ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মনিদের মুঠোয় মোবাইল মারণাস্ত্র

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম | প্রকাশিত: ১০:১৩ এএম, ৩০ ডিসেম্বর ২০২২

যুদ্ধবাজদের মনের মণিকোঠায় যখন ভয়ংকর মারণাস্ত্র ব্যবহার করার আশঙ্কা নিয়ে বিশ্ব জনমনে ভীতির সঞ্চার হচ্ছে তখন ভিন্ন আরেকটি মারণাস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার নিয়ে আমরা গভীরভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েছি। সেটি হলো ছোট্ট শিশুদের হাতে হাতে মোবাইল ফোন। সেগুলো এখন কোনো সাধারণ খেলনা নয় বরং ইন্টারনেট সংযুক্তিসহ দামি মোবাইল ফোনসেট। এটা এখন তাদের বায়না ধরার প্রধান আকর্ষণের বস্তু, যা তাদের হাতে না দিলে বিড়ম্বনা আর দিলে আরও বেশি বিড়ম্বনা ও ভয়ংকর বিপদের বিষয় হয়ে গেছে।

বড়দের তুলনায় ছোট শিশুরা আজকাল মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে বেশি পটু। ওরা কোনো কিছুর জন্য সমস্যায় পড়লে ক্যান্ডি, লজেন্স, বিস্কুট দিয়ে তাদের মন ভোলে না, কান্নাও থামানো যায় না। তাদের কার্টুন দেখা, ছবি তোলা, ভিডিও করা, গান শোনা ইত্যাদির জন্য বড়দের মতো মোবাইল ফোন চাই।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

জেদ চাপলে যতই ডেস্কটপ, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, পামটপ বা ট্যাব ইত্যাদি দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হোক না কেন, ওদের আকর্ষণ বা নজর সেগুলোতে নেই। নজর চলে যায় মোবাইল ফোন সেটটির দিকে। আগ্রহ সেটাতেই বেশি। মা-বাবা, অভিভাবকরা ওদের জেদ থামাতে হাতে তুলে দেন দামি মোবাইল সেট। সঙ্গে উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ। তখন ওরা খাওয়া, পড়া, ঘুম ভুলে গিয়ে সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

এতে সবার চোখের সামনে আগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ওদের সবার মূল্যবান চোখ দুটো। কারণ, মজা পেলে ওরা অন্যদিকে চোখ ফেরাতে চায় না। আনমনে একদৃষ্টে ক্ষুদ্র ডিজিটাল পর্দায় চেয়ে থাকে। অবুঝ শিশুদের চোখ ধ্বংস হচ্ছে দীর্ঘ সময়ব্যাপী মোবাইল ফোনের রঙিন আলোময় পর্দার দিকে তাকিয়ে থেকে কার্টুন, সিনেমা, নাটক, গানবাজনা, গেম খেলতে খেলতে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আমরাও ওদের এ বিষয়ে বড় বেশি পাত্তা দিচ্ছি। একটি ছবি বা গেম ভালো না লাগলে মুহূর্তেই এক বিষয় থেকে ওদের মনোযোগ চলে যাচ্ছে ভিন্ন দিকে। কোনো কিছুতেই স্থির না থেকে হঠাৎ করে নতুন একটি অজানা জগতে বিচরণ করতে গিয়ে ওরা সেগুলো আগামাথা কিছুই ঠাহর করতে না পেরে মস্তিষ্কের মধ্যে জটিলতা তৈরি করে ফেলছে। এত মনোদৈহিক সমস্যার মধ্যে নিপতিত হয়ে তার মাধ্যমে নতুন জেদ সৃষ্টি করে অভিভাবক অথবা মা-বাবার ওপর চাপাচ্ছে।

এ যুগে আমাদের দেশে ধনী-দরিদ্র প্রায় সবার বাড়িতেই মোবাইল ফোনের ব্যবহার চলছে। সঙ্গে ইন্টারনেটের সংযুক্তি অনেকটাই বাধ্যতামূলক। ওয়াইফাই সব জায়গায় না থাকলেও মোবাইল ডাটা কিনে ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে ব্যাপকভাবে।

বিজ্ঞাপন

শহরে তো বটেই, গ্রামগঞ্জেও শিশু-কিশোরদের হাতে দামি মোবাইল ফোনসেট দেখতে পাওয়া যায়। করোনাকালে অনলাইন শিক্ষণ চালু হলেও এখন তেমন ভার্চুয়াল পড়ালেখা নেই। এখন ওরা দীর্ঘসময় ইন্টারনেট দিয়ে অহেতুক কি কাজ করে তা অনেকাংশে বোধগম্য নয়। ওদের অনেকের বাবা-মা ইন্টারনেট জিনিসটা কি সে সম্পর্কে ওয়াকেবহাল নন। কিন্তু সন্তান আব্দার করলে সেজন্য অর্থ ব্যয় করেন।

এই বাড়তি অর্থ ব্যয় সবার জন্য সম্ভব হয়ে ওঠে না। অর্থ না পেলে শিশু-কিশোররা বেঁকে বসে এবং নানা অবৈধ উপায়ে টাকা জোগাড় করতে গ্যাং কালচার ও অপরাধ করে বসে। এটা এখন সবাইকে একটি জটিল প্রশ্নের সন্মুখীন করে তুলেছে। সেদিন একটি বিরতিহীন ট্রেনের মধ্যে কয়েকজন জ্ঞানী মানুষের সঙ্গে সাড়ে চার ঘণ্টাব্যাপী একত্রে ভ্রমণ করছিলাম।

সেসময় রাশিয়ার পারমাণবিক মারণাস্ত্র ব্যবহার করার সম্ভাবনা নিয়ে একজন খুব আশঙ্কা করে নানা গল্প করছিলেন। সবাই বেশ মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছিলাম। কিন্তু আরেকজন যাত্রী তার বাড়িতে মোবাইল ফোন নামক মারণাস্ত্রের ব্যবহার বেশ কয়েক বছর আগেই শুরু হয়েছে বলে গল্পের মোড় তার দিকে টেনে নিয়ে গেলেন।

বিজ্ঞাপন

পাশে বসা বিজ্ঞ অন্য আরেকজন অনেক্ষণ ধরে সিটে বসেই ঘুমাচ্ছিলেন। কিন্তু আমাদের মোবাইল ফোনের মারণাস্ত্র নিয়ে আলোচনা শুরু হলে তিনি বেশ নড়েচড়ে উঠে সরব হয়ে আলোচনায় শামিল হয়ে গেলেন। তার অবস্থা নাকি আরও বেশি ভয়ানক হয়েছিল। তিনি সেটার বর্ণনা দিতে থাকলেন এবং ওই সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে কি কৌশল অবলম্বন করেছিলেন তারও একটা মূল্যবান ফিরিস্তি দিলেন।

তিনি করোনাকালীন ঘরবন্দি থাকা অবস্থায় তার সোনামনিদের মণিকোঠায় মোবাইল নামক মারণাস্ত্রের নেশা ঢুকে যাওয়ায় বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তার সন্তানরা ইন্টারনেট সংযোগের আগে মোবাইল ফোন দিয়ে কথা বলতো, ছবি তুলতো, গান শুনতো। তাই তেমন একটা অসুবিধা হতো না। কিন্তু বাড়িতে ওয়াইফাই সংযুক্তির সুবাদে মোবাইল ফোনে সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট থাকায় বিপদ ঘটা শুরু হতে থাকে। ওরা তিন শিশু নিজেদের জন্য বরাদ্দ একটি ফোনসেট ছাড়াও সুযোগ পেলে বাবা-মায়ের ফোনসেট নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে শুরু করে। খাওয়া, পড়াশোনার সময় এমনকি ঘুমানোর সময়ও লুকিয়ে নেট ব্যবহার করতে শুরু করে। এটা ওদের ভয়ংকর নেশায় পরিণত হয়ে যায়।

সামনে সমূহ বিপদ দেখে ওদের বড় দুজনকে শাসন করে অনেকটা নিবৃত্ত করা গেলেও সবার ছোটজনকে কিছুতেই বাধ মানানো যাচ্ছিল না। তার হাতে সব সময়ের জন্য নেটযুক্ত দামি ফোনসেট চাই। ওটা হাতে না দিলে সে কিছুতেই কান্না থামাতো না। তিনি জানালেন, উপায়ন্তর না দেখে শিশুদের সঙ্গে কিছুুটা অভিনয় বা ছলনা করতে হয়েছে। একদিন অফিসে যাওয়ার আগে ছাদ বাগানে কাজ করার উছিলায় উপরে উঠে ওয়াইফাইয়ের সংযোগ কর্ডটি খুলে ফেলি।

বিজ্ঞাপন

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে ইন্টারনেট সংযোগ না পাওয়ায় ওদের অভিযোগ শুনি। এজন্য বাসায় তারা অনেক হইচই করেছে। ওদের অনুরোধে কর্ড কোথাও ছিঁড়েছে কি না সেটা রাতেই টর্চ দিয়ে চেকআপ করে আসি। পরদিন ইন্টারনেটের লাইনম্যানকে ডেকে পুনরায় চেক করে দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করে সবাইকে ঘুমাতে বলি। বড়জন মোবাইল ডাটা কিনে দেওয়ার জন্য চাপাচাপি করলে সেটা কিনে দিইনি। অন্য দু’জন তখনও মোবাইল ডাটা ব্যবহারের কথা জানতো না।

এরপর দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি ছিল। তাই টেকনিশিয়ান আসতে পারবে না বলে আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল। তারপর জানা গেলো ওর পরিবারে করোনা হয়েছে। তাই তিনি আসতে পারবেন না। এই কথা জানতে পরে আমি কিছুটা আশার আলো দেখি। করোনার সময় টেকনিশিয়ানকে বাসার ভেতর ঢুকতে দেওয়া যাবে না বলে শিশুদের আস্বস্ত করি। এভাবে ইন্টারনেটবিহীন পাঁচদিন কেটে যায়। তখন ওদের নানা ধরনের গল্পের বই দিয়ে পড়তে বলি। এরপর রাতের খাবারের পর যে আমাকে ভালো গল্প শুনিয়ে খুশি করতে পারবে তার জন্য দামি গিফট দেওয়ার ঘোষণা দিই।

মধ্যখানে রমজানের রোজা শুরু হলে একঘেয়েমি পড়াশোনার কথা না বলে ওদের কেরাত, হামদ, নাত মুখস্থ করে আমাকে শোনাতে বলি। এজন্য ঈদে দামি দামি পোশাক কিনে দেওয়ার কথা বলি। এভাবে একমাস ইন্টারনেটের নেশা থেকে তাদের মন ও দৃষ্টি অন্য কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করি। তবুও সবার ছোটজন একদিন বলে বসে টেকনিশিয়ান কবে আসবে ইন্টারনেট ঠিক করে দিতে! সবচেয়ে ছোট্ট শিশুটির স্মরণশক্তি দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। তাকে বলি নেটের লাইন ঠিক করে না দিলে ওদের আর বিল দেব না।

বিজ্ঞাপন

সে তখন পর পর কয়েকদিন আমাকে শোনাতে আব্বু লাইন ঠিক করে দিতে না আসলে ওদের আর বিল দিয়ো না। আমাকে টাকাগুলো দিয়ে ভালো গল্পের বই আর জুতো কিনে দিও। আমি ওর কথায় বেশ খুশি হই। এভাবে মাস দুয়েক কেটে গেলে ওরা মোবাইল ফোন দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারের কথা ভুলে যায়। তবে বড় সন্তানের অনলাইন ক্লাসের জন্য ডেস্কটপে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে শুধু ওকে পাসওয়ার্ড জানিয়ে দিই। এভাবে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

ওনার গল্প শুনে আমরা তাকে জানালাম যে আপনার এই প্রচেষ্টাটি বেশ শিক্ষণীয়। অবুঝ সন্তানদের মোবাইল নেশার মারণাস্ত্র থেকে বাঁচানোর জন্য আমাদের সমাজে আর কারা কোন পদ্ধতি ব্যবহার করছেন সেগুলো জানতে পারলে বেশ ভালো হতো। এজন্য মোবাইলে ইন্টারনেট আসক্ত সন্তান সম্পন্ন পরিবারগুলোর ওপর আশু গবেষণা চালানো প্রয়োজন।

কারণ দিন দিন লাখ লাখ পরিবারের অগণিত শিশুর মনের মণিকোঠায় ঠাঁই করে নিয়েছে মোবাইল ফোন নামক চেনা মারণাস্ত্র। কিন্তু চোখের মণিকোঠা ধ্বংস করে ভিন্ন এক জগতে চলে যাচ্ছে শিশু-কিশোররা। এগুলো তদারকির জন্য নেই কোনো তাগাদা। নেই কোনো পর্যবেক্ষণ, নেই কোনো গবেষণা। তাই এই ভয়ংকর দিকটি আমাদের সবার গোচরে থাকলেও অবহেলা করে চলেছি। ব্যাপকভাবে হাতে হাতে ছড়িয়ে যাওয়া এই ভয়ংকর মারণাস্ত্র থেকে আমরা দৃষ্টি ফেরাবো কীভাবে? আর ওদের সুন্দর ভবিষ্যৎ বাঁচাবোই বা কীভাবে?

বিজ্ঞাপন

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/এমএস

বিজ্ঞাপন