বাবাকে বলেছিলাম বিসিএস দিলে চয়েস দেবো একটাই ‘পুলিশ’
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাদিয়া ফারজানা/জাগো নিউজ
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাদিয়া ফারজানা। কর্মরত ট্যুরিস্ট পুলিশে। ছোটবেলা থেকেই মায়ের ইচ্ছা ছিল নাদিয়া ডাক্তার হবেন। মায়ের ইচ্ছায় ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা ডেন্টালে। তবে তার মন বসছিল না সেখানে। ডেন্টালে পড়াকালীন হঠাৎ নাদিয়ার মাথায় আসে ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে কাজ করার। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া মেধাবী শিক্ষার্থী নাদিয়া চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন থেকে ডেন্টালের ইতি টানেন।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বিএসএস ও এমএস সম্পন্ন করেন। বাবার ইচ্ছায় বিসিএস পরীক্ষা দেন তিনি। তবে বিসিএসে নাদিয়ার একটিমাত্র চয়েজ ছিল ‘পুলিশ ক্যাডার’। প্রথমবার ৩০তম বিসিএসে পরীক্ষা দিয়েই মেধাতালিকায় নাম আসে নাদিয়ার। এরপর যোগ দেন বাংলাদেশ পুলিশে।
২০১২ সালে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন নাদিয়া। প্রথমে তার কর্মস্থল ছিল ডিএমপি। ডিএমপিতে তিনি ট্রাফিক, এমটি, সুপ্রিম কোর্ট, ডিবি ও ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করেন। তিনি শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনের জন্য পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে যান। মালি থেকে ফিরে ফেনী জেলায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নাদিয়া। সেখানেও তিনি কৃতিত্বের ছাপ রাখেন। বর্তমানে তিনি ট্যুরিস্ট পুলিশের হেডকোয়ার্টার্সে কর্মরত।

‘৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ উপলক্ষে পারিবারিক ও কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে নাদিয়া ফারজানা কথা বলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক তৌহিদুজ্জামান তন্ময়।
জাগো নিউজ: পুলিশে আসার পেছনের গল্প শুনতে চাই।
নাদিয়া ফারজানা: ছোটবেলা থেকে মেধাবী ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরেও চিন্তা করিনি বিসিএস দেবো। কারণ আমার মায়ের ইচ্ছা ছিল আমি যেন ডাক্তার হই। মায়ের ইচ্ছায় ভর্তি হই ঢাকা ডেন্টালে। কিছুদিন ক্লাসও করি। কিন্তু বায়োলজি ক্লাসে যখন কেঁচো, ব্যাঙ কিংবা তেলাপোকা কাটতে হতো মাঝে মধ্যে বমি করেছি। তখন চিন্তা করলাম এভাবে আমাকে প্রতিনিয়ত মানুষের মুখের ভেতর হাত দিতে হবে। আদৌ পারবো কি না। মনে মনে অন্য পেশার স্বপ্ন দেখলেও মায়ের ভয়ে বলতে পারতাম না। এরপর ঢাবির ‘ডি’ ইউনিটে পরীক্ষা দেই।
পুলিশ চ্যালেঞ্জিং জব। সেটা নারী কিংবা পুরুষ উভয়ের জন্য। আমাদের যখন কোনো কাজে অ্যাসাইন করা হয় তখন একজন অ্যাডিশনাল এসপিকে আলাদাভাবে ভাবা হয় না- সে নারী নাকি পুরুষ। পরিবারের সাপোর্ট না থাকলে পুলিশে কাজ করা কষ্টকর। কারণ নারী অথবা পুরুষ চাকরির পাশাপাশি আপনাকে পরিবার মেনটেইন করতে হয়।
বিসিএসের জন্য আমার ভাই পরামর্শ দেন। তবে আমি বলেছিলাম যদি বিসিএস দিতেই হয় তবে আমার একটায় চয়েস হবে ‘পুলিশ’। পরিবারে এমন শর্তের পর বাবা বলেছিলেন আমি পুলিশের চাকরি পারবো কি না। তখন আমার স্বামী বলেছিলেন- আমি পারবো। এরপর পরীক্ষা দিলাম, পুলিশ ক্যাডারেই হলো। ভাইভায় আমাকে জিজ্ঞাস করা হয়েছিল ফরেন কিংবা অ্যাডমিন ক্যাডারে কেন নয়। আমি বলেছিলাম- পুলিশের ইউনিফর্মের প্রতি আমার আগে থেকেই একটা মুগ্ধতা কাজ করে।
আরও পড়ুন
- জাতিসংঘ মিশনেও সমুজ্জ্বল ‘দেশের নারী পুলিশ’
- দেশে প্রথমবারের মতো ডগ স্কোয়াড পরিচালনায় ৭ নারী পুলিশ সদস্য
- সব জেলায় নারী সার্কেল এসপি দিতে চাই: আইজিপি
জাগো নিউজ: পুলিশে নারী সদস্যদের চ্যালেঞ্জ কী কী?
নাদিয়া ফারজানা: পুলিশ চ্যালেঞ্জিং জব। সেটা নারী কিংবা পুরুষ উভয়ের জন্য। আমাদের যখন কোনো কাজে অ্যাসাইন করা হয় তখন একজন অ্যাডিশনাল এসপিকে আলাদাভাবে ভাবা হয় না- সে নারী নাকি পুরুষ। পরিবারের সাপোর্ট না থাকলে পুলিশে কাজ করা কষ্টকর। কারণ নারী অথবা পুরুষ চাকরির পাশাপাশি আপনাকে পরিবার মেনটেইন করতে হয়।
জাগো নিউজ: আপনি একজন মা, পাশাপাশি চাকরি-পরিবার কীভাবে সামলান?
নাদিয়া ফারজানা: আমার একটাই সন্তান। তাকে অনেক সময় দিতে হয়। আমার পরিবার এবং স্বামী অনেক সাপোর্টিভ। আমার বাবা নেই। মা আছেন। আমার বাসা মায়ের বাসার কাছাকাছি। প্রতিদিন মায়ের সঙ্গে দেখা হয়। আমার কাছে সবার আগে গুরুত্বপূর্ণ শান্তিপূর্ণ জীবন।

জাগো নিউজ: তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সাইবার অপরাধ বেড়েছে, এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
নাদিয়া ফারজানা: বর্তমানে সাইবার ক্রাইম বেড়েই চলছে। কিছুদিন পর অন্য অপরাধের সংখ্যা একেবারে কমে যাবে, সবকিছু অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকবে সাইবার ক্রাইম। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে আপনি বলতে পারবেন না সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করবেন না। কারণ দুনিয়া যেদিকে যাচ্ছে সবকিছু সোশ্যাল মিডিয়া বা ইন্টারনেট থেকে পাচ্ছেন। সাইবার ক্রাইম থেকে বাঁচতে কিছু স্কিল জানতে হবে। সাইবার সিকিউরিটির জন্য কিছু টিপস আছে যে যে কাজ করা যাবে না। প্রাইভেট কোনো ছবি মোবাইলে না রাখা কিংবা মোবাইল অন্য কারও হাতে দেবেন না। বর্তমান সময়ের বাবা-মাকে সন্তানের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে। যাতে ভয় পেয়ে বাচ্চারা কোনো কিছু না লুকায়। তাদের বোঝাতে হবে, শেখাতে হবে।
ফেনীতে কিশোর গ্যাং গ্রুপের ডাটাবেজ তৈরি করেছিলাম। তখন ৪৫টির মতো গ্যাং গ্রুপের তালিকা করেছিলাম। এই কিশোর গ্যাংরা পথশিশুদের দিয়ে স্কুল-কলেজগামী ছাত্রীদের পায়ে ধরাতো ৫-১০ টাকার জন্য। আমি তখন দিনরাত ২৪ ঘণ্টা রাস্তায় কাজ করেছি। রীতিমতো আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল।
জাগো নিউজ: আপনি ট্যুরিস্ট পুলিশে যোগদানের পর ট্যুরিস্ট পুলিশের ভাবমূর্তি বেড়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাই।
নাদিয়া ফারজানা: আমি নিজেই একজন ট্যুরিস্ট। আমার ফেসবুকে ছবি-ভিডিও দেখে অনেকেই হয়তো মনে করেন আমি ঘুরতে গিয়েছি। কিন্তু পুলিশের কনস্টেবল রিক্রুমেন্টের কাজে গিয়ে ফেরার পথে একটুখানি ভিডিও করে নিয়ে এলাম। এমন অনেক কাজে গিয়েছি সেখানে গিয়ে ট্যুরিস্ট স্পটগুলো ঘুরে এসেছি। সাবেক ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান বর্তমান ডিএমপি কমিশনার স্যার আমাকে বলেছিলেন ট্যুরিস্ট পুলিশের ব্র্যান্ডিং করতে। ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশ নিরাপদ দেশ এ বিষয়ে কাজ করেছি। ভিডিওর মাধ্যমে বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পট তুলে ধরেছি। দেখিয়েছি বাংলাদেশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
জাগো নিউজ: ফেনীতে থাকাকালীন কিশোর গ্যাংয়ের ডাটাবেজ নিয়ে কাজ করেছেন। সেখানকার অভিজ্ঞতা শুনতে চাই।
নাদিয়া ফারজানা: ফেনী নিয়ে আমার অনেক ভালো মেমোরিজ আছে। কারণ ঢাকা মহানগর পুলিশ ছাড়া ঢাকার বাইরে কাজ করিনি। ঢাকার বাইরে গিয়ে কাজ করা এবং জেলা পুলিশের আলাদা পরিবেশ। ফেনীতে গিয়ে দেখি পাড়ায় পাড়ায় কিশোর গ্যাং তৈরি হয়েছে। স্কুল-কলেজের ছেলেরা মাস্ক পরে চুপিচুপি আমার অফিসে এসে বলতো- বিভিন্ন গ্যাংয়ের সদস্যরা তাদের ধরে নিয়ে বলে এই গ্যাংয়ে জয়েন করতে, নাহলে ক্ষতি হবে। আমি রাতের পর রাত অভিযানে গিয়ে সেসব কিশোর গ্যাং সদস্যদের ধরে এনেছি। ফেনীতে কিশোর গ্যাং গ্রুপের ডাটাবেজ তৈরি করেছিলাম। তখন ৪৫টির মতো গ্যাং গ্রুপের তালিকা করেছিলাম। এই কিশোর গ্যাংরা পথশিশুদের দিয়ে স্কুল-কলেজগামী ছাত্রীদের পায়ে ধরাতো ৫-১০ টাকার জন্য। আমি তখন দিনরাত ২৪ ঘণ্টা রাস্তায় কাজ করেছি। রীতিমতো আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল।

জাগো নিউজ: নারী-পুরুষের বৈষম্য নিয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
নাদিয়া ফারজানা: নারী-পুরুষের বৈষম্য ছিল এবং আছে। তবে ২০ বছর আগে সমাজে যে অবস্থায় ছিল এখন সে অবস্থা নেই। তবে এখনো অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্য দেখা যায়। দুজন যোগ্য মানুষ যদি আপনার সামনে দাঁড়ায় সে ছেলে হোক কিংবা মেয়ে এটার পার্থক্য করার সময় এখন নেই। কারণ কাজের জন্য তারা যোগ্য কি না এটা নিশ্চিত করতে পারলে আলাদা করে নারী দিবস পালন করা দরকার হবে না।
জাগো নিউজ: নারী দিবসে আপনার মেসেজ কী?
নাদিয়া ফারজানা: শুধু একদিন উদযাপন করে প্রিয় নারীদের সম্মান, ভালোবাসা দেখাতে চায়- এটা আমার কখনোই পছন্দ নয়। আমি যাদের ভালোবাসবো প্রতিদিন তাদের ভালোবাসবো। বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকেই শেখাতে হবে সব বয়সী নারীদের সম্মান দেখাতে হবে, ভালোবাসা দেখাতে হবে। আমার জীবনে আসা যত নারী আছে আজকের দিনে সবাইকে সম্মান ও শ্রদ্ধা। আপনাদের অবদান ছিল বলেই আমি আজকের নাদিয়া ফারজানা।
জাগো নিউজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
নাদিয়া ফারজানা: ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশসহ সমগ্র পৃথিবীর নারীদের শুভেচ্ছা। আপনাকে এবং জাগো নিউজ পরিবারকেও ধন্যবাদ।
টিটি/এএসএ/জিকেএস