প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতি
উদ্ভাবন শোষণ ও বাংলাদেশের ডিজিটাল ভবিষ্যৎ

বর্তমান বিশ্বে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এক মৌলিক রূপান্তর ঘটছে। প্রযুক্তির প্রসার এবং ডিজিটাল অবকাঠামোর অভূতপূর্ব বিকাশের ফলে জন্ম নিয়েছে এক নতুন অর্থনৈতিক সংগঠন, যা সমসাময়িক পণ্ডিতদের কাছে ‘প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতি’ নামে পরিচিত। এটি কেবল প্রযুক্তিনির্ভর একটি কাঠামো নয়, বরং এর মধ্যে নিহিত রয়েছে গভীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। বিশ্বব্যাপী তাত্ত্বিক পরিসরে প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতিকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা এর কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য, ক্ষমতার গতিশীলতা এবং এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। জঁ তিরোল (Jean Tirole), নিক স্রনিজেক (Nick Srnicek), শোশানা জুবফ (Shoshana Zuboff), জোসে ভ্যান ডিজক (José van Dijck) এবং জিওফ্রে পার্কার (Geoffrey Parker ) সহ একাধিক চিন্তাবিদ এ বিষয়ে বিশ্লেষণধর্মী অবদান রেখেছেন। এই তাত্ত্বিক কাঠামোকে যদি বাংলাদেশের বাস্তবতার আলোকে বিচার করা হয়, তাহলে প্রতীয়মান হয় একটি অসমতা-নির্ভর এবং অনিয়ন্ত্রিত প্ল্যাটফর্ম-ভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামোর সূচনা।
জঁ তিরোলের 'দ্বিমুখী বাজার' ও বাংলাদেশের প্ল্যাটফর্ম
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
ফ্রান্সের অর্থনীতিবিদ জঁ তিরোল, যিনি ২০১৪ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতির মৌলিক গঠন বোঝাতে ‘দ্বিমুখী বাজার’ বা ’two-sided markets’ ধারণাটি ব্যবহার করেন। ২০০৩ সালে জঁ-চার্লস রোশে (Jean-Charles Roche) এর সাথে যৌথভাবে রচিত গবেষণা প্রবন্ধ “Platform Competition in Two-Sided Markets” (Toulouse School of Economics, France)-এ তিনি ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে একটি প্ল্যাটফর্ম দুই বা ততোধিক ব্যবহারকারী গোষ্ঠীর মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে মূল্য সৃষ্টি করে এবং উভয় পক্ষ থেকেই মুনাফা আহরণ করে। এই বিশ্লেষণ বর্তমান বাংলাদেশের রাইড-শেয়ারিং অ্যাপ যেমন পাঠাও, উবার, অথবা খাদ্য সরবরাহ সেবা যেমন ফুডপ্যান্ডা—এইসব প্ল্যাটফর্ম বুঝতে সাহায্য করে। এসব প্রতিষ্ঠান যেভাবে গ্রাহক ও সেবাদাতাদের মধ্যে প্রযুক্তিনির্ভর সংযোগ ঘটিয়ে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করছে, তা তিরোলের তত্ত্বকে বাস্তব প্রেক্ষিতে প্রতিফলিত করে।
একটি ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। এই রূপান্তরকে ইতিবাচক দিকে চালিত করতে পারলে বাংলাদেশ ডিজিটাল ভবিষ্যতের নেতৃত্ব দিতে পারবে, অন্যথায় এটি নতুন ধরনের বৈষম্য ও শোষণের জন্ম দেবে।
উদাহরণস্বরূপ, পাঠাও বা উবার একদিকে যেমন যাত্রীদের জন্য দ্রুত ও সহজে পরিবহনের ব্যবস্থা করে, তেমনি অন্যদিকে চালকদের জন্য অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ তৈরি করে। ফুডপ্যান্ডা রেস্তোরাঁগুলোকে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেয় এবং গ্রাহকদের ঘরে বসে খাবার পাওয়ার সুবিধা দেয়। এই মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে প্ল্যাটফর্মগুলো উভয় পক্ষ থেকেই সার্ভিস ফি বা কমিশন আদায় করে। তিরোলের তত্ত্ব এই মধ্যস্থতার প্রক্রিয়া এবং বাজারে প্ল্যাটফর্মের আধিপত্য অর্জনের কৌশলকে সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরে। তিনি দেখান যে, কীভাবে প্ল্যাটফর্মগুলো ‘নেটওয়ার্ক প্রভাব’ (network effects) ব্যবহার করে, অর্থাৎ যত বেশি ব্যবহারকারী প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়, তত বেশি তা উভয় পক্ষের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, যা শেষ পর্যন্ত প্ল্যাটফর্মের বাজার শক্তিকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
তবে, তিরোলের মডেল শ্রমের শোষণ, ন্যায্য মজুরি কিংবা সামাজিক নিরাপত্তার মতো প্রশ্নগুলো বিবেচনায় নেয় না। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে অনানুষ্ঠানিক শ্রমবাজার বিশাল এবং শ্রম আইন প্রয়োগ দুর্বল, সেখানে প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে সৃষ্ট কর্মসংস্থান প্রায়শই নিরাপত্তাহীনতা ও শোষণের দিকে ধাবিত হয়। রাইড-শেয়ারিং বা ডেলিভারি প্ল্যাটফর্মের কর্মীরা স্বাধীন ঠিকাদার হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় ন্যূনতম মজুরি, স্বাস্থ্য বীমা, ছুটি বা অন্যান্য শ্রম অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। প্ল্যাটফর্মগুলো কর্মীদের ওপর উচ্চ কমিশন চাপায় এবং কর্মঘণ্টা নির্ধারণের ক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখে। তাই, তিরোলের তত্ত্ব যেখানে প্ল্যাটফর্মের অর্থনৈতিক দক্ষতা ও বাজার গঠনের দিকে আলোকপাত করে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা শ্রমিকদের বঞ্চনার দিকটিকে অস্পষ্ট রাখে।
নিক স্রনিজিকের 'প্ল্যাটফর্ম পুঁজিবাদ' ও বাংলাদেশের গিগ অর্থনীতি
বিজ্ঞাপন
নিক স্রনিজেক, লন্ডনের কিংস কলেজের একজন রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ, তার বই “Platform Capitalism” (Polity Press, Cambridge, UK, 2016)-এ প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতিকে পুঁজিবাদের একটি পরবর্তী ধাপ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে প্ল্যাটফর্মগুলো তথ্য আহরণ, দ্রুত স্কেলিং এবং ন্যূনতম সম্পদ ব্যয়ে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাজারকে দখল করে। স্রনিজেক প্ল্যাটফর্মকে পাঁচটি ভাগে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন—বিজ্ঞাপনভিত্তিক, ক্লাউড, শিল্প, পণ্য এবং লিন প্ল্যাটফর্ম। এর মধ্যে লিন প্ল্যাটফর্ম যেমন উবার বা পাঠাও বাংলাদেশের শহুরে গিগ অর্থনীতিকে চরমভাবে প্রভাবিত করছে। এ ধরনের প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক নিয়োগ না করে শ্রমকে আউটসোর্স করে এবং ডিজিটাল ইন্টারফেস ও মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা নিজের হাতে রাখে। ফলে, কর্মীরা পরিণত হন ‘অদৃশ্য শ্রমিকে’ যাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক অধিকার নেই।
স্রনিজিকের মতে, আধুনিক পুঁজিবাদ তথ্যের ওপর নির্ভরশীল এবং প্ল্যাটফর্মগুলো এই তথ্যের সবচেয়ে বড় সংগ্রাহক ও ব্যবহারকারী। তারা কেবল ব্যবহারকারীর ডেটা সংগ্রহ করে না, বরং এই ডেটা বিশ্লেষণ করে বাজার কৌশল তৈরি করে এবং প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদের এগিয়ে রাখে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, পাঠাও বা ফুডপ্যান্ডার মতো লিন প্ল্যাটফর্মগুলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করলেও, তাদের মূল লক্ষ্য হলো মুনাফা maximization এবং ঝুঁকি হ্রাস। তারা শ্রমিকদেরকে আনুষ্ঠানিক কর্মী হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে তাদেরকে ‘পার্টনার’ বা ‘স্বাধীন ঠিকাদার’ হিসেবে অভিহিত করে, যা তাদের সামাজিক নিরাপত্তা ও শ্রম অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। শ্রমিকরা নিজেদের যানবাহন, জ্বালানি এবং রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বহন করেন, কিন্তু প্ল্যাটফর্ম তাদের পারিশ্রমিক এবং কর্মঘণ্টা নিয়ন্ত্রণ করে। এতে শ্রমিকদের দর কষাকষির ক্ষমতা (bargaining power) সীমিত হয়ে পড়ে এবং তাদের আয় প্ল্যাটফর্মের অ্যালগরিদম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
এই বিশ্লেষণ বাংলাদেশের অগঠিত শ্রমবাজার এবং অনিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তিখাতে কার্যত শোষণের বাস্তবতা অনুধাবনে সহায়ক। শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় দুর্বল আইন এবং সরকারের নীতিগত নিষ্ক্রিয়তা প্ল্যাটফর্মগুলোকে অবাধে শ্রমিকদের শোষণ করার সুযোগ দেয়। ফলস্বরূপ, প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সৃষ্ট কর্মসংস্থানগুলো টেকসই হয় না এবং শ্রমিকরা ক্রমাগত অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। স্রনিজিকের তত্ত্ব এই শোষণের প্রক্রিয়াকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে, যা বাংলাদেশের গিগ অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করে।
বিজ্ঞাপন
শোশানা জুবফের 'নজরদারি পুঁজিবাদ' ও ডিজিটাল বাংলাদেশের হুমকি
শোশানা জুবফ, হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের ইমেরিটাস অধ্যাপক, তার বিশাল গবেষণাগ্রন্থ “The Age of Surveillance Capitalism” (Public Affairs, New York, 2019)-এ প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতির তথ্যভিত্তিক শোষণের দিকটি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, প্ল্যাটফর্মগুলো কেবল তথ্য সংগ্রহ করেই ক্ষান্ত হয় না; বরং এই তথ্যকে ব্যবহার করে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে, এমনকি আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করতেও সক্ষম হয়। এই নজরদারি পুঁজিবাদ ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে পণ্য করে তুলেছে। জুবফ যুক্তি দেন যে, এই প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে 'ডেটা অ্যাসেট'-এ রূপান্তরিত করে এবং এই ডেটা তাদের বাণিজ্যিক লাভের জন্য বিক্রি করে। এটি শুধু বিজ্ঞাপন দেখানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং ব্যবহারকারীর আচরণকে সূক্ষ্মভাবে প্রভাবিত করার মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক বা বিভিন্ন অ্যাপ এরই মধ্যে ব্যক্তিগত তথ্যের মাধ্যমে প্রোফাইল তৈরি করে ব্যবহারকারীদের উপর প্রভাব বিস্তার করছে। স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের অবস্থান, সার্চ হিস্টোরি, যোগাযোগ তালিকা, এমনকি বায়োমেট্রিক ডেটাও এই প্ল্যাটফর্মগুলো সংগ্রহ করে। এই ডেটা ব্যবহার করে তারা নির্দিষ্ট ব্যবহারকারীকে লক্ষ্য করে বিজ্ঞাপন পরিবেশন করে, তাদের পছন্দের অ্যালগরিদমকে প্রভাবিত করে এবং এমনকি তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শকেও প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। উদাহরণস্বরূপ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া খবর বা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয় এই ডেটা-নির্ভর টার্গেটিংয়ের মাধ্যমে।
বিজ্ঞাপন
জুবফ আরও দেখান যে, নজরদারি পুঁজিবাদ শুধু ব্যক্তি পর্যায়ের আচরণকেই প্রভাবিত করে না, বরং এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকেও ডিজিটাল নজরদারি বাড়ছে, যা গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য হুমকি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (DSA) এবং বিভিন্ন সাইবার নিরাপত্তা আইন, যা মূলত নাগরিকের নিরাপত্তা ও সাইবার অপরাধ দমনের জন্য তৈরি, তা প্রায়শই ভিন্নমত দমন এবং সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করতে ব্যবহৃত হয়। জুবফের বিশ্লেষণ বাংলাদেশের ডিজিটাল জগতে দ্রুত অগ্রসরমাণ এক প্রতিকূল পরিস্থিতির প্রতি সতর্কতা জারি করে, যেখানে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং নাগরিক স্বাধীনতা উভয়ই ঝুঁকিতে রয়েছে। ডেটা সুরক্ষা আইন (data protection law) ও তার কার্যকর প্রয়োগের অভাব এই ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
জিওফ্রে পার্কারের 'প্ল্যাটফর্ম বিপ্লব' ও বাংলাদেশের স্টার্টআপ সম্ভাবনা
অন্যদিকে, প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জিওফ্রে পার্কার (Geoffrey Parker), মার্শাল ভ্যান আলস্টাইন (Marshall Van Alstyne) এবং সাংগীত পল চৌধুরী (Sangeet Paul Choudary ) “Platform Revolution” (W. W. Norton, New York, 2016) গ্রন্থে প্ল্যাটফর্মকে উদ্ভাবনের হাতিয়ার হিসেবে দেখেছেন। তারা বলেছেন, প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবসায়ের নতুন দরজা খুলে দেয়, বাজারে প্রবেশ সহজ করে এবং নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্ভব ঘটায়। এই বিশ্লেষণ বাংলাদেশের উদীয়মান স্টার্ট-আপ সংস্কৃতি বোঝাতে কার্যকর। যেমন চালডাল, শেবা.এক্সওয়াইজেড, কিংবা বিকাশ—এসব প্ল্যাটফর্ম নতুন উদ্যোগ, কর্মসংস্থান এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
পার্কার ও তার সহ-লেখকরা প্ল্যাটফর্মকে একটি ইকোসিস্টেম হিসেবে দেখেন, যেখানে ব্যবহারকারী, সেবাদাতা এবং বিভিন্ন তৃতীয় পক্ষ সংযুক্ত হয়ে মূল্য তৈরি করে। তারা যুক্তি দেন যে, প্ল্যাটফর্মগুলো ঐতিহ্যবাহী রৈখিক ব্যবসায়ের (linear businesses) চেয়ে বেশি কার্যকর, কারণ তারা স্কেল করার সুযোগ দেয় এবং নতুন বাজার তৈরি করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, বিকাশের মতো মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) প্ল্যাটফর্ম আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে এক বিপ্লব ঘটিয়েছে, যা গ্রামীণ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছেও ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিয়েছে। চালডাল এবং শেবা.এক্সওয়াইজেড এর মতো ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন বিক্রয় চ্যানেল তৈরি করেছে এবং শহুরে জীবনে সুবিধা নিয়ে এসেছে। এসব প্ল্যাটফর্ম নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে, বিশেষত ডেলিভারি ও লজিস্টিকস খাতে।
তবে, এদের লাভের সিংহভাগ যেহেতু নগরকেন্দ্রিক ও প্রযুক্তিনির্ভর, তাই গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ও প্রান্তিক শ্রেণির অংশগ্রহণ সীমিত রয়ে যাচ্ছে। ফলে ডিজিটাল বৈষম্য আরও গভীর হচ্ছে। ইন্টারনেট অ্যাক্সেস, ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং স্মার্টফোন ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা গ্রামীণ বা সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলের মানুষকে প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতির সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছে। যদিও প্ল্যাটফর্মগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে, তাদের অধিকাংশই শহুরে ভোক্তাদের লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়, যা গ্রাম ও শহরের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজনকে আরও বাড়িয়ে তোলে। উপরন্তু, এই প্ল্যাটফর্মগুলো প্রায়শই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উপর উচ্চ কমিশন চাপায়, যা তাদের মুনাফাকে প্রভাবিত করে।
জোসে ভ্যান ডিজকের 'প্ল্যাটফর্ম সমাজ' ও বাংলাদেশে সামাজিক প্রভাব
বিজ্ঞাপন
সমাজবিজ্ঞানী জোসে ভ্যান ডিজক (José van Dijck), থমাস পল (Thomas Poell,) এবং মার্টিন দ্য ওয়াল (Martijn de Waal ) “The Platform Society” (Oxford University Press, Oxford, 2018) গ্রন্থে প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব নিয়ে গভীর অনুসন্ধান চালিয়েছেন। তারা দেখিয়েছেন কীভাবে প্ল্যাটফর্ম সমাজের গণতান্ত্রিক কাঠামো, শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা এবং নাগরিক স্বাধীনতাকে প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দুর্বল, সেখানে প্ল্যাটফর্মগুলো দ্রুত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার বিকল্প হিসেবে উঠে এসেছে। কোভিড-১৯ এর সময় অনলাইন শিক্ষা প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার বেড়ে যায়, কিন্তু সকলের সমান প্রবেশাধিকার ছিল না। একইভাবে, ডিজিটাল হেলথ অ্যাপগুলো ব্যবহৃত হলেও সেবার গুণমান ও সমতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
ভ্যান ডিজক ও তার সহ-লেখকরা যুক্তি দেন যে, প্ল্যাটফর্মগুলো শুধু প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠান নয়, বরং তারা সামাজিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে। তারা তথ্য প্রবাহ, যোগাযোগ এবং সামাজিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মহামারির সময় অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে ওঠে। জুম, গুগল ক্লাসরুম এবং বিভিন্ন ই-লার্নিং পোর্টাল শিক্ষা কার্যক্রমে নতুন মাত্রা যোগ করে। কিন্তু বিদ্যুৎ সংযোগের অভাব, ইন্টারনেট অ্যাক্সেসের সীমাবদ্ধতা এবং ডিভাইসের অপ্রতুলতা কারণে অনেক শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, যা শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য আরও বাড়িয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবায়ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার বেড়েছে, যেমন টেলিমেডিসিন অ্যাপস বা অনলাইন ফার্মেসি। কিন্তু এসব সেবার মান, নির্ভরযোগ্যতা এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে এর সহজলভ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ভ্যান ডিজকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, এসব প্ল্যাটফর্ম গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা এড়িয়ে চলার সুযোগ পায়, কারণ তাদের কার্যক্রমের উপর কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা তাদের অ্যালগরিদম কীভাবে কাজ করে বা ব্যবহারকারীর ডেটা কীভাবে ব্যবহার করে, সে বিষয়ে স্বচ্ছতা বজায় রাখে না। এটি নাগরিকের তথ্যের সুরক্ষা এবং স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। প্ল্যাটফর্মগুলো প্রায়শই তাদের নিজস্ব নিয়মকানুন তৈরি করে, যা রাষ্ট্রীয় আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে। ফলস্বরূপ, একটি ‘প্ল্যাটফর্ম সমাজ’ তৈরি হয়, যেখানে সামাজিক সম্পর্কের কাঠামো এবং গণমানুষের অংশগ্রহণ এই প্ল্যাটফর্মগুলোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতির সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ
বাংলাদেশে প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতির উদ্ভব এক জটিল বাস্তবতায় ঘটেছে। প্রযুক্তি নির্ভরতা, উচ্চ বেকারত্ব, অনানুষ্ঠানিক শ্রমবাজার এবং উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা এই অর্থনীতিকে দ্রুত সম্প্রসারণের সুযোগ করে দিয়েছে। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে এসেছে শোষণ, বৈষম্য এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তার হুমকি। সরকারের নীতিগত অসংগতি, দুর্বল শ্রম আইন এবং তথ্য সুরক্ষা আইনের অভাব প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতিকে একটি অনিয়ন্ত্রিত ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলেছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বা সাইবার নিরাপত্তা আইন মতপ্রকাশ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হলেও প্ল্যাটফর্ম কোম্পানিগুলোর দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে ব্যবহৃত হয় না।
বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক খাতের উপর নির্ভরশীল, যেখানে শ্রমিকের অধিকার প্রায় নেই বললেই চলে। প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতি এই অনানুষ্ঠানিকতাকে আরও শক্তিশালী করেছে, যেখানে কর্মীরা কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছাড়াই কাজ করেন এবং যেকোনও সময় চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে থাকেন। রাইড-শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মগুলো উদাহরণস্বরূপ, ড্রাইভারদের পারিশ্রমিক ও কর্মঘণ্টা পরিবর্তন করার সম্পূর্ণ ক্ষমতা রাখে, যা ড্রাইভারদের আয়কে অত্যন্ত অনিশ্চিত করে তোলে। অন্যদিকে, গ্রাহকরাও প্রায়শই সেবার মান বা মূল্য নিয়ে অভিযোগ করলেও তাদের অভিযোগ নিষ্পত্তির কার্যকর কোনো ব্যবস্থা থাকে না।
এছাড়াও, ডিজিটাল অবকাঠামোতে আঞ্চলিক বৈষম্য একটি বড় সমস্যা। শহরাঞ্চলে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং স্মার্টফোন ব্যবহারের ব্যাপকতা থাকলেও গ্রামীণ এবং দুর্গম অঞ্চলে এখনো ডিজিটাল বিভাজন প্রকট। এটি প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতির সুবিধাগুলোকে শুধু শহুরে এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে। ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বিকাশ বা নগদের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো একটি বড় সাফল্য অর্জন করলেও, তাদের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণের অভাব নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
বাংলাদেশের সরকার প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতির সম্ভাবনার দিকটি নিয়ে আগ্রহী হলেও, এর নেতিবাচক প্রভাবগুলো সম্পর্কে সচেতনতা এবং নীতিগত পদক্ষেপের অভাব রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা সাইবার নিরাপত্তা আইন যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করছে, সেখানে ডেটা সুরক্ষায় একটি কার্যকর আইন এখনও প্রণীত হয়নি। প্ল্যাটফর্ম কোম্পানিগুলোর উপর পর্যাপ্ত নজরদারি এবং তাদের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্কের অভাব রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতি একদিকে যেমন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করছে, তেমনি অন্যদিকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
ভবিষ্যৎ পথ
উপর্যুক্ত তাত্ত্বিক কাঠামোগুলোর একযোগে বিশ্লেষণ আমাদেরকে একটি নির্দিষ্ট বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়—প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতি একাধারে উদ্ভাবনের সুযোগ এবং শোষণের সম্ভাবনা উভয়ই বহন করে। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন সামাজিক বৈষম্য দূর না করে বরং কখনো কখনো তা আরও গভীর করে তোলে, সেখানে এই অর্থনৈতিক রূপান্তরের বিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরি। তিরোল, স্রনিজেক, জুবফ, পার্কার ও ভ্যান ডিজকের তাত্ত্বিক অবদান আমাদের বুঝতে সাহায্য করে—প্ল্যাটফর্ম কেবল অর্থনৈতিক মাধ্যম নয়, এটি ক্ষমতার নতুন রূপ, যা সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতি গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের উচিত একটি সুসংহত ডিজিটাল নীতি প্রণয়ন করা, যাতে শ্রমিকের অধিকার, তথ্য সুরক্ষা এবং প্ল্যাটফর্ম কোম্পানির জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। এই নীতিতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত:
• শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষা: প্ল্যাটফর্ম কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য বিমার মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে আইন প্রণয়ন ও কার্যকর প্রয়োগের ব্যবস্থা করা।
• ডেটা সুরক্ষা ও গোপনীয়তা: ব্যক্তিগত ডেটার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে একটি শক্তিশালী ডেটা সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা এবং প্ল্যাটফর্মগুলোকে ডেটা সংগ্রহ ও ব্যবহারে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে বাধ্য করা।
• প্রতিযোগিতা ও একচেটিয়া প্রবণতা রোধ: প্ল্যাটফর্মগুলোর একচেটিয়া বাজার দখলের প্রবণতা রোধ করতে এবং নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য সম সুযোগ নিশ্চিত করতে প্রতিযোগিতা আইন শক্তিশালী করা।
• কর ও রাজস্ব নীতি: প্ল্যাটফর্মগুলোর ক্রমবর্ধমান মুনাফা থেকে ন্যায্য কর আদায় নিশ্চিত করা, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।
• ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির প্রসার: গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ডিজিটাল অবকাঠামো ও সাক্ষরতার সুযোগ পৌঁছে দিয়ে ডিজিটাল বৈষম্য কমানো।
• জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা: প্ল্যাটফর্মগুলোর অ্যালগরিদম ও কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং তাদের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি কার্যকর নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরি করা।
বেসরকারি খাত, অ্যাকাডেমিক প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতির ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। এই স্টেকহোল্ডারদের সমন্বিত প্রচেষ্টা একটি ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য অপরিহার্য। প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতি একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে আমাদের দাঁড় করিয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটি ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। এই রূপান্তরকে ইতিবাচক দিকে চালিত করতে পারলে বাংলাদেশ ডিজিটাল ভবিষ্যতের নেতৃত্ব দিতে পারবে, অন্যথায় এটি নতুন ধরনের বৈষম্য ও শোষণের জন্ম দেবে।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
এইচআর/এএসএম
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন