গাজা: মানবতার পরাজয়ের প্রতিচ্ছবি

গাজা উপত্যকায় এখন আর রাত নামে না—নেমে আসে বোমা।ঘুম আর জেগে থাকার পার্থক্য মুছে গেছে সেই ভুখণ্ডে। শিশুদের খেলনা নেই, স্কুল নেই, নেই আশ্রয় বা নিরাপত্তা। আছে শুধু অনাহার, ধ্বংসস্তূপ আর অবিরাম কান্না।
২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের শুরু থেকে এ পর্যন্ত জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যমতে অন্তত ৬০ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের ৪০ শতাংশই শিশু। গাজার মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ ছোট ভূখণ্ডে এ ধরনের গণহত্যা কেবল সামরিক অভিযান নয়—এ এক পরিকল্পিত নিধনযজ্ঞ, যাকে আন্তর্জাতিক পরিসরে অনেকেই “জেনোসাইড” হিসেবে অভিহিত করেছেন।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) গাজাকে ‘famine-like condition’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রায় অর্ধমিলিয়ন মানুষ চরম খাদ্য সংকটে দিন পার করছে, চিকিৎসা ও পানীয় জলের অবস্থা আরও শোচনীয়। সদ্যোজাত শিশুরা জন্ম নিচ্ছে ধ্বংসস্তূপে, অপুষ্টিতে ভুগে মরছে কোলের সন্তানরা।
সবচেয়ে হতাশাজনক হচ্ছে বিশ্বশক্তিগুলোর ভূমিকা। যুক্তরাষ্ট্র, যারা নিজেকে মানবাধিকারের ধ্বজাধারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তারাই একদিকে ইসরায়েলকে কূটনৈতিক সমর্থন দিচ্ছে, অন্যদিকে ১৪ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা পাস করেছে। এই সহায়তায় কেনা বোমা, গোলাবারুদ, ড্রোনই আজ ব্যবহৃত হচ্ছে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে। ইউরোপীয় দেশগুলোর অবস্থানও দ্ব্যর্থপূর্ণ—তারা শান্তির কথা বললেও কার্যত অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
এমনকি পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোও বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ। ইউক্রেন যুদ্ধের সময় রাষ্ট্রনায়কদের আহাজারি, সংবাদমাধ্যমের ব্যাপক প্রচার এবং বিশ্বজুড়ে কূটনৈতিক চাপের যে ঢেউ দেখা গিয়েছিল, তার সামান্য অংশও গাজার মানুষের জন্য দেখা যায়নি। এই দ্বিচারিতা আজকের বিশ্বের তথাকথিত নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত যুদ্ধবিরতির আড়ালে সময়ক্ষেপণ না করে, সরাসরি যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানানো এবং তা কার্যকর করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া। দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালত যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতেই হবে—কিন্তু সমস্যা হলো, সেই রায় কার্যকর করার দায়িত্ব যাদের হাতে, তারাই আজ যুদ্ধের পৃষ্ঠপোষক।
বিজ্ঞাপন
প্রতিবাদ অবশ্য থেমে নেই। পৃথিবীর নানা প্রান্তে শান্তিকামী মানুষ রাস্তায় নেমেছে, র্যালি করছে, ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ ধ্বনি তুলছে। কিন্তু রাষ্ট্রনায়করা, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর নেতারা, রয়েছেন আত্মমগ্ন ও নিষ্ক্রিয়। এ যেন তাদের মাটি নয়, তাদের দায়ও নয়। কিন্তু মানবতার প্রশ্ন কখনও ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ থাকে না। আজ গাজার কান্না যদি উপেক্ষিত হয়, কাল তা অন্য কোথাও প্রতিধ্বনিত হবে—আরও নির্মমভাবে।
গাজার সংকট আজ একক কোনো ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু নয়—এটি বিশ্বমানবতার পরাজয়ের প্রতিচ্ছবি। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির প্রধান Mirjana Spoljaric বিবিসিকে বলেছেন, গাজা পৃথিবীতে নরকের চেয়েও খারাপ হয়ে উঠেছে। অথচ সভ্যতার ধ্বজা তোলা পশ্চিমারাতো বটেই, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোও আজ একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত উপত্যকার কান্না শুনতে পায় না, দেখতে পায় না ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া স্বপ্নগুলো। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষত শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো, যদি এখনো নিরবতা না ভাঙে, তাহলে ইতিহাস একদিন তাদের এই নীরবতার বিচার করবে।
এ মুহূর্তে প্রয়োজন যুদ্ধবিরতি নয়—পুরোপুরি যুদ্ধ বন্ধ করা। সামরিক সহায়তা বন্ধ করতে হবে, এবং অবরুদ্ধ জনগণের জন্য অবাধ মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। গাজা আজ কাঁদছে। কাঁদছে সন্তানহারা মা, অনাহারে কাতর শিশু, এবং এক পুরো জাতিগোষ্ঠী। অস্ত্র নয়, এখন দরকার আমাদের বিবেক। দরকার কণ্ঠস্বর, সচেতনতা, এবং সোচ্চার মানবিক প্রতিবাদ।
বিজ্ঞাপন
লেখক: ব্রিটেনপ্রবাসী কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন