ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বইমেলা হোক সারাদেশে বছরজুড়েই

মাহফুজা অনন্যা | প্রকাশিত: ০৯:৫৯ এএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বইমেলা—এই শব্দটি উচ্চারণ করলেই আমাদের হৃদয়ে জেগে ওঠে এক গর্ব, এক ভালোবাসা, এক অমোঘ আবেগ। এটি শুধু একটি বই বিক্রির বিষয় নয়; এটি আমাদের ভাষা ও আত্মত্যাগের স্মারক, আমাদের সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র, বাঙালির মননের মন্দির। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে যে উৎসব শুরু হয়, তা হয়ে ওঠে এক মাসব্যাপী জাতীয় মহোৎসব।

কিন্তু এবারের বাস্তবতা ভিন্ন। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনায় বইমেলার অনিশ্চয়তা ঘনীভূত হয়েছে। বইমেলা আদৌ হবে তো, কবে হবে? হবে কি ফেব্রুয়ারিতেই?—এই প্রশ্নগুলো ঘুরছে প্রকাশক, লেখক, পাঠক ও সাহিত্যপ্রেমীদের মনে। এই ধোঁয়াশা যেন এক অচেনা অস্থিরতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।

বইমেলা মানেই একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষার মাস। এই মাসেই বইমেলার প্রতিটি পদচারণায় থাকে শহিদ মিনারের স্মৃতি, ভাষার জন্য রক্তদানের অহংকার, নতুন প্রজন্মের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রতিফলন। তাই ফেব্রুয়ারির বাইরের কোনো সময়ে বইমেলা আয়োজন করলে সেটি কেবল একটি "বইয়ের মেলা" হয়ে থাকবে—হারাবে তার ঐতিহ্য, হারাবে "অমর একুশে"র চেতনা।

তবে বাস্তবতা যদি চাপিয়ে দেয় অন্য সময়ের বাধ্যবাধকতা, তাহলে প্রশ্ন জাগে—আমরা কি মেলাটিকে বাতিল করব? নিশ্চয়ই না।

বরং যেভাবেই হোক, প্রাণের মেলাকে বাঁচাতে হবে। আর এর জন্য করতে হবে বিকল্প চিন্তা, দৃঢ় সিদ্ধান্ত। বইমেলা স্থগিত করা নয়, বরং পরিকল্পিত রূপে রক্ষা করা এখন সবচেয়ে জরুরি। প্রয়োজনে ফেব্রুয়ারির শেষে বা নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বা আংশিকভাবে—যেভাবেই হোক, আয়োজন করতে হবে। মেলা সংক্ষিপ্ত হতে পারে, কিন্তু বাতিল হওয়া চলবে না। কারণ একবার মেলার ধারা ভেঙে গেলে, সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। প্রকাশনা শিল্প, পাঠাভ্যাস, লেখকের মনোবল—সবকিছুই এই মেলার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। একটি বছরের ছেদ মানে অনেক স্বপ্নের মৃত্যু।

সংস্কৃতি কেবল প্রশাসনিক সময়সূচি দিয়ে নির্ধারিত হয় না। সংস্কৃতি জীবনের নিজস্ব ছন্দে প্রবাহিত হয়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব, সেই ছন্দকে রক্ষা করা। তাই নির্বাচন, আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসনিক জটিলতার মধ্যে থেকেও একুশের মেলা টিকিয়ে রাখতে হবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে, নীতি-নির্ধারণী স্পষ্টতায়, এবং সংস্কৃতিপ্রেমী সমাজের ঐক্যে।

অমর একুশে বইমেলা হারিয়ে গেলে হারাবে আমাদের চেতনার উৎস। যে মেলা আমাদের শেখায় চিন্তা করতে, ভালোবাসতে, ভাষাকে সম্মান করতে, ইতিহাসকে ধারণ করতে—সে মেলা যদি থেমে যায়, আমরা থেমে যাব ভিতরে ভিতরে। তাই আহ্বান—যেভাবেই হোক, যত বাধাই আসুক, প্রাণের মেলা যেন হারিয়ে না যায়। এই মেলা আমাদের আত্মার উৎসব। এই মেলা বাঁচলে, বাঁচবে আমাদের মনন, বাঁচবে ভাষা, বাঁচবে বাংলাদেশ।

প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির বাতাসে যখন ঢাকায় বইমেলার হাওয়া লাগে, তখন দেশের নানা প্রান্তের বইপ্রেমী মানুষ হাহাকার করে ওঠেন—আমাদের শহরে নেই কেন এমন বইমেলা?

অমর একুশে বইমেলা নিঃসন্দেহে আমাদের জাতীয় গর্ব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই গর্ব কি শুধু রাজধানী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে? আমাদের ভাষা আন্দোলন কি শুধু ঢাকাবাসীর ছিল? আমাদের সংস্কৃতি কি শুধু শহুরে অভিজাত পরিসরের জন্য? ঢাকা কেন্দ্রিক সংস্কৃতিঃ এক অসম ভারসাম্য, এর থেকে দেশের মানুষ মুক্তি চায়।

আজও বইমেলা মানেই ঢাকাকেন্দ্রিক আয়োজন। প্রকাশকরা, লেখকরা, পাঠকরাও একমুখীভাবে রাজধানীর দিকে ছুটে আসেন। কিন্তু ভাবতে হবে—বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার কোটি কোটি মানুষ, যারা বই ভালোবাসে, পড়তে চায়, সন্তানদের পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে চায়—তারা কি কেবল টেলিভিশনে খবর দেখে তৃপ্ত থাকবে?

ঢাকায় মাসব্যাপী বইমেলা হলেও জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কোনো বৃহৎ পরিসরের সরকারি বইমেলা হয় না। মাঝে মাঝে কিছু বেসরকারি সংস্থা বা স্থানীয় প্রশাসন উদ্যোগ নেয়, কিন্তু তা হয় অল্প পরিসরে, অল্প সময়ের জন্য। তাই সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীকরণ সময়ের দাবি। যেমন আমরা উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলি—তেমনি সংস্কৃতির ক্ষেত্র বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। প্রতিটি জেলা শহরে মাসব্যাপী বা অন্তত দুই সপ্তাহের বইমেলা আয়োজন করা যায়। উপজেলা পর্যায়েও সপ্তাহব্যাপী বা দশদিনের বইমেলা হতে পারে। স্থানীয় লেখকদের বই প্রকাশ, পাঠাগারের কার্যক্রম, শিশুদের জন্য বইপড়া প্রতিযোগিতা, সাহিত্য আড্ডা—এসব মিলিয়ে সারাদেশে একটি প্রাণবন্ত পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব। এতে পাঠাভ্যাস বাড়বে, স্থানীয় লেখকদের পরিচিতি বাড়বে, আর সংস্কৃতি হবে সবার অংশগ্রহণমূলক।

বাংলা একাডেমি জাতীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারণ ও সমন্বয়ের দায়িত্ব নিতে পারে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অর্থ ও প্রশাসনিক সহায়তা নিশ্চিত করতে পারে।

জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন স্থানীয় পর্যায়ে আয়োজন, জায়গা নির্ধারণ, নিরাপত্তা ও প্রচার ব্যবস্থার দায়িত্ব নিতে পারে। প্রকাশনা শিল্প ও স্থানীয় লেখক সমাজ সক্রিয় অংশগ্রহণ ও স্টল ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করতে পারে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করতে পারে।

সর্বোপরি বইমেলা হতে হবে জনগণের উৎসব। যদি জেলা-উপজেলা পর্যায়ে নিয়মিত বইমেলা হয়, তাহলে বইমেলা হবে না কেবল একুশের ইভেন্ট, বরং সারা বছরের সংস্কৃতি উৎসব। বই তখন পৌঁছে যাবে গ্রামে-গঞ্জে, ছোট শহরে। বইয়ের গন্ধ ছড়িয়ে পড়বে মাঠে-ঘাটে। ভাষার মাসের চেতনা তখন সত্যিই পূর্ণতা পাবে—যখন বইমেলা হবে শুধু ঢাকায় নয়, পুরো বাংলাদেশে।

বাংলার সাংস্কৃতিক হৃদস্পন্দন "অমর একুশে বইমেলা"—শুধু একটি মেলা নয়, এটি আমাদের জাতিসত্তার প্রতীক, আমাদের ভাষার প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ, আমাদের বৌদ্ধিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির বাতাসে বইয়ের গন্ধ, পাঠকের ভিড়, নতুন লেখকের স্বপ্ন, কবির স্বর, আর প্রকাশকের ব্যস্ততায় মুখর থাকে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। কিন্তু এবারের বাস্তবতা অন্যরকম। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় বইমেলা ঘিরে দেখা দিয়েছে এক ধোঁয়াশা, এক অনিশ্চয়তা।

এ যেন এক গভীর প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে আমাদের সংস্কৃতিচর্চার ধারাবাহিকতাকে। যে মাসটি ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবাহী, যে মাসে বাঙালি তার আত্মপরিচয় নতুন করে খুঁজে নেয়, সেই মাসেই যদি বইমেলা না হয়—তবে কি হারাবে তার ঐতিহ্যিক তাৎপর্য?

অন্যদিকে, নির্বাচন একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, গণতন্ত্রের চর্চার অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু তার ছায়ায় যদি সাংস্কৃতিক উৎসব বাধাগ্রস্ত হয়, তবে সেটি নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। বইমেলা কেবল একটি অনুষ্ঠান নয়, এটি কয়েক লক্ষ মানুষের সঙ্গে জড়িত—প্রকাশক, লেখক, পাঠক, বই বিক্রেতা, প্রচ্ছদ-শিল্পী, ডিজাইনার এবং পাঠপ্রেমী তরুণ প্রজন্ম। বছরের পর বছর তারা এই মেলার জন্য অপেক্ষা করে। অনেকে সারা বছর ধরে বই প্রকাশের প্রস্তুতি নেয় এই একুশকেই সামনে রেখে।

যদি ফেব্রুয়ারির মেলা পিছিয়ে অন্য মাসে নিতে হয়, তাহলে প্রশ্ন জাগে—একুশের বইমেলা কি ফেব্রুয়ারি ছাড়া অন্য মাসে নিজের অর্থ হারাবে না? ‘একুশে বইমেলা’ কি ‘বইমেলা’ হয়ে যাবে শুধুই?

এখন সবচেয়ে প্রয়োজন একটি স্বচ্ছ সিদ্ধান্ত ও খোলামেলা সংলাপ। বাংলা একাডেমি, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, প্রকাশক সমিতি এবং সাহিত্যপ্রেমীদের নিয়ে বসা উচিত একটি সম্মিলিত আলোচনায়। হয়তো ফেব্রুয়ারির শুরুতে আংশিক মেলা, অথবা নির্বাচন-পরবর্তী ফেব্রুয়ারির শেষভাগে সংক্ষিপ্ত আয়োজন—বিকল্প ভাবা যেতে পারে। কিন্তু যা-ই হোক, সিদ্ধান্তটি হতে হবে সময়োপযোগী এবং সংস্কৃতি-বান্ধব।

এই অনিশ্চয়তা শুধু প্রকাশকদের আর্থিক ক্ষতির কারণ নয়, এটি আমাদের মননের ক্ষয় ঘটায়। কারণ বইমেলা মানে হলো চিন্তার মুক্ত প্রকাশ, ভাষার সম্মান, আত্মপরিচয়ের উজ্জ্বল ঘোষণা। যদি এই ঐতিহ্য কোনো প্রশাসনিক জটিলতার কাছে পরাজিত হয়, তবে তা হবে এক দুঃখজনক দৃষ্টান্ত।

অমর একুশে বইমেলা আমাদের সংস্কৃতির প্রাণ। ভোট আসবে, যাবে; সরকার বদলাবে, নীতি বদলাবে—কিন্তু ভাষার মর্যাদা ও সাংস্কৃতিক চেতনা অমর। তাই প্রয়োজন এক দৃঢ় সিদ্ধান্ত—যাতে নির্বাচন ও সংস্কৃতি একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং সহযাত্রী হয়। একুশের চেতনা যেন প্রশাসনিক টালবাহানার ভিড়ে হারিয়ে না যায়—এই প্রত্যাশাই করি আমরা সবাই।

লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন