ভিডিও EN
  1. Home/
  2. রাজনীতি

সন্ধ্যার দিকে জানতে পারি, নেত্রী সুধাসদনে পৌঁছেছেন

আমানউল্লাহ আমান | প্রকাশিত: ০৮:১৪ এএম, ২১ আগস্ট ২০২০

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের আহ্বানে সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ ও মিছিলের আয়োজন হয়েছে। মিছিলপূর্ব সমাবেশের আয়োজন ছিল ট্রাকের ওপর অস্থায়ীভাবে স্থাপিত মঞ্চ ঘিরে। সেই মঞ্চেই বক্তব্য দিচ্ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তার বক্তব্যের পরেই সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল বের হবে। মিছিলের প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন দলের নেতাকর্মীরা।

তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন দেলোয়ার হোসেন। রাজধানীর জিরো পয়েন্ট মোড়ে মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি ও তার সংগঠনের নেতাকর্মীরা। শেখ হাসিনার বক্তব্যের মাঝামাঝি সময়ে শুনতে পান বিকট শব্দ। দৌড়ে যান বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে। রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের। ঘটনাস্থল থেকে চলে যেতে দেখেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার গাড়িটি। দেলোয়ার হোসেনের বুকের ভেতরটায় যেন কামড় দিয়ে উঠল, ‘নেত্রীকে নিয়ে কোথায় গেল?’ আগেই মুঠোফোনে খবর পেয়েছিলেন, শেখ হাসিনার ওপর আক্রমণ হয়েছে। মনে তখন নানা শঙ্কা-আশঙ্কার উঁকিঝুঁকি।

আওয়ামী লীগের সমাবেশে সেদিন গ্রেনেড হামলা হয়েছিল। সেই হামলার ১৬তম বার্ষিকী শুক্রবার (২১ আগস্ট)। ২৫ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়া লোমহর্ষক সেই ঘটনার অভিজ্ঞতার কথা জাগো নিউজকে বলছিলেন দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, আমি যখন দৌড়ে পার্টি অফিসের সামনে পৌঁছাই, তখন দেখলাম নেত্রীর গাড়ি চলে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে। তখনও আমরা জানি না নেত্রী বেচেঁ আছেন কি-না। প্রায় সন্ধ্যার দিকে নেত্রীর একান্ত সহকারীর কাছ থেকে জানতে পারি নেত্রী সুধাসদনে (পারিবারিক বাসভবন) পৌঁছেছেন।

তিনি বলেন, মিছিলে কে প্রথম যাবে তা নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা ছিল ছাত্রলীগের সঙ্গে যুবলীগের।
ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার মিছিল না গেলে অন্যদের সাহসে কিছুটা ভাটা দেখা যেত। সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল শুরু হওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। আমাদের নেত্রীর ভাষণের প্রায় মাঝপর্যায়ে আমরা জিরো পয়েন্ট মোড়ে চলে আসি এবং ওই মোড়ে জড়ো হতে থাকি। মিছিল শুরু হওয়ার পূর্ব-মুহূর্তে বিকট শব্দ শুনতে পাই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি বলেন, তখন মানুষজনকে এদিকে-ওদিকে ছোটাছুটি করতে দেখি। আমরা তখনও জানি না কী হয়েছে। দুই মিনিটের মধ্যেই একজন সাংবাদিক চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে কল দিয়ে বললেন, আপনারা ওইখানে কেন? এখানে তো নেত্রীকে মেরে ফেলছে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আমরা যে কজন ছিলাম দৌড়ে পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দিকে আসছিলাম। আমরা আসছিলাম কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে যাওয়ার জন্য আর মানুষ দৌড়াচ্ছিল বের হওয়ার জন্য ভয়ে-আতঙ্কে। আমরা যেখানে ছিলাম সেখান থেকে সবাইকে দৌড়াতে দেখেছি। মানুষের আতঙ্ক আরও বেড়ে গিয়েছিল পুলিশের ছোড়া টিয়ার শেলের শব্দ আর ধোঁয়ায়। পুলিশ আহতদের উদ্ধার না করে উল্টো আমাদের দিকে টিয়ার শেল মারছিল।

তিনি বলেন, কিছুক্ষণ আগেও যারা জড়ো হয়েছিল তাদের কার, কী অবস্থা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। আমাদের নেতাদের কেউ কারও খোঁজ নেয়ার মতো পরিস্থিতিতে ছিলেন না। কে বেঁচে আছে, কে মরে গেছে, কে আহত- এগুলো বোঝার মতো উপায় ছিল না। মানুষের ছোটাছুটিতে আরও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে আরেকজন সাংবাদিক ফোন করেন। ওই সাংবাদিকও চিৎকার করে কাঁদছিলেন। আমাকে বললেন, নেত্রীকে মেরে ফেলার জন্য আক্রমণ করা হয়েছে। ওই সময়ে গুলি হচ্ছে, না কী হচ্ছে, সেটা কেউ বুঝতে পারছিল না। তখন সবাই বলছিল, গুলি হচ্ছে-গুলি হচ্ছে। নেত্রীর ওপর আক্রমণ হয়েছে। যে যেখানে আছো, সবাই আসো। তাড়াতাড়ি আসো।

দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমরা দৌড়াতে দৌড়াতে যখন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কাছাকাছি তখন আমাদের সামনে দিয়ে নেত্রীর গাড়ি চলে যেতে দেখলাম। আমি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখলাম রক্ত আর রক্ত। সাবের হোসেন চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (প্রয়াত), আইভী রহমান (আহত হয়ে মারা যান) রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। সেখান থেকে আমরা একেকজনকে কোলে করে তুলে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করছিলাম।

তিনি বলেন, তখন কেউ একজন আমাকে বললো, তোমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ঢাকা মেডিকেলের সামনে যাও। এদেরকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করো। হলে খবর দাও, রক্ত আনো। এরা সবাই রক্তাক্ত, মারা যাচ্ছে। ওখান থেকে আহতদের তখন ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হচ্ছে। আমরা গেলাম ঢাকা মেডিকেলে। ঢাকা মেডিকেলে যাওয়া রোগীদের সঙ্গে আমরাও পৌঁছালাম। তখন ঢাকা মেডিকেলে কোনো ডাক্তার নেই। সবাই ধরাধরি করছে আহতদের। কান্নাকাটি আর চিৎকার। কিন্তু কোনো ডাক্তার নেই। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ডাক্তাররা সরে গেছেন, নাকি ডাক্তারদের সরিয়ে নেয়া হয়েছে, তা আমরা জানি না।

ছাত্রলীগ সভাপতির দায়িত্ব শেষে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন দেলোয়ার হোসেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে দ্বিতীয় মেয়াদে বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

গ্রেনেড হামলার পর কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল— জানিয়ে দেলোয়ার হোসেন বলেন, চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল থেকে আহত অনেককেই সিকদার মেডিকেলসহ বিভিন্ন মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনার আধাঘণ্টা পর আমরা কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হই। প্রায় সন্ধ্যার দিকে নেত্রীর একান্ত সহকারীর কাছ থেকে জানতে পারি যে, নেত্রী সুধাসদনে পৌঁছেছেন। তখন কিছুটা স্বস্তিবোধ করি। কিন্তু তখনও জানি না যে, নেত্রী কী অবস্থায় আছেন।

এইউএ/এইচএ/এমএআর/পিআর