ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নির্বাচন তাহলে ফেব্রুয়ারিতে হচ্ছে?

আমীন আল রশীদ | প্রকাশিত: ১১:২৩ এএম, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫

সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, প্রেস সচিব এবং নির্বাচন কমিশনের তরফে বারবার আশ্বস্ত করার পরেও দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের মনে প্রশ্ন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন কি আসলেই ফেব্রুয়ারিতে হচ্ছে? জনমনে এই সংশয়ের পেছনে নানা কারণ আছে। প্রথমত, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়ার বিষয়ে এই মুহূর্তে দেশে সক্রিয় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সুর এখনও অভিন্ন নয়। বরং সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির তরফে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য, দলের অভ্যন্তরীণ অবস্থা বিবেচনায় নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সেইসাথে মাঠে এখনও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি হয়নি বলেও মনে করে জুলাই অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা তরুণদের এই দলটি।

এর মধ্যে গত ৩ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের পরবর্তী সব কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছেন বাংলাদেশ কংগ্রেসের মহাসচিব আইনজীবী মো. ইয়ারুল ইসলাম। এই সপ্তাহেই রিটের ওপর শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।

রিট আবেদনকারী বলছেন, নির্বাহী বিভাগের ব্যক্তি দিয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও নির্বাচন পরিচালনা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিচার বিভাগের মতো স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনেরও নিজস্ব জনবল থাকতে হবে। সংবিধান অনুসারে নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করবে। কিন্তু সংবিধান লঙ্ঘন করে প্রতিটি নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগকে দেওয়া হয়। নির্বাহী বিভাগ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের চাহিদা অনুসারে নির্বাচন পরিচালনা করে। ফলে নির্বাচন নিয়ে নানামুখী বিতর্ক তৈরি হয়।

বস্তুত, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং উপজেলা নির্বাচন নির্বাহী কর্মকর্তারা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রিটে এই বিধানটি কেন আইনগত কর্তৃত্ব–বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, এ বিষয়ে রুল চাওয়া হয়েছে। ডিসি-ইউএনওদের পরিবর্তে জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদেরকেই রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। সেইসাথে নিজস্ব পদোন্নতি পদ্ধতির মাধ্যমে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের থেকে ইসি সচিব নিয়োগেরও নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদেরকেই নির্বাচনে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ এবং পদোন্নতি দিয়ে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদেরকেই ইসি সচিব নিয়োগের দাবিটি নতুন নয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও শামসুল হুদা কমিশনের আমলে এই দাবি উঠেছিল। নাগরিক সমাজের তরফেও এর যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়েছিল। এটির বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচন কমিশন আইনের সংশোধন প্রয়োজন হবে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, এই সংশোধন বা সংস্কারের জন্য জাতীয় নির্বাচনের সব কার্যক্রম স্থগিত রাখতে হবে। যদি আগামী নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে আইনি সংস্কার করে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদেরকেই নির্বাচনে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করার বিধান করা যায়, সেটি ভালো। না হয় এটি পরবর্তী সংসদের ওপর ছেড়ে দেয়া যায়। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের দুই মাস আগে এরকম একটি রিট করে নির্বাচনেরে সকল কার্যক্রম স্থগিত চাওয়ার পেছনে কোনো রাজনীতি আছে কি না, তা পরিষ্কার নয়। তবে এ বিষয়ে রিটের শুনানি নিয়ে উচ্চ আদালত কী নির্দেশনা দেবেন, সেটি তার এখতিয়ার।

এই যখন পরিস্থিতি তখন রবিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছ্নে সিইসি ও অন্য কমিশনাররা। তারা একইদিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনের প্রস্তুতি সম্পর্কে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে অবহিত করেছেন। বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া। এর আগে নির্বাচনের তফসিল বিষয়ে বৈঠক করে নির্বাচন কমিশন। বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, সাংবাদিকদের জানান, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ৮ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে যেকোনো দিন ঘোষণা করা হবে। তিনি জানান, যেহেতু একই দিনে গণভোট হবে, তাই এবার ভোট গ্রহণের সময় এক ঘণ্টা বাড়ানো হচ্ছে। সকাল সাড়ে সাতটায় ভোট গ্রহণ শুরু হয়ে চলবে বিকাল সাড়ে চারটা পর্যন্ত। 

নির্বাচন কমিশনের এই প্রস্তুতির মধ্যেও জনমনে এই প্রশ্ন আছে যে, শেষ পর্যন্ত ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে কি না তা তফসিল ঘোষণার পরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হবে কি না। 

স্মরণ করা যেতে পারে, সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষদিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আগামী ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে, সে জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করতে এই সরকারকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। তার ওই ১৮ মাস শেষ হবে ফেব্রুয়ারিতে।

কিন্তু একদিকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা, অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধের কারণে পরিস্থিতি ক্রমশই জটিল হচ্ছে। তার মধ্যে সাম্প্রতিক আরও কিছু ঘটনা জনমনে নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি করেছে।

জামায়াতে ইসলামীসহ আটটি দল পাঁচ দফা দাবি আদায়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ থেকে যে ধরনের বক্তব্য দিচ্ছে, তাতে রাজনৈতিক অনৈক্যের গন্ধ আছে। উপরন্তু একসময়ের ভোট ও জোটসঙ্গী বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বিরোধ বেশ প্রকাশ্য। বিশেষ করে ১৯৭১ ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান এবং বিপরীতে জামায়াতের ভোট চাওয়ার কৌশল—সব মিলিয়ে রাজনৈতিক অনৈক্যের গন্ধ বেশ তীব্র হচ্ছে।

এদিকে গণমাধ্যমের খবর বলছে, খালেদা জিয়া এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তারেক রহমানের দেশে ফেরাও অনিশ্চিত। তিনি কেন লন্ডন থেকে আসতে পারছেন না বা তার দেশে আসার সঙ্গে কী কী শর্ত জড়িত—তা নিয়ে বাজারে নানারকম কথা প্রচলিত আছে। যদি সত্যিই এই সময়ের মধ্যে ব্গেম জিয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত খারাপ কোনো সংবাদ আসে আর তারেক রহমান দেশে ফিরতে না পারেন, তাহলে সেই পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না বা নির্বাচন হবে কি না? দেশের অন্যতম প্রধান দল আওয়ামী লীগ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। তাদের দলের শীর্ষ নেতাসহ অধিকাংশই হয় পলাতক না হয় বিদেশে। অনেকে কারাগারে। সরকার তাদেরকে নির্বাচন করতে দেবে না এই ঘোষণা আরও আগেই এসেছে। তারওপর আরেক প্রধান দল বিএনপিও যদি নির্বাচনে যাওয়ার মতো অবস্থায় না থাকে তাহলে কাদেরকে নিয়ে নির্বাচন হবে? দেশের প্রধান দুটি দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হবে? সবকিছু নিয়েই একধরনের ধোঁয়াশা ও অস্পষ্টতা আছে। আবার দেশের পরিস্থিতি বেশি ঘোলাটে হয়ে গেলে যদি সরকার তা সামাল দিতে না পারে তখন একটি জাতীয় সরকার গঠিতে হবে—এমন গুঞ্জনও রয়েছে।

বস্তুত সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নানা বিষয় নিয়ে এত বেশি গুঞ্জন চলছে যে, কোনটা ফ্যাক্ট আর কোনটা গুজব বা গুঞ্জন—তা পার্থক্য করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সব গুজব গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়ে যে সত্যটি মনে রাখা দরকার তা হলো, অনির্বাচিত সরকার যত বেশিদিন ক্ষমতায় থাকে, দেশের জন্য ততই অমঙ্গল। সেটি অন্তর্বর্তী, তত্ত্বাবধাক কিংবা জাতীয় সরকার—যে নামেই হোক না কেন। অর্থাৎ যেকোনো মূল্যে দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে যাওয়া এবং একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে দেশের শাসনভার তুলে দেয়ার কোনো বিকল্প নেই।

তবে অভ্যুত্থানের পরে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশে যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে মনে হচ্ছে, নির্বাচনে জয়ী হয়ে যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন, তাদের জন্য দেশ পরিচালনা করা খুব সহজ হবে না। এমন অনেক সংকট হয়তো তাদের সামনে আসবে যা অনেকের ভাবনারও অতীত। এর মূল কারণ বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিকভাবে এমন একটি জায়গায় অবস্থান করছে যেখানে প্রতিবেশী ভারত, দূরবর্তী প্রতিবেশী চীন এবং সুদূরের যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার অনেক স্বার্থ রয়েছে। বঙ্গোপসাগরককেন্দ্রিক যে ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব তাতে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তাকে এমন অনেক জটিল পরিস্থতি মোকাবিলা করতে হতে পারে যা হয়তো এখনও সেভাবে আলোচনার মধ্যে নেই। সে কারণে অভ্যুত্থানের পরে যে ধরনের রাজনৈতিক ঐক্য কাঙ্ক্ষিত ছিল, গত একব বছরেও সেটি স্থাপন করতে না পারা একটি বড় ব্যর্থতা। কিন্তু এই ব্যর্থতা কাটিয়ে নির্বাচনের পরে যদি সত্যিই একটি জাতীয় সরকার গঠ্ন করা যায় এবং ক্ষমতায় যার যতুটুক অংশ থাকুক না কেন, দেশের স্বার্থে যদি সব দল ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ হয়তো একটা সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগোবে। অন্যথায় অভ্যুত্থানের পরে একটি শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের যে প্রত্যাশা জনমনে তৈরি হয়েছে, সেটি অধরাই থেকে যাবে।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।

এইচআর/জেআইএম