ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

অবাধ-সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই প্রত্যাশা

আহসান হাবিব বরুন | প্রকাশিত: ০৮:৪২ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনটি একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একই সঙ্গে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ–২০২৫-এর ওপর গণভোট হিসেবেও বিবেচিত হওয়ায় এই দিনটি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে উঠছে। এমন দুটি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে রাজনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রত্যাশাও আরও স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। এই নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরি করেছে।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুরু থেকেই ঘোষণা দিয়ে আসছেন যে, আসন্ন নির্বাচন হবে আন্তর্জাতিক মানের, অবাধ ও ঐতিহাসিক। রাজনৈতিক অস্থিরতার পর তার এই অঙ্গীকার জনগণের মধ্যে আশাবাদ সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় সম্পৃক্ততা, প্রশাসনের পেশাদারিত্ব এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার কার্যকারিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সামগ্রিকভাবে নির্বাচনকে ঘিরে যে আলোচনাগুলো হচ্ছে, তা একটি সচেতন ও সক্রিয় গণতান্ত্রিক পরিবেশেরই প্রতিফলন।

এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের পাঁচজন প্রভাবশালী সদস্যের পাঠানো চিঠি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের বিষয়টিকে আরও দৃশ্যমান করেছে। হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির র‌্যাংকিং মেম্বার গ্রেগরি ডব্লিউ মিকস এবং সাবকমিটি চেয়ারম্যান বিল হুইজেঙ্গারের নেতৃত্বে পাঠানো ওই চিঠিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অংশীদাররা যে গণতান্ত্রিক চর্চার বিস্তৃত পরিসর ও প্রক্রিয়াগত স্বচ্ছতাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে, এই বার্তা সেই দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রতিফলিত করে।

এদিকে দীর্ঘ সময় প্রবাসে থাকার পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফিরে শান্তি ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সংবর্ধনা মঞ্চে তার বক্তব্যে যে অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতি গঠনের আহ্বান উঠে এসেছে, তা রাজনৈতিক সংলাপ ও সহনশীলতার গুরুত্বকেই সামনে নিয়ে এসেছে। এই বক্তব্য দেশের রাজনীতিতে নতুন ধরনের ইতিবাচক মেরুকরণ ও অংশগ্রহণমূলক ধারার সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়।

নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা, যাচাই-বাছাই, আপিল, প্রার্থিতা প্রত্যাহার এবং প্রতীক বরাদ্দ—সব ধাপই নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী এগিয়ে চলছে। ২২ জানুয়ারি থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়ে ভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে শেষ হবে এবং ১২ ফেব্রুয়ারি ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এই ধারাবাহিকতা নির্বাচনী প্রস্তুতির প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও পরিকল্পনার প্রতিফলন বলে বিবেচিত হতে পারে।

এবারের নির্বাচনে প্রবাসী ভোটারদের অংশগ্রহণও একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। পোস্টাল ভোটে নিবন্ধিত ৬ লাখ ৭২ হাজার ভোটারের মধ্যে প্রায় পৌনে দুই লাখ ভোটার ব্যালট পেয়েছেন। এটি ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত ও প্রযুক্তিনির্ভর প্রবাসী ভোটিং ব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করতে পারে।

নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর এক লক্ষ সদস্য মোতায়েনের ঘোষণা সরকারের প্রস্তুতি ও দৃঢ়তার প্রতিফলন। এর পাশাপাশি প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেশাদার আচরণ এবং নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন ভূমিকা একসঙ্গে মিলেই একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।

‘ভোটের গাড়ি’ সুপার ক্যারাভান কর্মসূচির উদ্বোধনে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য নির্বাচনের নৈতিক ভিত্তিকে আরও স্পষ্ট করেছে। তিনি ভোটারদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, দেশের মালিক জনগণ এবং আগামী পাঁচ বছর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব কার হাতে যাবে, তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা তাদের হাতেই। তরুণ, নারী ও প্রথমবারের ভোটারদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর তার বিশেষ গুরুত্ব একটি প্রাণবন্ত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ইঙ্গিত বহন করে।

ভয়হীন ও মুক্ত পরিবেশে ভোটাধিকার প্রয়োগের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ভোটাধিকার কোনো দয়া নয়; এটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। এই বার্তা জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ও আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।

নির্বাচন প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতার মাত্রা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোকে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনই প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট ডাল বলেছেন, “A democratic process requires effective participation and enlightened understanding।” অর্থাৎ কার্যকর অংশগ্রহণ ছাড়া গণতন্ত্র পূর্ণতা পায় না।

একইভাবে ল্যারি ডায়মন্ড উল্লেখ করেছেন, “Elections without genuine competition are rituals, not democracy।” প্রকৃত প্রতিযোগিতাই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণ করে। স্যামুয়েল হান্টিংটনের মতে, গণতন্ত্রের শক্তি নিহিত রয়েছে রাজনৈতিক সংঘাতকে শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবস্থাপনার সক্ষমতার মধ্যে। এই তাত্ত্বিক আলোচনাগুলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।

নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা কেবল রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; এর প্রত্যক্ষ প্রভাব অর্থনীতিতেও পড়ে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি বিশ্বাসযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন সেই স্থিতিশীলতার ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে।

১২ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। নির্ধারিত সময়সীমার ধারাবাহিকতায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া একটি ইতিবাচক দিক। এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সহনশীলতা ও সংলাপের চর্চা। অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশ শুধু একটি নির্বাচনই সম্পন্ন করবে না, বরং একটি নতুন গণতান্ত্রিক অধ্যায়ের সূচনাও করতে পারবে।

শেষ কথা, এই নির্বাচন কেবল একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়া নয়; এটি জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর একটি সুযোগ। অংশগ্রহণ, প্রতিযোগিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার সমন্বয়ই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রা কোন পথে এগোবে। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সেই পরীক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হয়ে থাকবে।

লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ঢাকা।
[email protected]

এইচআর/এমএস