ফ্ল্যাশফিকশন
শেক্সপিয়ারের দোলনা
আবার কবে যাব যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে?
প্রশ্নটা মনে উঁকি দিল ফেসবুকের মেমোরিতে আসা কয়েকটা ছবি দেখে। চেনা দৃশ্যগুলো হঠাৎ ফিরিয়ে দিল সেই মধুর স্মৃতি।
ঐতিহাসিক নিদর্শন, শেক্সপিয়ারের সংগ্রহশালার জন্মঘরে ঢোকার কিছুক্ষণ পরই যেন কল্পযানে ভর করে কয়েক শতাব্দি পিছিয়ে চলে গেলাম তাঁর সময়কালে।
‘এবারই প্রথম এলে?’
হঠাৎ প্রশ্ন শুনে চমকে তাকালাম ঘরের ভেতর সংরক্ষিত একটা বহু পুরোনো ছোট্ট দোলনার দিকে।
বিস্মিত হয়ে দেখি, দোলনাটা নিজ থেকেই দুলতে শুরু করেছে। অথচ ভেতরে আসার পরও এটাকে দুলতে দেখিনি। ওখানে কেউ বসে নেই। কেউ স্পর্শও করেনি। তবু কেন দুলছে?
অপার কৌতূহলে ঘরটায় আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু সেই আলো দৃষ্টিকে শাণিত করছে না; বরং ধোঁয়াশা হয়ে গেল চারপাশ।
ভয়ে বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলাম দুলতে থাকা দোলনার দিকে। পাশের সাজানো-গোছানো অতি যত্নে রাখা খেলনা-পুতুলগুলোও একই সঙ্গে নড়াচড়া শুরু করে দিয়েছে।
‘কী ব্যাপার ! এসব কী ঘটছে?' মুখ ফসকে নিয়ন্ত্রণহীন প্রশ্ন বেরিয়ে গেল।
ভেতর থেকেই একটি কোমল শিশু-স্বর বলল, ‘বিস্মিত হওয়ার কোনও ব্যাপার নেই। এটা আমার দোলনা। আমিই দোলাচ্ছি। তোমাদের মুগ্ধতা দেখে শিশু-শেক্সপিয়ার, মানে আমিই, তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি। ভয় পাচ্ছ কেন? প্রশ্ন করো, কথা বল। তুমি এসেছ দেখে খুশি হয়েছি। আবার এলে আরও খুশি হব।’
আনন্দে ভেতরের শিশুসত্তা জেগে উঠল। কিছু বলার আগেই নিজ অন্তরে লুকিয়ে থাকা শিশুটি বলল, ‘অবশ্যই আসব। বারবার আসব তোমার এই জন্মঘরে।’
দোলনার দোল বেড়ে গেল। মন আর জীবনের দোলও। মনে হলো নিজেই বসে দুলছি এই পুরোনো কাঠের দোলনায়।
হঠাৎ বুকের ভেতর নরম শব্দে ভেসে এল, ‘ আমি এখন আসন নিয়েছি তোমার বুকের ঘরে। চাইলে হাত রেখে অনুভব করতে পারো। আমি সাড়া দেব।’
বুকের বাঁ পাশে হাত রাখলাম।
ধুপধুপ শব্দের স্পন্দন ছড়িয়ে যেতে লাগল বুকজুড়ে। শিশুকবির আদুরের ছোঁয়াও অনুভবকে আমূল নাড়িয়ে দিল।
‘হ্যাঁ, ঠিক জায়গায় হাত রেখেছ।এবার অনুভব করো আমাকে। লুকিয়ে রেখো বুকের মাঝে।’
আনন্দে ভরে উঠল মন। পরম সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে নিজেকে। সংরক্ষিত প্রতিটি জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। মন হচ্ছে এ দেখার শেষ নেই। প্রতিটি আসবাবপত্র যেন কথা বলতে চায়, শোনাতে চায় সেক্সপিয়ারের ছেলেবেলার নানা কথা। চলে যেতে মন চাচ্ছ না। তবু পুরো সংগ্রহশালা ঘুরে দেখার ইচ্ছায় অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে বেরিয়ে এলাম জন্মঘর থেকে।
সামনে খামারঘর ধরনের বাগান। ভেতরে ঘাসের সবুজ লনের মাঝখানে ছোট ছোট পাথর বসানো পথ দিয়ে হাঁটা যায়। এক ধরনের প্রশান্তি নিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে এলাম মূল বাড়ির উত্তর পাশে।
বাউন্ডারি প্ল্যান্টস--ইউ(Yew) বাগানকে হালকা গাঢ় সবুজে ডুবিয়ে রেখেছে। সব অনুভব মিলিয়ে ভালোলাগার ঘোরে ডুবে গিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখলাম পেয়ার (pear) গাছের ছায়াতে কি যেন নড়ছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে কিছু নেই। এবার ডানে তাকিয়ে দেখলাম ছায়াটা সরে গেছে জন্মভিটার পাশে লাগানো মালবেরি গাছের নিচে। অবয়বহীন ছায়াটা মানবছায়ায় রূপান্তরিত হয়ে হাতের ইশারায় ডাকছে এবার।
প্রথমে একটু ভয় পেলেও মুহূর্তে তা উড়ে গেল। মাথা উঁচু করে হেঁটে গেলাম ছায়ার সামনে। তাজ্জব হয়ে শুনলাম , 'তুমি এখানে কী কারণে এসেছ, তা আমি জানি।'
'কীভাবে জানো? ছায়া হয়েও কীভাবে কথা বলছ?'
'অন্যকে জানার আগে নিজেকে সঠিকভাবে জানো। নিজের দ্বিধা ঝেড়ে ফেলো, সত্য আর সাহসটাকে আঁকড়ে ধরো। তাহলে বুঝবে তুমি কেন এসেছ, আমিই বা কীভাবে জানি সব কথা। কীভাবে কথা বলছি, তাও জানতে পারবে।'
'তুমি কি অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী?'
'নিজের মনে সন্দেহ আর দ্বিধা আছে কি না আবিষ্কার কর।'
'তোমার কথায় মারপ্যাঁচ আর খোঁচা আছে। তোমার ওপর রাগ হচ্ছে।'
হাহাহা করে হেসে উঠল মানবছায়াটা।
'হাসলে কেন?'
'দেখলাম তোমার ভেতরে আগুন আছে কি না? মনের ভেতর যে সত্য জাগে সেটা তুমি বুক ফুলিয়ে বলতে পারো কি না, তাও দেখলাম।'
'ও আমাকে পরীক্ষা করছ? ছাত্র পেয়েছ?'
'শোনো, জীবনের প্রতিটা ঘটনা থেকে অভিজ্ঞতা নিতে হয়। পর্যবেক্ষণকে শব্দের সঙ্গে মেলাতে জানতে হয়। সব সময় নিজেকে ছাত্র ভাবতে হয়। বাস্তবতা আর ভাষার মিলনেই সাহিত্যের জন্ম হয়।'
'আমি যে সাহিত্যচর্চা করি, কীভাবে জানো তুমি?'
'সাধারণত সাহিত্যিকরা এখানে আসে। যারা মনের স্পন্দনকে, যত বিপজ্জনকই হোক না কেন, কম্পনহীন কলমের মাধ্যমে সাহসের সঙ্গে ফুটিয়ে তুলতে পারে তাঁরা এখানে আসে।'
'কলম' শব্দটা নিজের ভেতরটা নাড়িয়ে দিল। সাহিত্যিক হওয়ার গোপন ইচ্ছায় জ্বালানি ঢেলে দিল।
'তোমার কথা শুনে ভালো লাগছে। তবে জানতে ইচ্ছে করছে, ছায়ারূপে কেন আমাকে এভাবে পরামর্শ দিচ্ছ?'
'আমাকে দেখে ভয়ে পিছিয়ে যাওনি? সত্য খুঁজে নেওয়ার তাড়নায় এগিয়ে এসেছ! সেই তাড়নায় লুকিয়ে আছে তোমার সাহিত্যিক হওয়ার গোপন ইচ্ছা। এখন প্রয়োজন শ্রম। শব্দকে শ্রম আর সত্য দিয়ে গড়ে তুলতে পারলে, সাহিত্যচর্চায় সফল হতে পারবে।'
উদ্বেলিত আর নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে প্রায় চিৎকার দিয়ে আবার প্রশ্ন করলাম, 'এত কথা বলছ কিন্তু আসল কথা বলছ না কেন? তুমি কে তা জানাচ্ছ না কেন?'
' এখনো আবিষ্কার করতে পারোনি?'
'না। ছায়ার কথা আমি বিশ্বাস করব কেন? ভেতরের রহস্য আবিষ্কার না-করে আমি এখান থেকে যাব না।'
হাহাহাহা... আবারও উচ্ছ্বসিত হাসি ছড়িয়ে দিতে লাগল মানবছায়াটা। হাসতে হাসতেই বলল,'আমিই তোমার বুকের ঘরে আশ্রয় পাওয়া সেই শিশু, যে সামনের ওই মালবেরি গাছ তলে হেলেদুলে খেলে বড় হয়েছি।'
ঘোরমগ্ন অবস্থা থেকে বাস্তবে ফিরে বুঝলাম নিজেই দোল খাচ্ছি। দোলনার দড়িটা বাঁধা আছে শূন্যে-- এই খামারবাড়ির মনোরম উদ্যানের শূন্য আকাশে, অনন্তলোকের খুঁটির সঙ্গে।
ব্যাকুল হয়ে ছায়াটিকে খুঁজতে লাগলাম। চিৎকার করে বললাম, 'ছায়ারূপে নয়, মানবরূপে দেখা দাও। তোমাকে দেখে ধন্য হতে চাই।'
না। সাড়া নেই। ছায়াটা নেই । কোথাও নেই। পরিবর্তে দেখলাম যেখানে সেটা দেখা গেছে সেখানে গোলাপ, ডেলফিনিয়াম আর জেরানিয়া ফুলের বিছানা শোভা পাচ্ছে। হের্বস বা সুগন্ধি গাছ থেকে মনোময় সুগন্ধ বের হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশে।
মন খারাপ হয়ে গেল। বসে পড়লাম ফুলের কার্পেটে। যতদূর দেখা যায় প্রায় পুরো প্রাঙ্গণ পই পই করে খুঁজতে লাগলাম। কিছুই দেখা গেল না আর।
আকস্মিক মাথা ধরে গেল। মনে হলো মাথার ভেতর থেকে স্পার্কিং হচ্ছে। বৈদ্যুতিক স্পার্কিংয়ের মতো ঝলক তৈরি হচ্ছে। তখনই শুনলাম পরানজুড়ানো আরেক কথা, 'আমি আছি তোমার মস্তিষ্কে, আমার সৃজনজ্যোতির দোলনায় দোল খেতে পারলে সব সময় খুঁজে পাবে আমাকে।'
এইচআর/এমএস