অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা
বাঙালির যে কয়টি উৎসব আছে তার মধ্যে পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ একটি সার্বজনীন অনুষ্ঠান। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ এই উৎসবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। গ্রামগঞ্জ তো বটেই নাগরিক জীবনেও জায়গা করে নিয়েছে এই উৎসব। রমনার বটমূলে ছায়ানটের সুরে সঙ্গীতে বর্ষবরণের আয়োজন, চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবাই এক কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ বলে নববর্ষকে স্বাগত জানায়।
রঙবেরঙের পোশাকে সজ্জিত হয়ে সকল বয়সী মানুষজন অংশ নেয় এই উৎসবে। বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলা। চলে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার আয়োজন। সবমিলিয়ে এক অনাবিল আনন্দ উৎসবে মাতে এদিন সমগ্র বাঙালি জাতি। বৈশাখে এখন কেনাকাটার ধুমও পড়ে যায়। সরকার বৈশাখীভাতাও চালু করেছে উৎসবের গুরুত্ব বিবেচনায়। এটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে উৎসবে। এছাড়া বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায়। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের।
বিশ্বের অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও নাগরিক জীবনের এবং সরকারি কর্মকাণ্ডের সবকিছু চলে ইংরেজি ক্যালেন্ডার হিসেবে। তারপরও বাঙালির গভীর মানসে বাংলা নববর্ষের স্থান অনেক উঁচুতে। বাঙালির মনপ্রাণজুড়ে রয়েছে বাংলা নববর্ষ। এদেশের কৃষক-শ্রমিক, জেলে-তাঁতী, কামার-কুমোরসহ নানা পেশার মানুষ যুগ যুগ ধরে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে আসছে আনন্দ-উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে।
ব্যবসায়ীরা এখনও হিসাবের নতুন খাতা- ‘হালখাতা’ খোলেন বৈশাখের প্রথম দিনে। এ জন্য মিষ্টান্নেরও আয়োজন থাকে। নববর্ষ উপলক্ষে দেশে গ্রামগঞ্জে নদীর পাড়ে, খোলা মাঠে কিংবা বটগাছের ছায়ায় মেলার আয়োজন করা হয়। দোকানিরা মুড়ি-মুড়কি, পুতুল, খেলনা, মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, বাঁশিসহ বাঁশের তৈরি বিভিন্ন জিনিসের পসরা নিয়ে বসে।
এভাবে বৈশাখ আসে আমাদের প্রাণের উৎসব হয়ে। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে এটি এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলা সনের উৎপত্তির সঙ্গে জড়িত এই দেশের মানুষের জীবনধারা এবং প্রকৃতির অবস্থার সঙ্গে ফসলের মৌসুম এবং খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন তারিখ তথা পঞ্জিকার প্রবর্তন হলেও এ নববর্ষ উৎসব বাঙালির চিন্তা-চেতনার সঙ্গে মিশে গেছে। এটা এমন একটা উৎসব যাকে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীসহ সকলেই সার্বজনীনভাবে প্রাণের আনন্দে বরণ করে নেয়।
বাংলা নববর্ষ অসুর দূর করে সুর সঙ্গীতের, মেলা ও মিলনের আনন্দ ও উৎসবের, সাহস ও সংকল্পের। দুঃখ-গ্লানি, অতীতের ব্যর্থতা পেছনে ফেলে তাই এগিয়ে যাওয়ার শপথ নেয়ার দিনও পহেলা বৈশাখ। দেশের কল্যাণে সকলেই এক কাতারে সামিল হয়ে এগিয়ে যাওয়ার অগ্নিশপথ নেয়ার দিনও এটি। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও বৈশাখের চেতনায় সিক্ত হতে হবে। সকল বাধাবিপত্তি ও বিধিনিষেধ উড়িয়ে এগিয়ে যেতে হবে। দূর করতে হবে সকল কলুষতা।
এবারের বৈশাখ এসেছে এমন সময়ে যখন গোটা পৃথিবী করোনানামক মরণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণে বিপর্যস্ত। সারাবিশ্বে এরই মধ্যে লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বাংলাদেশেও সরকারি হিসাবে ৩৯ জনের প্রাণ গেছে। আক্রান্ত আট শতাধিক। ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এই সময়ে সবাইকে ঘরে থাকতে হবে। মেনে চলতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। বৈশাখের সব অনুষ্ঠানও বাতিল করা হয়েছে। এই সংকটকালে এবারের বৈশাখে নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটুক। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা। স্বাগত ১৪২৭ বঙ্গাব্দ।
এইচআর/বিএ/এমকেএইচ