ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সাবিরা, আত্মহত্যা করলে কেন তুমি?

প্রকাশিত: ০৩:৫৪ এএম, ২৯ মে ২০১৬

মনে হতে পারে, সাবিরাকে কেন লিখছি? সাবিরাতো নেই। সাবিরা চলে গেছে, ফিরবে না কোনোদিন। সাবিরাকে লেখা চিঠি শুধু সাবিরার জন্য নয়, সাবিরাদের জন্য। সাবিরা আমার কাছে একটি প্রতিকী চরিত্র। চরিত্রটি অপমানের, অসম্মানের, লাঞ্ছনার, নির্যাতনের, নিপীড়নের, যৌন হয়রানির, প্রাত্যহিক ধর্ষণের- নিগ্রহের শিকার।

সাবিরা একা নয়, এমন সাবিরা আছেন অনেক। সাবিরা না পড়ুক, সাবিরারা তো পড়বে। একজন সাবিরাও যদি পড়ে, বোঝে, বোধ হয়, আত্মহত্যা থেকে, মৃত্যুর হামুখ গহ্বর থেকে ফেরে- সেটাই বা কম কী!
 
জীবনে, জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। জগতে যা কিছু মহৎ, যা কিছু মহান, যা কিছু সুন্দর, যা কিছু আকর্ষণীয়, যা কিছু আরাধ্য, যা কিছু আহ্লাদের, যা কিছু আপন, যা কিছু নিজের, যা কিছু বড় শখের, সুখের- তা এই অমূল্য জীবনখানি। জীবনের জন্যই সব। জগৎ জীবনের জন্যই। জীবন আছে সব আছে, জীবন নেই কিছু নেই।

অনেক চেষ্টা করেও সাবিরার সুইসাইড নোট ও ভিডিও পুরোপুরি দেখতে পারিনি। কোনো সুস্থ্য, স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এই ভয়ংকর মৃত্যুর মহড়াটি দেখা সম্ভব নয়। দেখতে গিয়ে বারবার শিউরে উঠেছি। অথচ অনেকে বারবার দেখছে, শেয়ার দিচ্ছে, কমেন্টস দিচ্ছে, লাইকও দিচ্ছে কেউ কেউ। ভাবা যায় কী ভয়ংকর বিকৃতি পেয়ে বসেছে আমাদের। যেকোনো মৃত্যুই মৃত্যু। একটা মানুষের জীবন আর কোনোদিন ফিরবে না। কোনোদিন আর তার ফেরা হবে না এই পৃথিবীতে। অথচ তার জীবন নিয়ে, মৃত্যু নিয়ে যেকোনো মন্তব্য করছি- অমূলক। আমাদের কারও জীবনের চেয়ে সাবিরার জীবনটিতো কম মূল্যবান নয়। জীবন তো জীবনই। মহান স্রষ্টা বড় ভালোবেসে সৃষ্টি করেছেন আমাদের সকলকেই।

নির্বোধ মেয়ে- কেন এভাবে মরতে গেলে তুমি? কী লাভ এভাবে মরে গিয়ে? মরে গিয়ে কী প্রমাণ করতে চাও? প্রতিশোধ, সে কার উপর? অমানুষদের কি এমন প্রতিশোধে কিছু যায় আসে। জীবনে যেকোনো কিছু প্রমাণ করতে, প্রতিশোধ নিতেও বেঁচে থাকতে হয়। সাবিরা, মরে গিয়ে তুমি হেরে গেছো। নিজেকে অক্ষম, অসমর্থ, দুর্বল প্রমাণ করেছ। যুদ্ধে দুর্বলরাই হেরে যায়, মৃত্যুবরণ করে। জীবনের যেকোনো যুদ্ধেও তাই। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রতিটি মেয়ে যুদ্ধ করেই বাঁচে। মরতে মরতে বেঁচে যায়, হারতে হারতে জিতে যায়। সাবিরা, তুমি সব মেয়েদের অসম্মান করেছ, অপমান করেছ।

প্রেমিক অপমান করেছে, অগ্রাহ্য করেছে, উপেক্ষা করেছে- সুতরাং বেঁচে থেকে আর লাভ নেই- এ চিন্তা বড় ভুল চিন্তা। জীবন কোনো প্রেমিকের জন্য নয়, নিজের জন্য আগে। একেওকেতাকে ভালো না বেসে ভালোবাসতে হয়, আগে নিজেকে। নিজেকে সম্মান করতে হয়। জীবন থাকলে প্রেম আসবে, প্রেমিক আসবে, প্রেমিকা আসবে। জীবন তো একটা বহতা নদীর মতো। নদীর নানান বাঁক, জীবনেরও তাই। একটি প্রেমই কেবল জীবনে আসবে, একজন মানুষই কেবল আমাকে ভালোবাসবে এক জীবনে- এ বড় ভুল, মিথ্যা, বাতিল চিন্তা। প্রবহমান জীবনে প্রেম বারবার আসে, আসবেই- এটাই জীবন মানুষের।

প্রেম বলতে কি বুঝেছ তুমি, জানি না আমি। আমাদের মেয়েরা হুটহাট প্রেমে পড়ে। প্রতারক, প্রবঞ্চক, শঠ, লম্পট- সবাইকে নির্দ্বিধায় প্রেমিক বলে সম্বোধন করে। বয়ফ্রেন্ড থাকাটা, গার্লফ্রেন্ড থাকাটা রীতিমতো ‘পার্ট অব ফ্যাশন’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি প্রেমবিরোধি নই, বরাবরই প্রেমিক আমি। প্রেম করো, ভালোবাসো, উজাড় করে দাও নিজেকে। আপত্তি নেই, কিন্তু কার জন্য দিচ্ছ? কেন দিচ্ছ উজাড় করে সবটুকু- সেটাও বুঝতে হবে, জানতে হবে। বুঝতে হবে মানুষ, মানুষ চিনতে হবে। ছুতে পারো  তাতেও আপত্তি নেই। কিন্তু ছোবার আগে বুঝতে হবে, দায়িত্ব নিতে হবে নিজেকেই। সম্পর্কের দায় আসলে সবার আগে নিজেরই। একটি সম্পর্কের মধ্য দিয়ে আমি কী চাই, কী চাই না, কতদূর যাব, যাব না কতদূর- সে সিদ্ধান্ত আগে আমার নিজের। আমি কী অতটা অনুভূতিহীন, বোধহীন যে সম্পর্কের গতিবিধি বুঝব না, যদি না বুঝি তবে এই দায়তো আমারই।

কে বলেছে নারীর জীবন শুধু পুরুষের জন্য? কারও জন্য নয়, নিজের জীবন আগে নিজের জন্য। যেকোনো পুরুষের সঙ্গে ঘর না করলে, বিয়ে না হলে, সন্তান না হলে জীবন অসার। বড় অর্থহীন চিন্তা। মূর্খচিন্তা। বিজ্ঞানহীন চিন্তা। এই চিন্তায় আধুনিকতা নেই, অগ্রসরতা নেই, পশ্চাৎপদতা আছে। নাটক, সিনেমা, মডেলিং করলেই, টপস-টিশার্ট আর স্লিভলেস পরলেই মেয়েরা আধুনিক হবে, প্রগতিশীল হবে ধারণাটি ভুল। আধুনিকতা থাকে চিন্তায়, মস্তিষ্কে, মগজে বিজ্ঞানমনস্কতায়। নাটক সিনেমায় আসা ভূরিভূরি মেয়েরা আটোসাটো পোশাক পরছে, খোলামেলা পোশাক পরছে কিন্তু চিন্তার জায়গাটি যারপরনাই অনাধুনিক, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, পুরুষতান্ত্রিক। দুঃখজনক হলেও সত্য সাবিরা, তুমি তাদেরই একজন।

ভয়ংকর এই পুঁজি আর প্রতারণার দুনিয়ায়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েরা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হয়, নিগ্রহের শিকার হয়, প্রতারিত হয় প্রতিদিন কোনো না কোনো মেয়ে, কোনো না কোনোভাবে ঘরের বাইরে। তবু তারা নিজেকে শেষ করে দেয় না। বাঁচতে হয়, বাঁচাতে হয় নিজেকে নিজেই। কে যেন বলেছিল, ‘কে আছে আমি ছাড়া আমাকে বাঁচায়’। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, বেঁচে থাকা প্রতিটি মেয়েই তা-ই। নিজেকে শেষ করে দিলে লাভ অন্যের, ক্ষতি নিজেরই। যায় শুধু নিজের জীবনটি, থাকে অন্যেরা সবাই।

সাবিরারা যেন বুঝতে শেখে, বাঁচতে শেখে, ভালোবাসতে শেখে, সম্মান করতে শেখে নিজেদের। নিজের জীবনটি যেন পুরুষের জন্য না ভেবে, নিজের জন্য ভাবতে শেখে। বুঝতে শেখে, নিজের জীবনটি শেষাবধি নিজেরই!

পুনশ্চঃ অনলাইন নিউজ পোর্টাল বলতে ইদানিং দেশে বেশ আবর্জনার স্তূপ জমেছে। যাদের ন্যূনতম সাংবাদিকতার নৈতিকতাটিও নেই। শুধু ভিজিটর আর হিট বাড়াবার জন্য যারা যাচ্ছেতাই আপ করে। একটিবারের জন্যও যারা অন্যের সামাজিক সম্মান, নৈতিকতা, সামাজিকতার বিষয়গুলো ভাবে না। সাবিরার মৃত্যু, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনলাইনেগুলোতে যা হচ্ছে, ভাইরাল আকারে ছড়াচ্ছে তা স্রেফ বিকৃতি ভিন্ন আর কিছু নয়। কোথায় এখন ৫৭ ধারা, কোথায় আইসিটি এ্যাক্ট? নাকি সাবিরারা নিগৃহীত হলে কারও কোনো যায় আসে না।

কেননা, সাবিরারা তো অসহায়, ক্ষমতাহীন!

লেখক : উপ-সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম এন্ড কমিউনিকেশন। সম্পাদক, সাপ্তাহিক কাগজ ও মিডিয়াওয়াচ।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন