বিএনপির প্রতিক্রিয়া
ঐকমত্য কমিশন ঐক্যের বদলে ‘জাতীয় অনৈক্য’ করার প্রচেষ্টা নিয়েছে
ঐক্য কমিশনের সুপারিশ নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন সালাহউদ্দিন আহমদ
সুপারিশের মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার বদলে ‘জাতীয় অনৈক্য’ প্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে বলে মন্তব্য করেছে বিএনপি।
মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সঙ্গে বৈঠকের পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এমন প্রতিক্রিয়া দেন।
এর আগে দুপুরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ জমা দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আজকে তাদের সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় নেই। কেন ধন্যবাদ দিচ্ছি? অবশেষে তারা তাদের প্রক্রিয়া বা কার্যক্রম সমাপ্ত করতে পেরেছেন।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, দ্বিতীয়বার তাদের ধন্যবাদ দিচ্ছি—তারা জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বদলে ‘জাতীয় অনৈক্য’ প্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছেন।
‘আমার মনে হয়, যা কিছু প্রস্তাব ওখানে দেওয়া হয়েছে, আপনারা যদি সেটা দেখেন, তাহলে দেখবেন আমরা যে জুলাই জাতীয় সনদ সই করেছি, সেই সনদবহির্ভূত অনেক আদেশ এতে সংযুক্ত করা হয়েছে’—বলেন বিএনপির এ নেতা।
আরও পড়ুন
জাতীয় নির্বাচনের দিন বা আগে গণভোটের সুপারিশ
ইসি থেকেও রিটার্নিং কর্মকর্তা চায় জামায়াত
এদিন দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ কমিশন সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে এ সুপারিশপত্র তুলে দেন।
বিএনপির এ নেতা বলেন, জুলাই সনদের বিভিন্ন দফায় আমাদের এবং অন্য দলের কিছু ভিন্ন মত আছে, নোট অব ডিসেন্ট আছে। সেখানে পরিষ্কারভাবে সেটা উল্লেখ করা আছে। এই বিষয়গুলো রাজনৈতিক দলগুলো যারা দিয়েছে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক যদি ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত হয় তাহলে তারা সেভাবে সেটা বাস্তবায়ন করতে পারবেন। সেটা প্রকাশিত জুলাই সনদের বইয়ে আছে।
‘অথচ আজকে বিস্ময়করভাবে যে সংযুক্তিগুলো দেওয়া হলো সুপারিশমালার সঙ্গে, সেখানে এই নোট অব ডিসেন্টের কোনো উল্লেখ নেই।’
তিনি বলেন, গণভোট আয়োজনের ক্ষেত্রে অবশ্য তারা দুটি অপশন রেখেই বলেছেন—আগে অথবা পরে হতে পারে, সেটা সরকার বিবেচনা করবে। অথবা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবার আলোচনা হতে পারে।
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে সংবিধান সংস্কার পরিষদের নামে এখানে নতুন একটা আইডিয়া সংযুক্ত করা হয়েছে জানিয়ে বিএনপির এ নেতা বলেন, যেটা আগে কখনো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের টেবিলে ছিল না, আলোচনা হয়নি, এ বিষয়ে কোনো ঐকমত্য হয়নি। আমরা জানি আসন্ন যে নির্বাচনটা হবে সেটা হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হবেন। সেই সংসদ সদস্যদের সংবিধান সংস্কার পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়, সেটা তো জাতীয় সংসদেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
‘জাতীয় সংসদে কী সিদ্ধান্ত হবে সেটা তো আলোচিত হয়নি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে। এ বিষয়ে কোনো আলোচনা না হওয়ার পরেও এই সুপারিশমালার মধ্যে হঠাৎ করে আগামী জাতীয় সংসদ একই সঙ্গে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে, এ সিদ্ধান্তটা উনারা আরোপ করতে পারেন না, চাপিয়ে দিতে পারেন না।’
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার কথা। সংবিধান সংস্কার পরিষদের জন্য তো কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। নির্বাচন কমিশনের ম্যান্ডেট হলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা।
‘হ্যাঁ, আমরা যে গণভোটের প্রস্তাব করেছি, সেই গণভোটের মধ্য দিয়ে জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়নের পক্ষে জনগণ যদি সম্মতি দেয়, সেটা জনগণের একটা সার্বভৌম সম্মতি হবে, অর্থাৎ আগামী জাতীয় সংসদ ও সংসদ সদস্যরা সেটা বাস্তবায়ন করার জন্য বাধ্য থাকবে। সেটা হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। যেভাবে জুলাই জাতীয় সনদ সই হয়েছে, ঠিক সেভাবেই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নোট অব ডিসেন্টসহ।’
তিনি আরও বলেন, এখন যেসব প্রশ্ন আমি দেখলাম- এখানে বলা হয়েছে নিম্নকক্ষের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক আসনের হারের মধ্য দিয়ে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। এমন তো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত হয়েছে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে ১০০ সদস্যের এবং তারা কোন পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবেন, সেটার ব্যাপারে তো ঐকমত্য হয়নি। কেউ ভোটের অনুপাতে চেয়েছে, আমরা চেয়েছি নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে।
‘উচ্চকক্ষের এখতিয়ারের বিষয়ে বলা আছে, অর্থবিল ও আস্থা ভোট বাদে সবকিছু উচ্চকক্ষে উপস্থাপন করা হবে। এখানে কার্যপরিধি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট আছে। উচ্চকক্ষ যেহেতু সরাসরি নির্বাচিত নয়, তাই সংবিধান সংশোধনীসহ অন্য বিষয়গুলো তারা বিবেচনা করতে পারেন না। জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার কারও নেই। এ বিষয়গুলো আলোচনা হওয়ার পরেও নোট অব ডিসেন্ট থাকার পরেও তারা সরাসরি সংযুক্তিতে রেখেছেন। এগুলো কোনোভাবেই বিবেচনা করা যায় না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ সদস্য বলেন, আরেকটি আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে- তারা একটা সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে এসব সংস্কার প্রস্তাব গৃহীত না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেটা সংবিধানে সংযুক্ত হবে। এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার।
‘পরীক্ষায় অটোপাসের মতো কোনো বিষয় তো সংবিধানে থাকতে পারে না। এগুলো কিভাবে সুপারিশ এলো আমি জানি না। এছাড়া তাদের সংযুক্তগুলোর মধ্যে একটা কলামে আমি দেখলাম যে আর্টিকেলগুলো সংশোধিত হলে গণভোটের ব্যবস্থা আছে, সেই গণভোটের ব্যবস্থার মধ্যে সেটা পরবর্তীতে সংশোধিত হওয়ার পর গণভোট হতে হবে।’
‘ওখানে আমরা কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছিলাম, সেগুলো সংযুক্ত হয়েছে। বেসিক ক্লজগুলো তো এখানে আছে। আমরা তো সেগুলো প্রস্তাব দিয়েছি সংশোধনী আনার জন্য। আর একটা জায়গায় প্রস্তাব করেছে গণভোট লাগবে না, অথচ আর একটা ক্লোজে বলেছে লাগবে। এগুলো তারা কেন খেয়াল করেনি আমি জানি না।’
আরও পড়ুন
নির্বাচনের আগে গণভোটের সুযোগ নেই: বিএনপি
তিনি বলেন, সংবিধান তো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। এ আইনগুলো সংশোধনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। আরও অনেক বিষয় আছে, কয়েকশ পৃষ্ঠার সংযুক্তি রয়েছে। সেগুলো দেখে আমরা খুব শিগগির কাল বা এর পরের দিন প্রেসের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলবো।
বাস্তবায়নের বিষয়ে আপনাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, আলোচনা তো চার-পাঁচ দিন হয়েছে। কিন্তু যা আলোচনা করলাম তা এখানে নেই।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে কি না, বিএনপি এ সরকারকে আস্থায় নিচ্ছে কি না—এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, এ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। আমরা আশা করি, যথাযথ প্রক্রিয়ায় সুপারিশগুলো বিবেচনা করা হবে এবং আইনানুগ সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় আমরা জাতীয় সংসদ নির্বাচন পাবো। আরও আশা করি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে।
তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশন সুপারিশ যা দেওয়ার দিয়েছে, আমার মনে হয় কমিশন নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য কিছু সুপারিশ দিয়ে তারা কার্যক্রম সমাপ্ত করতে চেয়েছে। আশা করি এটি উপদেষ্টা পরিষদ, সরকার পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করবে, বিবেচনায় নেবে এবং যেটা আইনানুগ হবে, সাংবিধানিক ভিত্তি থাকবে, যে প্রক্রিয়ায় গেলে আমরা একটা নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচন করতে পারবো, সেই প্রক্রিয়াটা তারা গ্রহণ করবেন।
আপনারা কি আশ্বস্ত যে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে—এ বিষয়ে বিএনপির এ নেতা বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না, এটি কি কোনো রাজনৈতিক দল বলেছে নাকি? অন্য কেউ, সরকার বা নির্বাচন কমিশন? কেউ তো বলেনি যে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে না বা আমরা চাই না। অবশ্যই হবে, হতে হবে।
জোটবদ্ধ নির্বাচন করলে এনসিপি কি বিএনপির সঙ্গে আসবে কি না—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে পরে কথা বলবো।’
আরএমএম/এমকেআর/এএসএম