কাঠগড়ায় ই-কমার্স

অনলাইনে জিনিসপত্র কেনার অভ্যাস মানুষের যত বাড়ছে, ততই গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের পৃষ্ঠা ভরে উঠছে অভিযোগ আর অভিযোগে। লোভনীয় সব ছাড় দেওয়ার নামে পণ্য সরবরাহে বিলম্ব করা, পণ্য একেবারে না দেওয়া, দিলেও সেগুলো নকল, ভাঙাচোরা, নষ্ট ও নিম্নমানের ব্যবহার অনুপযোগী সামগ্রী দেওয়াই এখনকার ই-কমার্স দোকানগুলোর আসল ব্যবসা।
অনলাইন কেনাকাটা প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালি এখন সংবাদ শিরোনাম। সম্পদের চেয়ে দায় বেশি নিয়ে গ্রাহকদের পণ্য দিতে ব্যর্থ হয়ে ব্যাপক আলোচনায় এই জনপ্রিয় অনলাইন দোকান। বাংলাদেশে বেশ কয়েক বছর ধরে অনলাইনে কেনাকাটা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। শুরুতে ছিল পণ্য হাতে পেয়ে দাম পরিশোধ প্রথা। ইভ্যালিসহ বেশি দোকান অগ্রিম টাকা নিয়ে পণ্য সরবরাহ করছিল। অবিশ্বাস্য কম দামে পণ্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে ইভ্যালিতে। কিন্তু টাকা পরিশোধ করেও মাসের পর মাস পণ্য না পেয়ে মানুষ যখন দিশেহারা তখন তদন্তে নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে সম্প্রতি ইভ্যালি.কম.বিডি-এর ওপর পরিচালিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিদর্শন রিপোর্টে উঠে নানা চমকপ্রদ তথ্য। গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে ইভ্যালির দেনার পরিমাণ ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বিপরীতে কোম্পানিটির চলতি সম্পদ মাত্র ৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। সম্পদের চেয়ে ৬ গুণের বেশি দেনা কোম্পানিটির পরিশোধ করার সক্ষমতা নেই বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৪ মার্চ পর্যন্ত পণ্যমূল্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম ২১৩.৯৪ কোটি টাকা নিয়ে পণ্য সরবরাহ করেনি ইভ্যালি। অন্যদিকে, ইভ্যালি যেসব কোম্পানির কাছ থেকে পণ্য কিনে সেসব মার্চেন্টদের কাছে কোম্পানিটির বকেয়া ১৮৯.৮৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সব মিলিয়ে ইভ্যালির চলতি সম্পদ দিয়ে গ্রাহক ও পাওনাদারদের বকেয়া অর্থের মাত্র ১৬ দশমিক ১৪ শতাংশ পরিশোধ করা সম্ভব। বাকি প্রায় ৮৪ শতাংশ বা ৩৩৮ কোটি ৬২ লাখ টাকার সমপরিমাণ দায় অপরিশোধিত থেকে যাবে। ইভ্যালির চলতি সম্পদের স্থিতি দিয়ে শুধু গ্রাহক দায়ের এক-তৃতীয়াংশেরও কম পরিশোধ করা সম্ভব হবে।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই প্রতিবেদনের পরই ঝড় উঠে ই-কমার্স নিয়ে। চারদিকে এখন শোরগোল। প্রশ্ন ওঠে ইভ্যালিসহ বেশ কিছু এমন অনলাইন দোকানের ব্যবসার ধরণ নিয়ে। বলতে গেলে ইভ্যালিরতো বেটেই, অন্যান্য এমন দোকানের গ্রাহকদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। পণ্য বা টাকা ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। গণমাধ্যমে ফোন করে মানুষ জানতে চাচ্ছে চিটফান্ড কোম্পানি ডেসটিনি, যুবক বা ইউনি পে’র মতো পরিণতি হতে যাচ্ছে এদের পরিণতি?
এই যে শত শত বা আজস্র ব্যক্তি গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারী মার্চেন্ট প্রতিষ্ঠান এমন এক অনিশ্চয়তার পড়ল, এর মধ্য দিয়ে কি তবে ই-কমার্সের আপাতত সমাধি হতে চলেছে বাংলাদেশে? উত্তর বলা কঠিন।
বিজ্ঞাপন
করোনার আগে থেকেই শুরু হয়েছিল, তবে করোনা কালে বর্ধিষ্ণু হতে থাকে এই ডিজিটাল কমার্স। ডিজিটাল কমার্স পরিচালনায় স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিছু নির্দেশনাও জারি করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, মার্কেটপ্লেসে বিক্রয়যোগ্য পণ্য ও সেবার তথ্য প্রদর্শন ও ক্রয়-বিক্রয়ের সাধারণ নিয়মাবলি দেশের সংশ্লিষ্ট সব প্রচলিত আইন ডিজিটাল কমার্স পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাফ সাফ বলে দিয়েছে, ডিজিটাল কমার্স বা ই-কমার্সের মাধ্যমে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা করা যাবে না।
বাংলাদেশে সবকিছুই শেষ পর্যন্ত অনিয়ম আর প্রতারণার পর্যায়ে চলে যায়। মানুষের আর আস্থা থাকে না। ই-কমার্স সাইটগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমছে ভোক্তা অধিদফতরে। যার মধ্যে সর্বাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে ইভ্যালির বিরুদ্ধে। ভোক্তা অধিদফতর যেসব প্রতারণার কথা বলছে, তার প্রথমটিই হচ্ছে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে না দেওয়া। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য না দেওয়া।
প্রচারণা ভেদে ইভ্যালির পণ্য সরবরাহ করার কথা ৭ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে। কিন্তু সেই শর্ত কখনই মানে না প্রতিষ্ঠানটি। কখনও ৬০ দিনে, কখনও ৯০ দিনে পণ্য দেওয়া হয়। আবার কখনও পণ্য দেওয়া হয় না, টাকাও ফেরত দেওয়া হয় না। আরও অভিযোগ হল– ইভ্যালি এক পণ্যের বিজ্ঞাপন দিয়ে আরেক পণ্য দেয়। বিভিন্ন রকমের আকর্ষণীয় অফার দেয়। এসব অফারে থাকে বড় ধরনের মূল্যছাড়ের ঘোষণাও। এ কাজ শুধু ইভ্যালি করছে তা নয়, করছে আরও অনেক সাইট।
বিজ্ঞাপন
ইভ্যালি আলোচিত। তাই তার ব্যাপারে মানুষ জানতে পারছে। সমস্যা দুই জায়গায়। ই-কমার্স খাতকে সরকারিভাবে কঠোর নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে অতি কড়াকড়িতে খাতটির বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গত কয়েক বছরে ই-কমার্স খাতটি যেভাবে বড় হচ্ছে, যে হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে, অতি বেশি নিয়ন্ত্রণ করা হলে এসব বিষয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে মানতেই হবে যে, শক্তিশালী আইনি কাঠামোর কোন বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের সমস্যা হলো এখানকার মানুষ স্বল্প শিক্ষিত এবং অনেক বেশি হুজুগে। মূল্য ছাড় আর ক্যাশ-ব্যাক জাতীয় অফারে এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে অনেকেরই হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। সরকার আইনি কাঠামো নিয়ে কাজ করছে। তবে এখানে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মসহ ব্যবসায়ী সমাজে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের ভূমিকা অনেক। বিশেষ করে এফবিসিসিআই-এর। একটা স্বচ্ছ কাঠামোর মধ্যে এই ব্যবসাকে নিয়ে আসার উদ্যোগ চেম্বার নেতৃত্বকে নিতে হবে। আর অবশ্যই ক্রেতাদের সতর্ক থাকতে হবে। যারা অস্বাভাবিক অফার দেয়, তাদের সন্দেহ করতে শিকতে হবে। অনলাইনে কার্ড বা বিকাশ-নগদের মতো সিস্টেমে পেমেন্ট করলে কিছুটা হলেও পেমেন্ট কন্ট্রোল করা যায়। এর বাইরে ভিন্ন পন্থায় যদি ক্রেতারা অগ্রিম টাকা টাকা দিয়ে দেয়, তাহলে সমস্যা হতেই পারে।
সরকার গ্রাহক উপযোগী নীতিমালা ও আইনি পদক্ষেপ নিক তবে মানুষের নিজস্ব সচেতনতাই সবচেয়ে বেশি জরুরি।
বিজ্ঞাপন
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/এমএস
বিজ্ঞাপন