ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

রাজনীতিতে প্রগতিশীলতা জরুরি কেন?

সাব্বির আহমেদ চৌধুরী | প্রকাশিত: ১০:০০ এএম, ২৫ আগস্ট ২০২৪

স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক পথ পরিক্রমা বিবেচনা করলে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের সংকট এবং তাদের ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে অনেক দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি ২০০৮ সালে নির্বাচনে ভরাডুবির মাধ্যমে যে সংকটের মধ্যে পড়েছিল গত ১৫ বছরে সে সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অনুরূপভাবে গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে আওয়ামী সরকার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রবীণতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সময় বলে দেবে তাদের এই সংকট ক্ষণস্থায়ী হবে নাকি দীর্ঘস্থায়ী হবে?

কেন রাজনৈতিক দলগুলো বারবার এই সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে? এর একটি প্রধান কারণ হচ্ছে দলগুলোর মধ্যে প্রগতিশীলতা তথা মুক্তচিন্তার তীব্র অভাব। দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা নেই বললেই চলে। দলগুলো মূলত গাণিতিক আরোহ পদ্ধতি অনুসরণ করে পরিচালিত হয়। দলের কেন্দ্র থেকে যে সিদ্ধান্ত হয় তা কর্মীদের মধ্যে সঞ্চালিত হয়। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলে মেনে নেয়, এতে তাদের বিবেক, বুদ্ধি বা ইচ্ছা শক্তির কোনো প্রকাশ থাকে না।

শুধু তাই নয়, এই স্রোতে গা ভাসাতে বুদ্ধিজীবী মহলেরও তৎপরতা লক্ষণীয়। তাহলে দলগুলোতে মেধাবী, স্বাধীনচেতা, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক কি নেই? এর উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ আছে। তাহলে তারা নীরব কেন? এই প্রগতিশীল অংশের থেরেশহোল্ড (Thershold) বা প্রান্তিক মান এত নিচে নেমে গেছে যে তাদের কথা বলার সুযোগ ক্রমান্বয়ে সীমিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদের ভিন্ন চিন্তা, আধুনিক মানসিকতার কারণে দলের অভ্যন্তরে তাদের সংস্কারপন্থি বা বিচ্ছিন্নতাবাদী কিংবা ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত করার মতো অপপ্রয়াসও লক্ষ্য করা গেছে।

প্রগতিশীল রাজনীতি সমাজের বিদ্যমান কাঠামো, আইন এবং প্রথা সম্পর্কে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে এবং পরিবর্তন বা সংস্কারের মাধ্যমে মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে প্রতিক্রিয়াশীলরা প্রগতিশীলদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা ঠেকিয়ে দেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দিনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে। এর পেছনে ছিল মূলত প্রতিক্রিয়াশীলদের স্বার্থান্বেষী চেষ্টা।

ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ মতানৈক্য কেন্দ্র করে ১৯৭২ সালের সম্মেলনে দ্বিখণ্ডিত হয় ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের রেডিক্যাল অংশ বেছে নেয় নতুন পথ, জন্ম হয় জাসদ ছাত্রলীগের। রাজনীতিতে প্রতিক্রিয়াশীলতা স্থায়ী রূপ ধারণ করে ১৯৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচন ভণ্ডুল করার মাধ্যমে। ভিন্নমত এবং ভিন্ন পথের জয় সহ্য করতে না পেরে প্রতিক্রিয়াশীলরা অগণতান্ত্রিক পন্থা বেছে নেয়, বঞ্চিত করা হয় প্রগতিশীল ছাত্রনেতা আফম মাহবুবুল হককে ডাকসু ভিপি হওয়া থেকে।

শাসক গোষ্ঠীর কাছে প্রগতিশীল রাজনীতি সব সময় ছিল একটা আতঙ্কের বিষয়। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি তিন তরুণ নেতা মেনন, রনো আর কাজী জাফর এর ইউপিপির ওপর লোলুপ দৃষ্টি পড়েছিল প্রতিক্রিয়াশীলদের, তাই অল্পতেই থেমে গিয়েছিল এই তিন তরুণ প্রগতিশীল নেতার একসাথে পথচলা। শাসকগোষ্ঠী কখনোই চায়নি এই তিন তরুণ নেতার রাজপথের রাজনীতি একসাথে চলুক কারণ তাতে প্রতিক্রিয়াশীলতা লোপ পাবে।

২০০০ পরবর্তী সময়ে বিএনপিতে বি চৌধুরী, অলি আহমদ কিংবা কে এম ওবায়েদ বারবার প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা চেতনার কাছে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং এক সময় তাদের থেমে যেতে হয়েছিল। বি চৌধুরী আর অলি আহমদের ঠিকানা হয়েছিল নতুন দল, মৃত্যুই হয়তো কেএম ওবায়েদকে মুক্তি দিয়েছিল। অনুরূপভাবে আওয়ামী রাজনীতিতে অনেকটাই অপাংক্তেয় হয়ে পড়েছিলেন তোফায়েল, রাজ্জাক আর সুরঞ্জিত সেন এর মতো বর্ষীয়ান নেতৃবর্গ। এভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পন্থায় ভিন্নমত, মুক্তচিন্তা কিংবা দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনাকে রুদ্ধ করা হয়েছে।

মুক্ত চিন্তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অভাব হিসেবে সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের কথা বলা যেতে পারে উদাহরণ হিসেবে। মধ্য জুলাইয়ে যখন ছাত্র আন্দোলন শুরু হয় তখন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরের প্রগতিশীল অংশকে এই আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং সহমর্মী হতে দেখা যায়। কিন্তু ক্ষমতার আশেপাশে থাকা রাজনৈতিক নেতা এবং প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবী মহলের মধ্যে আন্দোলন উড়িয়ে দেওয়ার মানসিকতা ধারণ করতে দেখা যায়। আন্দোলনের এক পর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার লাল করার মাধ্যমে লাল বিপ্লবের ঘোষণার দেয় তখন, সরকার ঘনিষ্ঠ অংশকে এই আন্দোলনের প্রতি বিদ্রুপ পোষণ করতে দেখা যায়।

এহেন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও দেখা যায় আওয়ামী লীগ সমর্থন করে বা ভালোবাসে এমন অনেক প্রগতিশীল লোক ফেসবুক প্রোফাইলের লাল বিপ্লবের শামিল হয়। চাটুকারবেষ্টিত থাকায় এবং সুস্থ চিন্তার সুযোগ না থাকায় দলের মূল অংশ থেকে এদের ভালো চোখে দেখা হয়নি- এটাই স্বাভাবিক। ফলে গণদাবি অনুধাবন করতে সরকার অনেকাংশে ব্যর্থ হয়।

এভাবে দলের প্রগতিশীল অংশকে দীর্ঘদিন ধরে দমিয়ে রাখা এবং তাদের চিন্তা চেতনা ও তাত্ত্বিক ধারণা অবমূল্যায়নের মাধ্যমে বস্তুত বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা এবং প্রগতিশীলতা বারবার অস্বীকার করা হয়েছে। বিভিন্ন দলের অভ্যন্তরে সুস্থ রাজনৈতিক চিন্তাসম্পন্ন প্রগতিশীল ব্যক্তিদের অবস্থা এতই নাজুক যে অনেক সময় দেখা যায় তাদের সংস্কারপন্থি বা বিচ্ছিন্নতাবাদী বা ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে দলের অভ্যন্তরে অভিহিত করা হয়।

দলের অভ্যন্তরে নীরব থাকা অথবা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে থাকা ছাড়া তাদের অন্য কোনো ভবিষ্যৎ বাস্তবিক অর্থে কখনোই সেভাবে থাকে না। ফলে উভয় দলের নেতৃত্ব যখন ২০০৬ এবং ২০২৪ এর সংকটকালীন সময়ে বাথশেবা সিনড্রোমে (Bathsheba Syndrome) ভুগছিল তখন দলসংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবী মহল তাদের সতর্ক করতে পারেনি বরং রাজনৈতিক নেতৃত্বের জোয়ারে শামিল হয়েছে। বাথশেবা সিনড্রোম হলো এমন একটি ধারণা, যা নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নৈতিক ব্যর্থতা বা বিপথগামিতা নির্দেশ করে। এ ধারণাটি বাইবেলের বাথশেবার গল্প থেকে এসেছে, যেখানে রাজা ডেভিড তার শক্তিশালী অবস্থানে থেকে অন্যায়ভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন।

মূলত, বাথশেবা সিনড্রোম নির্দেশ করে যে, যখন কোনো নেতা বা ক্ষমতাশালী ব্যক্তি খুবই সফলতা অর্জন করে এবং নিজেদের উচ্চ অবস্থানে পায়, তখন তারা প্রায়ই নিজেদের নৈতিকতা বা নৈতিক মানদণ্ড থেকে বিচ্যুত হতে পারে। বাথশেবা সিনড্রোমের শিক্ষাটি হলো যে, নেতাদের সবসময় তাদের নৈতিকতা, সততা এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা গুরুত্ব দিতে হবে, তা না হলে তাদের সিদ্ধান্তগুলো শেষ পর্যন্ত সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে।

সার্বিকভাবে, প্রগতিশীলতা রাজনীতিতে নতুন ধারণা, উদ্ভাবন এবং সংস্কারের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়, যা সমাজকে উন্নত, ন্যায়পরায়ণ এবং সমতাভিত্তিক করতে সহায়ক। প্রগতিশীল রাজনীতি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এটি ব্যক্তি স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সমাজের সব অংশের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে।

অতীতের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনে জনগণের সামাজিক এবং রাজনৈতিক মনোভাব বোঝার জন্য এবং দলকে সুপথে পরিচালিত করার জন্য রাজনৈতিক দলসমূহের অভ্যন্তরে গবেষণা সেল গঠনের মাধ্যমে তাত্ত্বিক অংশকে কাজে লাগাতে হবে। দলসমূহকে এটা বুঝতে হবে প্রগতিশীলতা কোনো ষড়যন্ত্র নয় বরং এটা দলকে শুদ্ধ পথে পরিচালিত করার একটি শক্তিশালী নিয়ামক। প্রতিক্রিয়াশীলতা দূর করে রাজনীতির মঞ্চে উদারনৈতিক মানসিকতার সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে। মূল ধারার রাজনৈতিক দলসমূহ চাটুকারমুক্ত হয়ে প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার দিকে যতই ধাবিত হবে বাংলাদেশের উন্নয়ন তত দ্রুত নিশ্চিত হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

এইচআর/এমএস/ফারুক