ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

রাজশাহীতে আন্দোলন : রাকাবকে একীভূত নয়

গোলাম সারওয়ার | প্রকাশিত: ০৬:৫৩ পিএম, ২০ এপ্রিল ২০২৪

সরকারি বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সাথে একীভূত করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজশাহী। ফুঁসে উঠেছে এখানকার বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মী, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। তাদের একটাই দাবি।

রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক যেমন আছে, তেমনি থাকবে। কারও সাথে একীভূত নয়।রাজশাহীবাসীর এটা প্রাণের প্রতিষ্ঠান। রাজশাহীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে এ প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এটি উত্তরাঞ্চলের কৃষি ও কৃষকের আপন ব্যাংক।

প্রয়োজনে এর সংস্কার করা যেতে পারে। কিন্তু একত্রীকরণ নয়। পুরো ব্যাংক সেক্টরে যখন অশনিসংকেত, দুর্নীতি যেখানে স্থায়ী রূপ নিয়েছে, সেখানে শুধু রাকাবকে নিয়ে বিচার করাটা সমীচীন হবে না। দেশের ভালো চাইলে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, দুর্নীতিবাজ ও অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করুন। সুশাসন ফেরাতে ও খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে প্রয়োজনে ব্যাংকের পরিচালনগত ব্যর্থতা চিহ্নিত করে দক্ষ ও যোগ্য পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ দিন।

খেলাপি অর্থ আদায়ে আইনি কাঠামো কঠোর করার ব্যবস্থা নিন। ব্যাংক পরিচালনায় জবাবদিহির ব্যবস্থা করুন। সঠিক তদারকির পরিবেশ ফিরিয়ে আনুন। এগুলো না করে প্রতিষ্ঠানের ওপর দোষ চাপিয়ে অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করাটা আত্মঘাতীর শামিল হবে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কল্লোল মোস্তফা তার এক নিবন্ধের উপসংহারে বলেন, ‘এরকম অবস্থায় ব্যাংক খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতির মূল কারণগুলো দূর না করে, নীতিনির্ধারকদের জবাবদিহির ব্যবস্থা না করে এবং দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিচারের ব্যবস্থা না করে ব্যাংক একীভূত করা হলে অনিয়ম ও দুর্নীতিরও একীভবন ঘটার আশংকা রয়ে গেছে।’ আসলে আমরা যে যত কথাই বলি না কেন, এগুলো সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে সরকার তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের সদিচ্ছার ওপর।

বিষয়গুলো দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দূরে এসে নজরদারি কর্তৃপক্ষ যদি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করে, তবে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক তার অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছাতে শুধু সময়ের ব্যাপার বলে সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। Information security management system স্থাপন, বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের মধ্যে রাকাব প্রথম ISO সনদ অর্জন করে আধুনিক ব্যাংকিং সিস্টেমের দিকে এগোচ্ছে এই ব্যাংকটি।

চলতি অর্থবছর ৩৮৩টি শাখার মধ্যে ৩৫৫টি শাখা লাভে আছে। মাত্র ২৮টি লোকসানে। এমতাবস্থায় ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনদের দৃঢ় বিশ্বাস, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা ফিরিয়ে এনে ব্যাংকটির মূলধন সংকটের জন্য বার বার সরকারের দ্বারস্থ না হয়ে কৃষকের ঋণে সুদ ভর্তুকি দিলেই সমস্যা কেটে যেতে পারে। এতে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি মজবুত হবে, স্বচ্ছতাও বাড়বে।

রাকাবকে বিকেবির সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে ১৬ এপ্রিল রাজশাহী মহানগরীর সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এর পরের দিন বুধবার এই একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি রাকাবের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের কাছে হস্তান্তর করে রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের সচেতন ব্যবসায়ীমহল।

মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য দেন রাজশাহী মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ইউনিট কমান্ড, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ইউনিট কমান্ড, রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়ন, রাজশাহী সংগ্রাম পরিষদ, জাতীয় শ্রমিক লীগ রাজশাহী মহানগর শাখা, রাজশাহী সড়ক পরিবহন গ্রুপ, জেলা ট্রাক মালিক সমিতি, রাজশাহী সিটি (ক্ষুদ্র) পাদুকা ব্যবসায়ী মালিক সমিতি ,রাজশাহী জেলা জুয়েলার্স এসোসিয়েশন, তরুণ ও উদীয়মান উদ্যোক্তা, রাজশাহী জেলা ইট প্রস্তুতকারক মালিক সমিতি, রাজশাহী বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতি, রাজশাহী রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা।

সমাবেশে মূল বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং কবি অধ্যাপক রুহুল আমিন প্রামাণিক। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের প্রতীক।একটি কুচক্রী মহল রাজশাহী থেকে এই অঞ্চলের উন্নয়নে যুক্ত ব্যাংকটি সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এর পেছনে যারা কলকাঠি নাড়ছে, তারা এ অঞ্চলের ভালো চান না। এই একীভূত করার সরকারি সিদ্ধান্ত যতদিন বাতিল না করা হবে, ততদিন আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। হরতাল, ধর্মঘটসহ প্রয়োজনে কঠোর থেকে কঠোরতর কর্মসূচি দিতে পিছপা হবেন না রাজশাহীবাসী।

প্রসঙ্গত গত ৩ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে সভায় সরকারি খাতের দুটি ব্যাংককে অন্য দুটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। জানানো হয়, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সাথে একীভূত হবে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণ হবে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক।

এই চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে রাকাব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ এবং আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ অবস্থায় তাদের দাপ্তরিক কাজেও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। অফিসে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে।অফিস কর্মীদের চেহারায় উদ্বিগ্নের ছাপ।

এদিকে রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাসুদুর রহমানের স্বাক্ষরিত ওই স্মারকলিপিতে রাকাব-বিকেবি একীভূত না করার পক্ষে ১১টি যুক্তি তুলে ধরা হয়। প্রথমত, ব্যাংক একীভূতকরণের যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, তাতে বিকেবির মতো একটি বৃহৎ লোকসানি ব্যাংকের সঙ্গে রাকাবকে মিলিত করা হলে একীভূতকরণের যে সুফল তা অর্জন করা সম্ভব হবে না।

দ্বিতীয়ত, বিকেবির প্রতি বছর লোকসানের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। পক্ষান্তরে রাকাব বিগত তিনটি অর্থবছর থেকে অপারেটিং মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। রাকাবের লোকসানি শাখার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। প্রত্যাশা করা যায়, আগামী দুই বছরের মধ্যে এ ব্যাংকে কোনো লোকসানি শাখা থাকবে না। ব্যাংকটি চলতি অর্থবছর ব্রেক ইভেন পয়েন্টে পরিচালিত হবে এবং আগামী অর্থবছর নিট মুনাফা অর্জনে সক্ষম হবে বলে ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

তৃতীয়ত, আর্থিক ও প্রশাসনিক বিভিন্ন সূচকে বিকেবির তুলনায় রাকাব ভালো অবস্থায় আছে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে রাকাবকে একীভূত করা হলে বিগত কয়েক বছরে রাকাবের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ম্লান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একীভূত করা হলে ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ মূলধন ঘাটতি ও ক্রমপুঞ্জীভূত লোকসান কাটিয়ে মুনাফা অর্জন অসম্ভব হয়ে পড়বে।

চতুর্থত, কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা থেকে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হলে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে কৃষিভিত্তিক ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করা বর্তমানের চেয়ে অনেকাংশে মন্থর হয়ে পড়বে। ফলে এ অঞ্চলের সব শ্রেণি পেশার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

পঞ্চমত, রাকাবের প্রধান কার্যালয় রাজশাহীতে অবস্থিত হওয়ায়, এ অঞ্চলের কৃষি ও কৃষিসংশ্লিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্যেও উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। এমনকি রংপুর অঞ্চলের মঙ্গা দূরীকরণসহ অনেকাংশে কর্মসংস্থান সম্ভব হয়েছে। ব্যাংক দুটি একীভূত করা হলে চলমান অগ্রগতির ধারা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।

ষষ্ঠত, পারস্পরিক তুলনায় রাকাবের ক্রমপুঞ্জীভূত মূলধন ঘাটতি এখনো সহনীয় পর্যায়ে আছে, যা দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে পূরণ করা সম্ভব বলে ব্যাংকিং এক্সপার্টরা মনে করেন। অন্যদিকে বিকেবির ক্রমপুঞ্জীভূত মূলধন-ঘাটতি পূরণের সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ।

সপ্তমত, রাকাব অনলাইনের মাধ্যমে ঋণ শ্রেণিকরণ স্বচ্ছতার সঙ্গে সঠিকভাবে সম্পন্ন করে। বিকেবিতে শ্রেণিকৃত ঋণ গোপনের সুযোগ রয়েছে। সম্প্রতি বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদ থেকে জানা যায়, বিকেবি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা শ্রেণিকৃত ঋণ গোপন করেছে। পক্ষান্তরে রাকাবের কোনো লুক্কায়িত শ্রেণিকৃত ঋণ নেই।

শুধু একীভূত করে ডুবন্ত ব্যাংক খাত ভালো করা সম্ভব নয়।ঋণখেলাপি, দুর্নীতিবাজ ও অনিয়মে যুক্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। জোর করে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে খারাপ ব্যাংক একীভূত করলে ভালো ব্যাংকও খারাপ হয়ে যেতে পারে। এটা সংক্রামক ব্যাধির মতো পুরো ব্যাংক খাতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। একীভূত করতে হলে আন্তর্জাতিক রীতি মেনেই তা করা উচিত।

অষ্টমত, অদ্যাবধি রাকাবের অনলাইন ব্যাংকিং সিস্টেমে সাইবার আক্রমণে সফল হয়নি। অপরদিকে বিকেবির দুর্বল আইটি ব্যবস্থাপনার কারণে গত বছর ১২ দিন ধরে সাইবার হ্যাকার গ্রুপ অনায়াসে ব্যাংকের সংবেদনশীল আর্থিক রেকর্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নেয়। হ্যাকাররা সবগুলো সার্ভার এবং ডেটা এনক্রিপ্টেড করলেও ১২ দিন ধরে বিকেবি তা শনাক্ত করতে সক্ষম হয়নি।

নবমত, বিকেবি কর্তৃক ৩ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা শ্রেণিকৃত ঋণ গোপন করায় ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি ন্যূনপক্ষে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার কোটি টাকা হবে।কিন্তু রাকাবের কোনো প্রভিশন ঘাটতি নেই।

দশম, রাকাব দেশের একমাত্র ব্যাংক, যার প্রধান কার্যালয় রাজধানী ঢাকার বাইরে রাজশাহীতে অবস্থিত। ব্যাংকটির নামের শুরুতে ‘রাজশাহী’ শব্দটি সংযুক্ত থাকায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো রাকাবও রাজশাহীর ঐতিহ্যের একটি অংশ এবং বিষয়টি এতদাঞ্চলের মানুষের কাছে স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল। ব্যাংকটির সাথে আঞ্চলিকতা ও আবেগ সম্পৃক্ত। অন্য ব্যাংকের সঙ্গে এ ব্যাংকটি একীভূতকরণের সিদ্ধান্তে আমরা সচেতন ব্যবসায়ী মহলসহ এলাকাবাসী অত্যন্ত সংক্ষুব্ধ।

একাদশ, রাকাব-বিকেবি একীভূত হওয়ার ফলে রাজশাহীতে অবস্থিত রাকাবের প্রধান কার্যালয় বন্ধ হলে রাজশাহীতে কর্মরত ব্যাংকটির প্রায় ৩০০ জন কর্মকর্তার পদ শূন্য হবে। এতে রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকাসহ পুরো রাজশাহী অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

গবেষণা ও নীতিসহায়ক সংস্থা আইএনএফ'র নির্বাহী পরিচালক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কামাল মুজেরী পত্রিকান্তরে প্রকাশিত বিশেষ সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে 'ব্যাংক একীভূতকরণ' প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত হলে ব্যাংক খাতের দুর্বলতা দূর হবে, তা সঠিক নয়।

ব্যাংক দুর্বল হওয়ার পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। প্রধান একটি কারণ হলো, ব্যাংকে সুশাসনের অভাব। সুশাসন না থাকার কারণে মন্দ ঋণ বাড়তে বাড়তে এ রকম চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। সুশাসনের অভাব ও খেলাপি ঋণের কারণেই আমাদের ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়েছে।

সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বিডিবিএল এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক একীভূত হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে। একটা কথা বলা হচ্ছে, এসব ব্যাংকের মন্দ ঋণ একটা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়া হবে। এতে হয়তো কাগজে-কলমে দেখানো যাবে ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ কমে গেছে। কিন্তু ব্যাংকগুলোয় যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠা না করা যায়, তাহলে এ মন্দ ঋণের প্রবাহ চলতেই থাকবে। আমাদের ব্যাংকগুলোয় বছরের পর বছর ধরে মন্দ ঋণ পুঞ্জীভূত হয়েছে।

বলা যায়, এখানে মন্দ ঋণ যাদের আছে, তাদের বেশির ভাগই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। আমাদের ব্যাংক খাতের যে দুর্বলতা, সেখানে দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে সমস্যার সমাধান হবে না। সুশাসন প্রতিষ্ঠা না করে ব্যাংকগুলো একীভূত করলে আগামী দিনগুলোয় দেখা দেবে মন্দ ঋণ আবারও পুঞ্জীভূত রূপ নিয়েছে।

মন্দ ঋণ পুঞ্জীভূত হওয়ার কারণ হলো কিছু গোষ্ঠী তাদের স্বার্থে ব্যাংকগুলোকে ব্যবহার করছে। এই গোষ্ঠীস্বার্থের সংস্কৃতির মূলে আমরা যদি শক্তভাবে আঘাত করতে না পারি, তাহলে ব্যাংক একীভূতকরণ হোক, আর মন্দ ঋণ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির কাছে দিয়ে দেওয়া হোক না কেন, সমস্যার সমাধান হবে না। বরং ভবিষ্যতে সমস্যাটা আরও প্রকট হবে।

তিনি আরও বলেন, দুর্বল ব্যাংকগুলো যদি সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দেওয়া হয়, তারা নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। মন্দ ঋণ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়া হলে সেটা হবে আমাদের এমন আরেকটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগ, যেটাকে সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিয়েই চলতে হবে। ফলে সরকারের জন্য আরেকটি বোঝা সৃষ্টি হবে।

ব্যাংকের কাছে থাকুক আর অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির কাছে থাকুক, মন্দ ঋণ আমাদের আদায় করতে হবে। মন্দ ঋণ উদ্ধার করার প্রচেষ্টা যদি না থাকে, তাহলে যে সমাধানের কথা চিন্তা করি না কেন, সেটা প্রকৃত সমাধান হবে না।

পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদের এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তর থেকে জানা যায়, শুধু একীভূত করে ডুবন্ত ব্যাংক খাত ভালো করা সম্ভব নয়।

ঋণখেলাপি, দুর্নীতিবাজ ও অনিয়মে যুক্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। জোর করে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে খারাপ ব্যাংক একীভূত করলে ভালো ব্যাংকও খারাপ হয়ে যেতে পারে।এটা সংক্রামক ব্যাধির মতো পুরো ব্যাংক খাতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।একীভূত করতে হলে আন্তর্জাতিক রীতি মেনেই তা করা উচিত।

রাজশাহীতে অব্যাহত আন্দোলনের তৃতীয় দিনে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও রাজশাহী সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা এক বিবৃতিতে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক বিকেবি'র সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগের প্রতিবাদ জানিয়ে চলমান আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক গঠিত হয়েছিল রাজশাহীর তথা উত্তরাঞ্চলের কৃষি এবং কৃষকের উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রীয় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে।

বিকেবি এবং রাকাব এই দুই ব্যাংক একীভূত হলে উত্তরাঞ্চলের কৃষি এবং কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাতে কৃষি ভান্ডার বলে খ্যাত এ অঞ্চলের উন্নয়ন ব্যাহত হবে। তিনি বলেন, এই একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন ও সচেতন নাগরিকরা যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, তাকে আমি যুক্তিসঙ্গত আন্দোলন বলে মনে করি। অবিলম্বে তিনি সরকারি এ সিদ্ধান্ত বাতিল করে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলতে দেওয়ার আহ্বান জানান।

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম/ফারুক