথচারী ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, নগর পরিস্কারের নামে নাগরিকদের ভোগান্তির সৃষ্টি করছে ডিএসসিসি। প্রতিদিন রাত ৯টার পর থেকেই তারা সড়ক ঝাড়ু দেওয়ার নামে শহর আরও নোংরা করছে। অথচ রাত ১১-১২টা পর্যন্ত সড়কে মানুষের চলাচল থাকে। খোলা থাকে পাড়া-মহল্লার দোকনপাটও। এতে সড়কে ঝাড়ু দেওয়ার পর আবার নোংরা হয়। তাই সড়ক ঝাড়ু দেওয়ার সময় পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
আরও পড়ুন>> একবছরে ঢাকায় গড়ে বায়ুদূষণ বেড়েছে ৯.৮ শতাংশ
ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিএসসিসি এলাকায় রাত ৮টা থেকে শপিংমল, সব ধরনের দোকানপাট, ব্যবসায়িক বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, কাঁচাবাজার, মার্কেট এবং রাত ৮টা থেকে খাবার দোকান ও রেস্তোরাঁ বন্ধ করতে নির্দেশনা রয়েছে। সে অনুযায়ী রাত ৯টা থেকে সব ওয়ার্ডে একযোগে রাস্তাঘাট ঝাড়ু দেওয়া হয়। ভোর হওয়ার আগেই সব সড়ক পরিস্কার করে বর্জ্য সরিয়ে নেওয়া হয়।
তবে ডিএসসিসির এ সিদ্ধান্ত পরিবেশ ও জনবান্ধব নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা কোন গবেষণার আলোকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেন তা আমার বোধগম্য নয়। রাত ৯টা থেকে রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার ওই সিদ্ধান্ত জনবান্ধব নয়।’
তিনি বলেন, রাত ৯টায় সড়ক ঝাড়ু দেওয়ার ফলে মানুষ সরাসরি দূষিত বাতাসে প্রভাবিত হচ্ছে। সড়কে যানবাহন চলায় সেই ধুলা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। আবার সড়ক একদিক থেকে পরিস্কার করলে আরেকদিকে নোংরা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ডিএসসিসিকে আরও ভাবতে হবে।’
আরও পড়ুন>> বায়ুদূষণ চরমে, ঢাকায় সতর্কতা জারি করতে চিঠি
একই শহরে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায়। ডিএনসিসি কর্মীরা রাত ৩টা থেকে রাস্তা পরিস্কারের কাজ শুরু করেন। সূর্য ওঠার আগেই ঝাড়ুর কাজ শেষ করেন। এরপর সকাল ৯টা পর্যন্ত ভ্যানে করে ময়লা-আবর্জনা সরিয়ে নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সংশ্লিষ্টরা।
ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্র জানায়, ১০৯ দশমিক ২৫১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত ডিএসসিসি। সংস্থাটির ৭৫টি ওয়ার্ডে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ বাস করে। ডিএসসিসি এলাকায় ৯৯৩ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার সড়ক ও ২১৭ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার ফুটপাত রয়েছে। এই সড়ক, ফুটপাত প্রতিদিন পরিস্কারে প্রত্যেক ওয়ার্ডে একজন করে পরিদর্শকসহ প্রায় পাঁচ হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মী আছেন। তারাই রাস্তা পরিস্কারে ঝাড়ু দেন।
২৯ জানুয়ারি রাত ১০টা। খিলগাঁও স্টাফ কোয়ার্টার এলাকা। সড়কে প্রচুর যানবাহন চলছে। ফুটপাত ধরে হাঁটছেন পথচারীরা। সড়কের দুপাশের দোকানপাটও খোলা। তখন লম্বা ঝাড়ু নিয়ে সড়ক ঝাড়ু দিতে নামেন ডিএসসিসির আরেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী মনির হোসেন। এতে ধুলাবালি বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ধুলা থেকে বাঁচতে কয়েকটি দোকান সাটার নামিয়ে দেয়। পথচারীরাও নাক-মুখ ঢেকে দ্রুত স্থান ছাড়েন।
আজিমপুর বটতলা এলাকার বাসিন্দা জহিরুদ্দিন। তিনি ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন। জহিরুদ্দিন বলেন, ‘সেবা সংস্থা হিসেবে সিটি করপোরেশনের যে কয়েকটি কাজ রয়েছে, তার মধ্যে রাস্তাঘাট ঝাড়ু তথা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অন্যতম। আর এ কাজটি পরিচালনার জন্য গৃহ করের সঙ্গে নাগরিকদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি নেয় সংস্থাটি। কিন্তু ঠিক এ কাজটিই ঠিকমতো করতে পারে না তারা। অসময়ে সড়ক ঝাড়ু দিয়ে পথচারীদের জামাকাপড় নোংরা করে। আর ধুলাবালিতে নাগরিকদের নানা ধরনের রোগ ছড়ায়।’
আরও পড়ুন>> দূষণে ঢাকার পরিণতি আরও ভয়াবহ হবে
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ঢাকা সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাত ৩টায় সড়ক পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করতেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। এতে সকালে একটি ফ্রেশ পরিবেশন পেতেন নাগরিকেরা। কিন্তু ২০২০ সালে শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পর সড়ক পরিস্কারের সময় এগিয়ে আনেন। এখন তার নির্দেশনা অনুযায়ী রাত ৯টা থেকে রাস্তাঘাট ঝাড়ু দেওয়া শুরু হয়। পরে রাত ২টার মধ্যে কাজ শেষ করে বাসায় চলে যান পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা।’
‘কিন্তু ঢাকার প্রায় সব সড়কেই রাত ১২টা-১টা পর্যন্ত মানুষের চলাচল থাকে। ফলে দেখা গেছে সড়ক ফের নোংরা হচ্ছে। এছাড়া অনেক দোকানি রাতে দোকান বন্ধের আগে ঝাড়ু দিয়ে নিজের দোকানের ময়লা সড়কে ফেলেন। বিষয়টি ডিএসসিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হলেও তারা কোনো উদ্যোগ নেননি।’
পুরান ঢাকার ওয়ারী, কাপ্তানবাজার এলাকাটি ডিএসসিসির ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন। এই ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক মো. বাহা উদ্দিন। আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা রাত ৯টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্তই মাঠে থাকে। তবে পুরান ঢাকার দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মধ্যরাত পর্যন্ত খোলা থাকায় একটু সমস্যা হয়। দেখা যায়, এখন ঝাড়ু দিয়ে গেলেও এক ঘণ্টা পর আবার সড়কে ময়লা ফেলেন অনেকে। তাই আমার ওয়ার্ডের প্রতি কিলোমিটারের দুজন করে পরিচ্ছন্নতাকর্মী দায়িত্ব পালন করেন। রাত ৯টায় প্রথম দফায় ঝাড়ু দেওয়ার পর আবার সড়কে ময়লা ফেললে তা পরিস্কার করেন তারা।’
জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা নাছির আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে মাঝ রাতে ঘুম থেকে উঠে অনেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী সময়মতো কাজ শুরু করতে পারতেন না। তাই প্ল্যান করেই রাত ৯টা থেকে রাস্তাঘাট পরিস্কারের নিয়ম করা হয়েছে। ফলে ভোর হওয়ার আগেই নগরী পরিস্কার করা সম্ভব হয়।’
তিনি বলেন, ‘সড়ক ঝাড়ু দেওয়ার পর অনেক দোকানি, পথচারী ময়লা-আবর্জনা ফেলে। এতেই সড়ক নোংরা হয়। আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা বা চারপাশ পরিস্কার রাখলে শহর নোংরা হবে না। তারপরও সড়ক পরিস্কারের সময় পুননির্ধারণ করা যায় কি না, তা নিয়ে ভাববো।’
এমএমএ/এএসএ/জেআইএম