ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নির্বাচন-নির্বাসন : নিপাতনে সিদ্ধ

মোস্তফা কামাল | প্রকাশিত: ০১:০০ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮

নির্বাচনের নামে দেশে বিভাজন আরো তুঙ্গে। প্রতিপক্ষকে পিটিয়ে-পাটিয়ে নির্বাসিত করার সংস্কৃতি এবার নতুন মাত্রা পেতে বসেছে। এতে এবার ভোটের দিন কী হবে? কী হতে পারে? নির্বাচনের পর দেশের পরিস্থিতি কী হবে? কোন দল জিতলে কোন দলের কী পরিমাণ লাশ পড়বে?- এ ধরনের শঙ্কাভরা প্রশ্নও কম নয়।

সুষ্ঠু-অংশগ্রহণমূলকের পাশাপাশি এবার সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের তাগিদও বেশি। অহিংস নির্বাচনের তাগিদটা বেশি যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে। দেশটির নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের কথা বলে আসছেন। পরে তা উচ্চারিত হয় বিদেশি আরো কয়েকজন কূটনীতিকের কণ্ঠে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কমতি নেই।

এরইমধ্যে বাংলাদেশে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে দমনমূলক পরিবেশের অভিযোগ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ- এইচআরডব্লিউ। নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠনটি বলছে, এ ধরনের অবস্থা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে। তারা নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনায় নিরপেক্ষ অনুসন্ধান দাবি করেছে সরকারের কাছে।

সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করারও দাবি করেছে। তাদের ‘ক্রিয়েটিং প্যানিক: বাংলাদেশ ইলেকশন ক্র্যাকডাউন অন পলিটিক্যাল অপন্যান্টস অ্যান্ড ক্রিটিকস’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি ৩৭ পৃষ্ঠার। সেখানে বলা হয়, ব্যাপক মাত্রায় নজরদারি, মুক্তভাবে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে বাধার মতো কর্তৃত্বপরায়ণ পদক্ষেপ চলছে। এর ফলে একধরনের ভয়ের আবহ সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিপক্ষ সব রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের ওপর সহিংস হামলা চলছে। পুলিশ বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীদের আটক ও গ্রেপ্তার করছে। মার্কিন কংগ্রেসে ‘টম ল্যান্টস হিউম্যান রাইটস কমিশনের অভিযোগও এমনই।

তাদের উদ্যোগে ‘বাংলাদেশে নির্বাচন এবং মানবাধিকার’ শীর্ষক এক আলোচনায় বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে বলে অভিযোগ করা হলো। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর জন সিফটন অভিযোগ করেছেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। ঘটছে গুম-খুনের ঘটনাও।

বিরোধীদলের লোকজন নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে সক্ষম হচ্ছে না স্বাভাবিকভাবে। বিশেষ বাহিনীর দমন-পীড়নে ভীত-সন্ত্রস্ত অনেকে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ এবং অবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এহেন নির্দয়-নিষ্ঠুর আচরণ থেকে বিরত করা উচিত। ভয়-ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে গণমাধ্যমেও। ফলে সাংবাদিকরা ঠিকমতো কাজ করতে সক্ষম হচ্ছেন না।

অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, বাংলাদেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে।’ ‘সাংবাদিক শহিদুল ইসলামকে অবশেষে জামিন প্রদান করা হলেও সরকারের পক্ষ থেকে হুমকি দেওয়া হয়েছে উচ্চতর আদালতে আপিল করার’—উল্লেখ করেন সিফটন। নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতির অবসানে মার্কিন কংগ্রেসকে ভূমিকা রাখার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে সিফটন বলেন, ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে পরবর্তীতে যে সরকার ক্ষমতা নেবে তাদের বৈধতা থাকবে না।

নির্বাচনী মৌসুমে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিপীড়নের বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক। একে ইস্যু করে রাজনৈতিক ফায়দাবাজিও ব্যাপক। আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘু নিরাপত্তা কমিশন গঠনের আশ্বাস দিয়েছে। ২০০১ এবং ২০১৪ সালে সংখ্যালঘু নির্যাতনে বিএনপি জামায়াতকে দায়ী করা হয়ে থাকে। কিন্তু এর আগে-পরে, আশ-পাশে আওয়ামী লীগও কি কম যাচ্ছে? ক্ষেত্রবিশেষে এগিয়েই থাকছে। হিউম্যান রাইটসের আলোচনায় এ বিষয়ও এসেছে। এসব অপকর্মের জন্য বাতকে বাত নির্বাচনকে দায়ী করার একটা প্রবণতা রয়েছে। তাহলে এ ধরনের নির্বাচনের কী দরকার-এমন প্রশ্নও বাদ নেই।

আধুনিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সূচনা ত্রয়োদশ শতকে ইংল্যান্ডে। গোপন ব্যালট পদ্ধতির প্রবর্তন ১৮৭২ সালে। আর সর্বজনীন ভোটাধিকারের বিধান চালু হয় ১৯২৮ সালে। বিশ্বে নির্বাচনের ইতিহাসে প্রাচীন অবস্থানে গ্রিস ও রোম। গোটা মধ্যযুগে রোমান সম্রাট ও পোপের মতো শাসক বাছাইও হতো এ রকম নির্বাচনী ব্যবস্থায়। প্রাচীন ভারতে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজারা বাছাই করতেন রাজাদের।

নির্বাচনের ইতিহাস অনেকটা জুড়েই রয়েছে ভোটাধিকারের প্রশ্ন। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের সংস্কৃতিতে প্রভাবশালী গোষ্ঠী ছিল পুরুষরাই। নির্বাচকমণ্ডলীতেও প্রাধান্য থাকত তাদেরই। যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে শুরুর দিকের নির্বাচনে জমিদার বা শাসক শ্রেণির পুরুষদের প্রাধান্য ছিল। ১৯২০ সাল পর্যন্ত অবশ্য পশ্চিম ইউরোপের সমস্ত দেশ এবং উত্তর আমেরিকার গণতন্ত্রে সর্বজনীনভাবেই পুরুষ ভোটাধিকার চালু ছিল।

নারীদের ভোটাধিকারের বিষয়টি আসে আরো পরে। আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যে গঠিত রাজনৈতিক দলের উদ্ভবের ফলে ঐতিহ্যগত নির্বাচন পদ্ধতির রূপান্তর ঘটেছে। নৃতাত্ত্বিকদের গবেষণায় পাওয়া যায়, আদিম জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।

প্রাচীন গ্রিসীয় শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচন হতো লটারির মাধ্যমে। আমেরিকার আদিবাসীদের অনেক গোত্রের লোকেরা নির্দিষ্ট কোনো পাত্রে শস্যকণা ছুঁড়ে গোত্রপতি নির্বাচন করত। প্রাচীন ভারতেও নির্বাচনের বিভিন্ন ধরন পাওয়া যায়। মোঘল শাসনবিধানে স্থানীয় প্রশাসন চালাতেন স্থানীয় মনোনীত ব্যক্তিরা।

জেলা পর্যায়ে ফৌজদার ও অপরাপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়োগ করতেন সম্রাট নিজে। অন্য কর্মকর্তাদের নির্বাচিত করত জনগণ। আর গ্রামের লোকেরা নির্বাচিত করত তাদের মোকাদ্দমপ্রধান, গ্রামপ্রধান, পাটোয়ারী বা কর আদায়কারী। গ্রাম মোকাদ্দমদের পরামর্শক্রমে নির্বাচিত হতেন পরগণা কাজী ও থানাদার। ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলে প্রচলিত গ্রাম পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাচনধর্মী বৈশিষ্ট্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস এই ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন। বিভিন্ন তথ্য ও ঘটনার প্রেক্ষিত বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলা অঞ্চলের মানুষ নির্বাচনমুখী। এটা তাদের কাছে উৎসবের মত। ঔপনিবেশিক শাসকরা সেটা বুঝেই গ্রামপ্রধান, পঞ্চায়েত, পাটোয়ারী, আমীন, মুনসেফ, থানাদার, কাজী ধরনের পদ তৈরি করে। সেগুলো করা হত কোনো না কোনো নির্বাচনী ব্যবস্থায়ই। সময়ে সময়ে তা বিতর্কিতও হয়েছে কারচুপি, জালিয়াতি পক্ষপাতিত্বের কারণে। নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা, ভোট কেনা ইত্যাদির ব্যাপারও ছিল। কিন্তু ঘুরে-ফিরে আবার নির্বাচনেই আসতে হয়েছে।

দোষ বা গোলমালটা নির্বাচনের নয়, পদ্ধতির। আরো খোলাসা করে বললে, এর আয়োজকদের। নির্বাচনের কর্তৃপক্ষ, ভোট দেয়া, নেয়া, গণনায় সম্পৃক্তরা সময়ে সময়ে একে কলঙ্কিত করেছেন। নির্বাচনকে বিনাভোটে পর্যন্ত এনে ঠেকানো হয়েছে। নির্বাচনকে একটা সুযোগ বা মওকা হিসেবে নেয়ার লোকের অভাব হয়নি কখনো। এরা আড়ালে থেকে কলঙ্কিত করেছে নির্বাচনকে। কিন্তু অঘটনের জন্য দায়ী করে নির্বাচনকেই নির্বাসনে পাঠানো সম্ভব হয়নি। জনমত নির্ণয়ে প্রচলিত ভোট পদ্ধতি নিয়ে নানা কথা থাকলেও বিশ্বে এখন পর্যন্ত এর বিকল্প আবিস্কার হয়নি।

ধরা যাক, এক’শ ভোটারের নির্বাচনে পাঁচজন প্রার্থী। তারা ভোট পেলেন যথাক্রমে ৭, ১২, ১৪, ১৭ এবং ২০টি করে। অর্থাৎ ভোট কাস্ট হয়েছে ৭০টি। আর ২০ ভোট প্রাপ্ত ব্যক্তিই জয়ী। অথচ তার বিরুদ্ধে পড়েছে পাক্কা ৫০ ভোট। কাস্টিংয়ের বাইরে ৩০টিসহ ধরলে ৮০ ভোটেরই বিপক্ষ তিনি। জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে পদ্ধতিটি ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু তা নিপাতনে সিদ্ধ-শুদ্ধ। এরচেয়ে ভালো পদ্ধতির তাগিদ থাকলেও তার খোঁজ মিলছে না। খোঁজ না মেলাতেই খোঁজার তাগিদ। খোঁজ পেলে বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থাটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ হতো না।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/এমকেএইচ