ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মানুষ বলতে আমরা যেন মানুষই বুঝি

শাহানা হুদা রঞ্জনা | প্রকাশিত: ০৯:৩২ এএম, ১৮ জুন ২০২৫

বিভিন্ন আলোচনার টেবিলে একটা কথা শোনা যায়, সমাজে সিস্টেমেটিক ডিসক্রিমিনেশন বা প্রথাগত বৈষম্য চলছে। কীভাবে বা কাদের ক্ষেত্রে চলছে? বাংলাদেশে এই সিস্টেমেটিক ডিসক্রিমিনেশনের সবচেয়ে বড় শিকার দলিত ও হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের জীবন-জীবিকার করুণদশা ও অত্যাচারিত হওয়ার মাত্রা দেখে সহজেই বোঝা যায় এই মানুষগুলো কীভাবে প্রথাগত বৈষম্যের শিকার হয়ে চলেছেন। কোন আইন, কোনো সিস্টেম এদের পক্ষে কথা বলে না। এদের পাশে নেই কোনো রাজনৈতিক সহায়তা।

সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং পেশাগতভাবে বৈষম্য ও অবহেলার শিকার এই মানুষগুলো। তাদের জীবনের শুরু এই বৈষম্যের মাধ্যমে, শেষও তাই। দলিত-হরিজনরা কেন এত বেশি বৈষম্যের শিকার? প্রথম কারণ সমাজের চোখে তারা ‘নীচু জাত’, আর একারণেই এরা বেশি বৈষম্যের শিকার। বৈষম্যের শিকার বলেই এদের আর কখনোই মাথা উঁচু করে বাঁচা হয় না। এই মানুষগুলোর জীবনযাত্রার মান খুব নীচু। এরা সমাজে বিচ্ছিন্ন ও উপেক্ষিত জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। অথচ এই মানুষগুলোর ভূমিকা আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বা বলা যায় অপরিহার্য। প্রতিদিন শহরকে পরিষ্কার করার দায়িত্ব তাঁদের। ঘরবাড়ির ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহ, কোরবানির পরপরই বর্জ্য নিষ্কাশন, জুতা সেলাই করার কাজসহ আরো অসংখ্য জরুরি কাজের সঙ্গে জড়িত এই মানুষগুলো। এরা শুধু যদি একদিন কাজ থেকে বিরতি নেন, শহরের আবর্জনা নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। সাহেব-সুবা মানুষ নাকে-মুখে রুমাল চেপেও রক্ষা পাবেন না।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে দলিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৪৩.৫৮ লাখ এবং হরিজন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১২.৮৫ লাখ। তবে, এই সংখ্যাগুলো জরিপের সময় এবং পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। এই মানুষগুলো সবাই অনগ্রসর মানুষ এবং জন্মগত পরিচয়ের কারণে সমাজে ‘অস্পৃশ্য’।

এই সমাজে বারবার নানাভাবে অবহেলা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন দলিত হরিজন কমিউনিটির মানুষ। তাদের প্রতি ঘৃণার দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা খুব সাধারণ। আমরা এখনো অনেকেই জানিনা বাংলাদেশেও এই বৈষম্য কতটা প্রকট। সেলুনে চুল কাটতে গিয়ে, বাসা ভাড়া নিতে গেলে, জমি কিনতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হন। এছাড়াও স্কুলে, হাসপাতালে, বিচার চাইতে গেলে বা দাওয়াত খেতে গেলে উপেক্ষার শিকার হন। দাওয়াত বাড়িতে এদের বসার জায়গা আলাদা থাকে। এমনকি মাটিতে কলাপাতা বিছিয়ে খেতে দেয়া হয়, পানি দেয়া হয় মাটির বদনায়, যাতে এগুলো ফেলে দেয়া যায়। এমনকি এলাকার হোটেল, রেস্তোরাঁয় খাওয়ার জন্য আলাদা প্লেট-গ্লাস-কাপ দেয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

এরকম বহু নজির আছে সমাজে। স্কুলে দলিত শিশুরা তাদের সহপাঠীদের দ্বারা উপেক্ষিত হয়, হাসি-ঠাট্টা ও বুলিং এর শিকার হয়। ক্লাসে বসার জন্য দলিত শিশুকে আলাদা বেঞ্চ দেওয়া হয়। এমনকি শিক্ষকরাও তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। সমাজের চোখে এরা এতোটাই অপাঙ্ক্তেয় যে কোনো কোনো এলাকায় এদের পানি সংগ্রহের কল বা পুকুর এবং শশ্মানও ভিন্ন। কখনো কখনো নদীতে মরদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি যে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে দলিত-হরিজন শিশুদের ক্যাপ ও গেঞ্জি দেয়া হয়নি। এটা নিয়ে পরবর্তীতে সমালোচনা হলে কর্তৃপক্ষ দুঃখপ্রকাশ করেছিল। সম্ভবত এটি যশোরের ঘটনা। এছাড়াও স্কুলে অনুষ্ঠান হলে সুইপার বা মেথরের সন্তানকে দিয়ে দিয়ে স্কুলের টয়লেট পরিষ্কার করানোর মতো বিশ্রী ঘটনাও ঘটেছে।

বিজ্ঞাপন

এইসব সামাজিক নিগ্রহের চাইতেও বড় সমস্যা হলো বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ। দরিদ্র ও সহায় সম্বলহীন মানুষগুলো তখন একেবারে রাস্তায় এসে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমাজ ও রাষ্ট্র উদাসীন ভূমিকা পালন করে। এই সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষ অমানবিক পরিবেশে বসবাস করেন। সেখানে থাকার জায়গায় জায়গায় পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ বা পর্যাপ্ত ড্রেনের ব্যবস্থা নেই। অনেক ক্ষেত্রে তারা খাস জমিতে বসবাস করেন বলে সবসময় উচ্ছেদের ভয়ে থাকেন।

নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার জালশুকা এলাকার ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ অনীল রবিদাস। সম্প্রতি রবিদাস অভিযোগ করেছেন, পাশের গ্রামের এক লোক দলবল নিয়া আগে কয়েকটা ঘর ভেঙেছে, তাদের চামড়া কেনার টাকা নিয়ে গেছে, সব ঘরবাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে এবং আমাদের গাছপালাও কেটে ফেলেছে। রবিদাস বলেছেন, ‘আমরার মুচারজাত দেইখ্খা কোনো বিচার পাই না। আমরার কী দুষ বাবু? আপনিই কইন, আমরার জন্মই কি দুষের? এই ২২ জন মানুষ লইয়া অহন আমরা কই থাকবাম?”

বাংলাদেশে দলিত ও হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষের উপর অত্যাচারের ঘটনা ঘটেই চলেছে। এই অত্যাচারের মাত্রা তাদের প্রান্তিক অবস্থান এবং সামাজিক বৈষম্যের প্রতিফলন। ২০২৪ সালে ঢাকার বংশালে হরিজন কলোনি থেকে এই সম্প্রদায়ের মানুষদের উচ্ছেদ করা হয়। ব্যবসায়িক উন্নয়নের নামে পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা ছাড়াই তাদের বাসস্থান থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। একই বছর ঢাকার মিরনজিল্লায় কাঁচাবাজার নির্মাণের জন্য হরিজন সম্প্রদায়ের বসতি উচ্ছেদ করা হয়। এই উচ্ছেদে কোনো পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হয়নি। ২০২১ সালে ফরিদপুরে হরিজন সম্প্রদায়ের দুজন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। এই নিয়ে সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হলেও দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

বিজ্ঞাপন

দক্ষিণ এশীয় মানবাধিকার সংস্থার ২০২৭ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে হরিজন সম্প্রদায়ের মধ্যে হত্যা, ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, নারীদের উপর অত্যাচার, এবং সম্পত্তি দখলের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি সমাজের হীন দৃষ্টিভঙ্গি এই সহিংসতাকে বাড়িয়ে তোলে। চাকরির বাজারে দলিত-হরিজন কমিউনিটির মানুষ নেই বললেই চলে। যেহেতু পড়াশোনার সুযোগ কম, তাই চাকরির সুযোগও কম। সাধারণ চাকরি, বড় পজিশন কোনোটাই তাদের ভাগ্যে জোটেনা। এই পরিবারের ছেলেমেয়েরা তাই পড়াশোনাও করতে চায় না। ব্যবসা করলেও সাধারণ মানুষ তাদের কাছ থেকে জিনিসপত্র কেনেন না বা কিনতে চান না জাত প্রথার কারণে।

হরিজন সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষ পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত থাকলেও, তাদের পেশায় ভাগ বসাচ্ছে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ। শিক্ষার পাশাপাশি স্বাস্থ্যতেও একই অবস্থা। সরকার যে বরাদ্দ দেয়, সেটাও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এই মানুষগুলো এমনভাবে দারিদ্র্যের বেড়াজালে আবদ্ধ যে এখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না। বের করে আনার জন্য কেউ তাদের প্রতি সহযোগিতার হাতও বাড়িয়ে দেয় না।

বাংলাদেশে দলিত-হরিজন কমিউনিটির মানুষদের উপর অত্যাচারের মাত্রা না কমে, বরং বেড়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠে কেন মানুষ এইসব প্রান্তিক মানুষের উপর অত্যাচার করে? বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকায় জাতপাত প্রথার প্রভাব এখনও বিদ্যমান। হিন্দুদের মধ্যে দলিত ও হরিজন সম্প্রদায়কে ঐতিহ্যগতভাবে "নিন্মজাত" ও "অস্পৃশ্য" হিসেবে মনে করা হয়। যার ফলে তাদের প্রতি ঘৃণা ও বৈষম্যমূলক আচরণ খুব স্বাভাবিক বলে মনে করা হয়।

বিজ্ঞাপন

প্রান্তিক মানুষ সাধারণত দরিদ্র এবং ভূমিহীন হন। সামান্য কিছু থাকলেও স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী তাদের সেই জমি, বাসস্থান বা সম্পদ দখল করার জন্য অত্যাচারের আশ্রয় নেয়। অত্যাচারের ঘটনার পর প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও দোষীদের শাস্তি না দেওয়ার ঘটনা অত্যাচারীদের উৎসাহিত করে। যারা প্রান্তিক মানুষের উপর অত্যাচারে ইন্ধন দেয়, রাজনৈতিক স্বার্থে সেইসব প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দেয়া হয়।

দলিত নারী জাত, লিঙ্গ ও দারিদ্র্যের কারণে তিনগুণ বৈষম্যের শিকার। তারা ধর্ষণ, মানব পাচার, পারিবারিক সহিংসতা ও বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছেন কিন্তু আইনি সহায়তা পাচ্ছেন না। আইনি সুরক্ষার অভাব তাদের দুর্দশা বাড়িয়ে তোলে বহুগুণ।
অপরাধীরা প্রায়ই দলিতদের বিরুদ্ধে অপরাধ করে দায়মুক্তি ভোগ করে। এরা ‘অচ্ছুত’ বলে পুলিশ মামলা অবহেলা করে, এবং অর্থের অভাবে ভুক্তভোগীরা আইনি লড়াই চালাতে পারেন না। একই সাথে দলিতদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব খুবই কম। তাই রাজনৈতিক দল থেকে সহায়তা পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না।

এই জনগোষ্ঠী ভোটার হলেও নির্বাচনের পর তাদের প্রতি প্রার্থীদের আশ্বাস আর কোনো কাজেই আসে না। তারা নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত এবং রাষ্ট্রীয় অধিকারে সীমিত প্রবেশাধিকার পায়। সরকার ২০১২-১৩ থেকে দলিত, হরিজন ও বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য কর্মসূচি শুরু করেছিল যেমন: বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, মাসিক ৫০০ টাকা বিশেষ ভাতা (৫০ বছরের ঊর্ধ্বে অক্ষম ও অসচ্ছলদের জন্য), এবং পুনর্বাসন সহায়তা। এই কর্মসূচি ২১টি জেলায় সীমাবদ্ধ এবং তাও পর্যাপ্ত নয়।

বিজ্ঞাপন

জানিনা সমাজে পিছিয়ে থাকা ও নির্যাতিত এই মানুষগুলো কবে সমাজের মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্ত হবেন? আদৌ হবেন কিনা? খুব সামান্য সরকারি উদ্যোগ থাকলেও, তাদের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে আরও অনেক সুযোগ বৃদ্ধি প্রয়োজন। এই ‘অস্পৃশ্য’ নাম ঘুচাতে চাই সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক উদ্যোগ। আমরা চাই আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম মানুষ বলতে শুধু মানুষই বুঝবে।

১৭ জুন, ২০২
লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।

এইচআর/এমএস

বিজ্ঞাপন