গণতন্ত্রের গণিতবিহীন গণভোট ও অচেনা ক্রান্তিকাল
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে গণভোট প্রসঙ্গ হঠাৎই গুরুত্ব পেয়েছে। বলা হচ্ছে, জুলাই বিপ্লবকে বৈধতা দিতে এটি হবে জনগণের সরাসরি মতামতের এক গণতান্ত্রিক উৎসব। কিন্তু বাস্তবতা কি ততটা সহজ? রাজনৈতিক মাঠে আস্থা সংকট, প্রশাসনিক পক্ষপাতের অভিযোগ, দলীয় সংঘাত ও নির্বাচনী সহিংসতার ভয় যখন সাধারণ নাগরিকের মনে গেঁথে গেছে, তখন নির্বাচনের আগে বা নির্বাচনের দিনই গণভোটের মতো একটি প্রক্রিয়া কতটা সফল হতে পারে, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।
গণভোটের ধারণা গণতন্ত্রে নতুন নয়। যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট, তুরস্কের সংবিধান সংশোধন, কিংবা ফ্রান্সের নীতিগত ভোট—এসব উদাহরণ বিশ্ব রাজনীতিতে বহুল আলোচিত। তবে এসব দেশেও গণভোটের ফলাফল কখনো বিভাজন, কখনো স্থিতিশীলতা এনেছে। অর্থাৎ, গণভোট এখন একটি দ্বিমুখী অস্ত্র। যার সঠিক ব্যবহারে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়, কিন্তু অপব্যবহারে গণতন্ত্র দুর্বল হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেখানে ভোটাধিকার নিয়েই প্রশ্ন, সেখানে গণভোটের আয়োজন হতে পারে দ্বি-ধারী তরবারির মতো।
রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর নির্বাচন নতুন বাংলাদেশে ক্ষমতার উত্তরাধিকার, নেতৃত্বের রূপান্তর ও রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের এক ক্রান্তিকাল। দেশের তরুণ প্রজন্ম, প্রথমবার ভোট দিতে যাওয়া প্রায় দুই কোটির নতুন ভোটার, এবং সামাজিক মাধ্যমনির্ভর রাজনৈতিক সচেতনতা। সব মিলিয়ে এবার গণতন্ত্রের পরীক্ষার মঞ্চ অনেক বড়। কিন্তু এই বিশাল প্রেক্ষাপটে গণভোট যদি শুধু রাজনৈতিক প্রতীক বা কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে গণতন্ত্রের গণিতে নতুন বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতি যেন আবারও এক পুরোনো বৃত্তে ঘুরে ফিরে এসেছে। যেখানে শব্দটা নতুন, কিন্তু কৌশল পুরোনো। ফেব্রুয়ারি ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে কেউ বলছেন, এটি জনগণের মতামত যাচাইয়ের এক গণতান্ত্রিক পথ; কেউ বলছেন, এটি মূলত রাজনৈতিক বৈধতা প্রতিষ্ঠার এক অভিনব কৌশল। কিন্তু বাস্তব প্রশ্নটা অন্যখানে। যে দেশে গণতন্ত্রের গণিতই এখনো সঠিকভাবে দাঁড়ায়নি, সেখানে গণতন্ত্রবিহীন গণভোট আসলে কী অর্থ বহন করে? এখন বাংলাদেশের রাজনীতি আবার এক অনিশ্চিত মোড়ে দাঁড়িয়ে। দেশের রাজপথ, গণমাধ্যম ও সামাজিক পরিসর আবার উত্তপ্ত। প্রশ্ন একটাই, গণতন্ত্রের গণিতে এবার গণভোট নামের নতুন অঙ্ক কি যোগ হতে যাচ্ছে? নাকি এটি কেবল আরেকটি রাজনৈতিক কৌশল, যা ক্ষমতার সমীকরণে অজানা অঙ্ক তৈরি করবে?
বাংলাদেশে গণতন্ত্র বহুবার জন্ম নিয়েছে, আবার বহুবার আহতও হয়েছে। নির্বাচন হয়েছে, সরকার বদলেছে, কিন্তু জনগণের আস্থা ও অংশগ্রহণের ভিত্তি এখনো দুর্বল। ভোটের মাঠে নির্বাচন যতটা দেখা যায়, নির্বাচনযোগ্যতার সংকট তার চেয়ে অনেক গভীর। এই অবস্থায় গণভোট নামের প্রস্তাবটা যতটা আকর্ষণীয়, ততটাই ঝুঁকিপূর্ণও। কারণ, গণভোট কোনো জাদুকরী সমাধান নয়, এটি কেবল গণতন্ত্রের গণিতের একটি অংশ। আর গণতন্ত্রের সেই গণিত দাঁড় করাতে হলে আগে চাই স্বচ্ছ নির্বাচন, স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক সমঝোতা।
কিন্তু আমরা দেখছি, ২০২৬ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এসব মৌলিক ভিত্তি আবারও অনিশ্চয়তায় নিমজ্জিত। রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার প্রশ্ন, মিডিয়ার স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্ক—সবকিছু মিলিয়ে এক গভীর রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গণভোটের দাবি আসলে গণতন্ত্রের পথ মসৃণ করবে, নাকি আরও বিভ্রান্তি তৈরি করবে এ নিয়ে জনগণ দ্বিধাগ্রস্ত।
ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন আমরা কি গণতন্ত্রের মূলকে শক্তিশালী করতে গণভোট চাই, নাকি গণতন্ত্রের নামেই আরেকটি রাজনৈতিক অঙ্কের ফাঁদ তৈরি করছি? যদি প্রথমটি হয়, তাহলে গণভোট হবে ঐক্যের উৎসব। আর যদি দ্বিতীয়টি হয়, তাহলে এটি হবে নতুন বিভাজনের সূচনা। আমরা জানি গণতন্ত্রের গণিত জটিল, কিন্তু এর সমাধান একটাই। তা হচ্ছে সর্বদলীয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আস্থা, অংশগ্রহণ ও ন্যায্যতা ফিরয়ে আনা। আর এই তিন উপাদানেই হয়তো মিলবে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে রাজনৈতিক ক্রান্তিকালের অজানা অঙ্কের উত্তর।
গণতন্ত্রের গণিতবিহীন গণভোট মানে এমন এক উদ্যোগ যেখানে অংশগ্রহণের নিয়ম নেই, আস্থার সূত্র নেই, আর ফলাফল আগেই জানা থাকে। এটি গণতন্ত্রের সংজ্ঞায়ন নয়, বরং গণতন্ত্রের অভিনয়। গণভোটের আগে প্রশ্ন হওয়া উচিত কী নিয়ে ভোট হবে, কে ভোট আয়োজন করবে, ভোটের ফলাফল জনগণের কাছে কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই গণভোটের দাবি তোলা মানে গণতন্ত্রের সংখ্যাতত্ত্বকে শূন্য দিয়ে ভাগ করা।
বিশ্ব ইতিহাসে গণভোট কখনো ঐক্য এনেছে, আবার কখনো বিভাজন। স্কটল্যান্ড, ফ্রান্স, তুরস্ক কিংবা ব্রেক্সিট সব জায়গায় দেখা গেছে গণভোট তখনই কার্যকর হয় যখন গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে যেখানে নির্বাচনী ব্যবস্থাই বিতর্কিত, সেখানে গণভোট আয়োজন মানে নতুন এক রাজনৈতিক অঙ্কের জটিলতা তৈরি করা।
এখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো দুই বড় দলই নিজেদের অবস্থানকে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। সরকার বলছেন, গণভোট জনগণের মতামত যাচাইয়ের আধুনিক পথ। বিরোধী দল বলছেন, এটি একধরনের বিকল্প নির্বাচন, যা গণতন্ত্রের ধারা থেকে বিচ্যুত। মাঝখানে জনগণ যারা কণ্ঠহীন, ভোটাধিকারে সন্দিহান এবং রাজনৈতিক আশ্বাসে ক্লান্ত।
এই প্রেক্ষাপটে গণভোটের দাবি আসলে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের পথ না হয়ে সংকটের প্রলম্বন হতে পারে। কারণ, গণতন্ত্রের মূল চাবিকাঠি গণভোট নয়, আস্থা। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে না আনলে যে-কোনো গণভোট কাগজে-কলমে ভোট হয়ে থাকবে, গণতন্ত্রের আত্মায় নয়। গণতন্ত্রের গণিত শেখায়, ক্ষমতা মানে জবাবদিহি, আর জনগণ মানে উৎস। এই দুইয়ের সমীকরণ মিললে গণতন্ত্র টিকে থাকে। কিন্তু যখন ক্ষমতা হয় কেন্দ্রিক, আর জনগণ হয় প্রান্তিক, তখন গণভোটের মতো সুন্দর শব্দও হয়ে ওঠে রাজনৈতিক মুখোশ।
তাই ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রশ্ন একটাই, আমরা কি গণভোটের মাধ্যমে গণতন্ত্রের নতুন দিগন্ত দেখতে চাই, নাকি গণতন্ত্রের সংজ্ঞা থেকেই পালাতে চাই? যদি সত্যিই জনগণের মতামতকে মূল্য দিতে চাই, তাহলে আগে দরকার গণতন্ত্রের গণিত মেরামত করা। তারপর গণভোটের অঙ্ক কষা। গণতন্ত্রের গণিতবিহীন গণভোট কেবল রাজনৈতিক ক্রান্তিকালকে দীর্ঘায়িত করবে, কিন্তু সমাধান দেবে না। আর এই শিক্ষা আমাদের রাজনীতির জন্য যতটা জরুরি, দেশের ভবিষ্যতের জন্য তার চেয়ে বেশি।
গণতন্ত্রের গণিতে কোনো শর্ট্কাট নেই। গণভোট একটি গণতান্ত্রিক উপকরণ বটে, কিন্তু তা প্রয়োগ করতে হলে প্রয়োজন স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, নিরপেক্ষ প্রশাসন, মুক্ত সংবাদমাধ্যম এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এসব ছাড়া গণভোটের গণিত কেবল সংখ্যার খেলা হয়ে দাঁড়াবে, যার ফল গণতন্ত্র নয়, বরং রাজনৈতিক ক্রান্তিকালকে আরও দীর্ঘ করবে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে যে রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, সেখানে গণভোট দাবির পেছনে থাকা আট দলীয় নেতাদের বক্তব্য ও কৌশল দেখলে বোঝা যায় এটি কোনো গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন নয়। এটি একটি অজানা রাজনৈতিক কৌশল।
গণতন্ত্রের গণিতবিহীন এই গণভোটের দাবিতে যুক্তি কম, আবেগ বেশি। আট দলীয় নেতারা বলছেন, গণভোটই জনগণের চূড়ান্ত মত প্রকাশের পথ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে জোট নিজেদের দলীয় অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রই প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, তারা কি সত্যিই গণভোটের মতো অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া চান? নাকি এটি কেবল নির্বাচনী প্রস্তুতিহীনতা আড়াল করার এক নাটকীয় পদক্ষেপ?
বাস্তবতা হলো, আট দলীয় জোটের ভেতরে নীতি, লক্ষ্য ও নেতৃত্ব এই তিন ক্ষেত্রেই বিভাজন স্পষ্ট। একেক দল একেক রকম দাবি তোলে। কেউ সংবিধান সংশোধন চায়, কেউ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, কেউ আবার বিদেশি তত্ত্বাবধানে নির্বাচন দাবি করে। এই অগোছালো দাবিদাওয়ার ভেতর গণভোটের মতো গুরুতর বিষয়ও পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক স্লোগানে। গণতন্ত্রের মৌলিক সূত্রে যেখানে দরকার স্বচ্ছতা, সংলাপ ও বিশ্বাস, সেখানে আট দলীয় জোটের আন্দোলনে আছে হুমকি, অবিশ্বাস ও ক্ষমতার হিসাব।
তারা যে গণভোট দাবি করছে, সেটি বাস্তবে কী নিয়ে হবে এ প্রশ্নের উত্তর এখনো কেউ দেননি। অর্থাৎ, গণভোটের প্রস্তাব যুক্তির ভিত্তিতে না এসে এসেছে বিরোধিতার তাড়নায়। এমন একটি উদ্যোগ গণতন্ত্রকে সুসংহত না করে বরং অনিশ্চিত করবে। কারণ গণভোট তখনই অর্থবহ, যখন জনগণ তার ওপর আস্থা রাখে; আর আস্থা অর্জনের প্রক্রিয়া শুরু হয় দায়িত্বশীল রাজনীতি দিয়ে, বিশৃঙ্খল আন্দোলন দিয়ে নয়।
আজ দেশের রাজনীতি যে ক্রান্তিকালে পৌঁছেছে, তার বড় কারণ এই ধরনের অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আচরণ। গণতন্ত্রের গণিত শেখানো হয় যুক্তি দিয়ে, জোটবদ্ধ প্রতিহিংসা দিয়ে নয়। আট দলীয় জোট যদি সত্যিই জনগণের পক্ষে দাঁড়াতে চান তবে আগে তাদের নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তারপর গণভোটের মতো জটিল অঙ্ক কষতে হবে।
গণতন্ত্রের গণিতবিহীন গণভোটের দাবি আসলে গণতন্ত্রের নয়, রাজনৈতিক সুবিধার গণনা। আর এই ধরনের রাজনীতি যতদিন চলবে, ততদিন বাংলাদেশ রাজনৈতিক ক্রান্তিকালের অন্ধ গলিতেই ঘুরপাক খাবে।
অতএব, ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন আমরা কি গণতন্ত্রের মূলকে শক্তিশালী করতে গণভোট চাই, নাকি গণতন্ত্রের নামেই আরেকটি রাজনৈতিক অঙ্কের ফাঁদ তৈরি করছি? যদি প্রথমটি হয়, তাহলে গণভোট হবে ঐক্যের উৎসব। আর যদি দ্বিতীয়টি হয়, তাহলে এটি হবে নতুন বিভাজনের সূচনা।
আমরা জানি গণতন্ত্রের গণিত জটিল, কিন্তু এর সমাধান একটাই। তা হচ্ছে সর্বদলীয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আস্থা, অংশগ্রহণ ও ন্যায্যতা ফিরয়ে আনা। আর এই তিন উপাদানেই হয়তো মিলবে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে রাজনৈতিক ক্রান্তিকালের অজানা অঙ্কের উত্তর।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]
এইচআর/এমএস