ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ড. ইউনূসের জাতিসংঘযাত্রা

আমীন আল রশীদ | প্রকাশিত: ১০:৩৪ এএম, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

‘নিউইয়র্কে আওয়ামী লীগের ভয়ঙ্কর রূপ দেখবে ইউনূস’—এমন মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। বৃহস্পতিবার একটি অনলাইন টকশোতে তিনি এই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তার আগের দিন অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এবারের জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যাচ্ছেন তিনটি রাজনৈতিক দলের চারজন সিনিয়র নেতা। তারা হলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন। প্রশ্ন হলো, প্রধান উপদেষ্টা এবার রাজনীতিবিদদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন কি আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রতিরোধ মোকাবিলার জন্য?

সম্প্রতি লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন-এর স্কুল অব আফ্রিকান অ‍্যান্ড ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ (সোয়াস) ক্যাম্পাসে আয়োজিত একটি সেমিনার থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপর হামলার চেষ্টা করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা। ওইদিন সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসের পেছনের রাস্তা দিয়ে হাইকমিশনের গাড়ি বের হলে গাড়ির ওপর ডিম নিক্ষেপ করেন আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা। এ সময় হাইকমিশনের কালো রঙের বিএমডব্লিউ গাড়ির সামনে শুয়ে পড়ার চেষ্টা করেন তাদের কয়েকজন। কিন্তু পুলিশের হস্তক্ষেপে তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হলেও তারা গাড়ির ওপর ডিম নিক্ষেপ করেন।

এর আগে গত মাসে নিউইয়র্ক কনস্যুলেট অফিসে মাহফুজ আলমের ওপর হামলা হয়। শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর) নিজের ভেরিফায়ডে ফেসবুক পোস্টে দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তজা জানান, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এরকম বাস্তবতায় নিউইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টার সফর ঘিরে যে স্থানীয় আওয়ামী লীগ বিক্ষোভ করবে, সেটি সহজেই অনুমেয়। উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি এরইমধ্যে সেই ইঙ্গিতও দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা কি তাহলে এই সম্ভাব্য পরিস্থিতি এড়ানো বা বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার জন্যই তিনটি দলের চারজন সিনিয়র নেতাকে তার সফরসঙ্গী করছেন? অর্থাৎ বিষয়টা কি এমন যে, নিউইয়র্কে যদি আওয়ামী লীগ তাদের ভাষায় ড. ইউনূসকে ‘ভয়ঙ্কর রূপ’ দেখাতে চায়, তাহলে নীতিগত কারণে যাতে তাদেরকে স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত ও এনসিপির নেতাকর্মীদের প্রতিহত করেন—এটা কি সেই কৌশলের অংশ নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে?

স্মরণ করা যেতে পারে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের দিন গণমাধ্যমের সামনে ড. ইউনূস জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছিলেন এবং সেই ঐক্য স্থাপনে তার সভাপতিত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও গঠিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গত এক বছরে নানা ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আবার অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মতৈক্যের ভিত্তিতে এই সরকার গঠিত হলেও দলগুলোর সঙ্গেও পরস্পরের দূরত্ব বেড়েছে। বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও এনিসিপির। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি, জুলাই সনদের আলোকে জাতীয় নির্বাচন ইত্যাদি। সুতরাং, প্রধান উপদেষ্টা বারবার যে জাতীয় ঐক্যের কথা বলছেন, সেখানে একটি ফাটল এখন দৃশ্যমান। অর্থাৎ একদিকে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর, অন্যদিকে দলগুলোর ভেতরেই। এমতাবস্থায় সরকার প্রধান তার সফরসঙ্গী হিসেবে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের নেতাদের আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে হয়তো বিশ্বকে এই বার্ত দিতে চাইবেন যে, তার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো দূরত্ব বা বিরোধ নেই। এমনকি দলগুলোও জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ আছে।

ধরে নেয়া যায় যে, প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী তিনটি দলের চারজন সিনিয়র নেতা একই হোটেলে অবস্থান করবেন। তারা হয়তো একসঙ্গে সকালের নাশতা করবেন। নাশতার টেবিলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সুরাহা হয়। আবার যেহেতু তারা বিদেশ সফরে থাকবেন, ফলে দলীয়, পারিবারিক ও সামাজিক ব্যস্ততা তাদের থাকবে না। তারা পরস্পরের সঙ্গে আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ যেমন পাবেন, তেমনি খোলামেলা অনেক কথাও বলতে পারবেন। সেটি দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচন, জুলাই সনদ এমনকি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ইস্যুতেও। প্রধান উপদেষ্টা কি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় করার একটি সুযোগ সৃষ্টির জন্যই তাদেরকে সফরসঙ্গী করে নিয়ে যাচ্ছেন?

অন্তর্বর্তী সরকার দেশবাসী এবং বিশ্বকে হয়তো বোঝাতে চাইছে যে, তারা বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে চায় না। বরং দ্রুত নির্বাচিত সরকার তথা রাজনীতিবিদদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে চায়। গত মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার সাথে আলাপকালে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে পবিত্র রমজানের আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের পর তিনি তার আগের কাজে ফিরে যাবেন।

এর বাইরে জুলাই সনদ, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে নির্মূল করাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় একটি বৈঠক হতে পারে বলেও গুঞ্জন রয়েছে। এমনকি ওই বৈঠকে ভারত বা পাকিস্তানের কোনো প্রতিনিধির থাকাও হয়তো অসম্ভব নয়। যদিও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, চলতি বছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টার আমন্ত্রণে রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেবেন। এটি নির্বাচনকেন্দ্রিক কোনো মধ্যস্থতা বা আলোচনার জন্য নয়। বরং গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে।

তবে সরকারি ভাষ্যে উদ্দেশ্য যেটিই বলা হোক না কেন, দেশের স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক দৃঢ় থাকা দরকার। সেইসাথে গুরুত্বপূর্ণ দলগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে যে দূরত্ব, মতবিরোধ ও মতভিন্নতা তৈরি হয়েছে, সেটিও যথাসম্ভব কমিয়ে আনা জরুরি। না হয় এই অনৈক্য জাতীয় নির্বাচন অনিশ্চিত করে তুলবে—যা দেশকে আরও বড় বিপদের দিকে ঠেলে দেবে।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।

এইচআর/এমএস