সংবিধানে জুলাই সনদ না থাকলে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কতটা নিরাপদ?
আবুল কালাম আজাদ
আবুল কালাম আজাদ, যুক্তরাষ্ট্র
জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি এক ক্রান্তিলগ্ন অতিক্রম করছে। দীর্ঘ সময় ধরে জমে থাকা ক্ষোভ, দুঃশাসন, নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি অবিশ্বাস, রাষ্ট্রযন্ত্রের দলীয়করণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে জনতার প্রতিবাদ যখন বিস্ফোরিত হলো, তখনই জন্ম নিলো জুলাই সনদ—একটি অধিকারভিত্তিক জাতীয় চুক্তি, যা জনগণ রাষ্ট্রের কাছে দাবি হিসেবে পেশ করেছিল।
এই সনদ মূলত সেই মুহূর্তের আবেগ, বাস্তবতা এবং জাতীয় অভিলাষের সমন্বিত প্রকাশ। জনগণ চেয়েছিল রাষ্ট্রপুনর্গঠন, ক্ষমতার ভারসাম্য, স্বচ্ছতা, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, জবাবদিহি প্রশাসন এবং একটি গ্রহণযোগ্য ও নির্ভুল নির্বাচনি কাঠামো। তাই এই সনদ শুধু একটি রাজনৈতিক দলিল নয়; এটি ছিল জনতার নৈতিক চাপ, সামাজিক চুক্তি এবং গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের ঘোষণাপত্র। কিন্তু এই সনদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত না হলে কী ঘটতে পারে—এটি আজ দেশের সামনে বড় প্রশ্ন।
সেই সঙ্গে আছে অন্তরবর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতা ও দায়—যারা জনতার প্রত্যাশা পূরণের বদলে অনেক ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ করেছে, কিছু ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কার এড়িয়ে গেছে।
প্রথমত, জুলাই সনদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত না হলে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে উঠবে। কারণ অভ্যুত্থানের পর জনগণ যে প্রত্যাশা নিয়ে মাঠে নেমেছিল তা ছিল রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করা—নতুন করে বিশ্বাস স্থাপন করা। সংবিধান একটি রাষ্ট্রের আত্মপরিচয়। জনগণের আন্দোলনের চাহিদা যদি সেখানে প্রতিফলিত না হয়, তাহলে রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আস্থা ভেঙে যাবে।
মানুষ মনে করতে শুরু করবে যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী যে পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছিল, তা কেবল রাজনৈতিক বক্তৃতা, প্রকৃত কোনো পরিবর্তন নয়। আস্থাহীনতা রাজনীতির জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক। আস্থাহীন জনগণ হয় চরম নিস্তেজ হয়ে পড়ে, নয়তো আবার নতুন করে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়। উভয়ই রাষ্ট্রের জন্য অস্থিতিশীলতা ডেকে আনে।
জুলাই সনদ অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার পরিণতি শুধুই রাজনৈতিক নয়, সামাজিকও। বাংলাদেশ বহু বছর ধরে গভীর মেরুকরণের মধ্য দিয়ে গেছে। দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে প্রশাসন, ব্যবসা, শিক্ষা, বিচারব্যবস্থা—সবখানেই বিভাজন তৈরি হয়েছে। জুলাই সনদকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হলে একটি জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হতো—যা এই মেরুকরণ কমানোর প্রথম শর্ত। কিন্তু যদি তা না করা হয়, তাহলে পুরোনো মেরুকরণ আরও জটিল হবে।
যে রাজনৈতিক শক্তিগুলো অভ্যুত্থানের আগে শক্ত ছিল তারা নতুন যুক্তি তৈরি করবে—জনতার দাবি উপেক্ষিত হয়েছে, তাই তাদের পুরোনো অবস্থানে ফিরে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। এটি দীর্ঘমেয়াদে দেশে নতুন ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
এখন প্রশ্ন আসে—এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায় কতটা? জনগণ যে অভ্যুত্থানকে পথ দেখিয়েছে, সেই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের দায়িত্ব ছিল সনদকে সাংবিধানিক কাঠামোতে রূপান্তর করা। কারণ জনগণ তাদের ওপর আস্থা রেখেছিল। ক্ষমতায় আসার সময় তারা অঙ্গীকার করেছিল যে তারা নিরপেক্ষ, সময়সীমাবদ্ধ, জনআকাঙ্ক্ষা-প্রতিফলিত সংস্কার করবে। কিন্তু সেই প্রত্যাশার অনেকটাই অপূর্ণ রয়ে গেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব ছিল তিনটি: অবিলম্বে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পুরোনো রাষ্ট্রকাঠামোর দলীয়করণ ভেঙে দেওয়া এবং দ্রুত মৌলিক সাংবিধানিক সংস্কার শুরু করা। কিন্তু তারা সেই তৃতীয় দায়িত্বটিতে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা দেখিয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম ব্যর্থতা ছিল তাদের ধীরগতি। যে কোনো অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে সময় অত্যন্ত মূল্যবান। জনগণের উত্তেজনা, আশা এবং আবেগ—এগুলো খুব দ্রুত ক্ষয় হয়। যদি সেই আবেগকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত না করা হয়, তবে তা হতাশায় পরিণত হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুরু থেকেই সময়ক্ষেপণ করেছে। তারা জুলাই সনদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করতে পারত—কমিশন গঠন, বিশেষ কমিটি, বিশেষ সেশন, জনপরামর্শ—কিন্তু এগুলোর কোনোটাতেই দৃশ্যমান অগ্রগতি ছিল না। তারা একদিকে বলেছে যে কাজ চলছে, কিন্তু জনগণ বাস্তব প্রয়োগ দেখতে পায়নি।
দ্বিতীয়ত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আরও একটি গুরুতর ব্যর্থতা ছিল বিচার বিভাগীয় সংস্কার না করা। জুলাই সনদে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু বাস্তবে বিচারব্যবস্থার কাঠামো আগের মতোই রয়ে গেছে। বিচারপতির নিয়োগ প্রক্রিয়া, স্বচ্ছতা, স্বাধীনতাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা—এসব কিছুই untouched ছিল। ফলে জনগণের মনে সেই পুরোনো ধারণা ফিরে এসেছে যে ‘প্রশাসন বদলায়, কিন্তু কাঠামো বদলায় না।’
তৃতীয় ব্যর্থতা ছিল নির্বাচন কমিশনের সংস্কার। জনগণের সর্বোচ্চ প্রত্যাশা ছিল—একটি স্বচ্ছ, শক্তিশালী, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নির্বাচন কমিশন—যা ভবিষ্যতে কোনো দলীয় প্রভাব বা সরকারি চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কমিশনের reconstitution করতে পারত, কমিশনকে সাংবিধানিক স্বাধীনতা দিতে পারত, নির্বাচনি আইনে সংশোধনী আনতে পারত। কিন্তু তারা মূলত সামান্য পরিবর্তন করে দায়িত্ব সেরে ফেলেছে। এতে নির্বাচন কমিশনকে জনগণ এখনো সম্পূর্ণ আস্থার জায়গায় দেখতে পারছে না।
চতুর্থত, প্রশাসনের দলীয়করণ ভাঙা ছিল জুলাই সনদের অন্যতম শর্ত। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই জায়গাতে খুব কম কাজ করেছে। তারা কিছু বদলি করেছে, কিছু কর্মকর্তাকে সাইডলাইন করেছে, কিন্তু কাঠামোগত পরিবর্তন করেনি। ফলে প্রশাসন এখনো অনেক ক্ষেত্রে পুরোনো প্যাটার্নে চলছে—যেখানে ক্ষমতার প্রতি আনুগত্য, দলভিত্তিক সুবিধা এবং রাজনৈতিক প্রভাবের প্রবণতা অব্যাহত আছে। যদি রাষ্ট্রের আমলা কাঠামো পরিবর্তন না হয়, তাহলে রাজনৈতিক পরিবর্তন কখনোই স্থায়ী হয় না।
এবার আসা যাক—কোন কোন জরুরি সংস্কারগুলো করা উচিত ছিল কিন্তু করা হয়নি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম কাজ হওয়া উচিত ছিল—সত্য ও পুনর্মিলন কমিশন গঠন। অভ্যুত্থানের সময় এবং তার অনেক আগে পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, খুন, রাষ্ট্রীয় নির্যাতন, নির্বাচন কারচুপি—এসব বিষয়ে সত্য উদঘাটন অত্যাবশ্যক ছিল। কিন্তু সরকার এই কাজ করতে ভয় পেয়েছে। তারা হয়তো অশান্তি এড়াতে চেয়েছে, কিন্তু সত্য প্রকাশ না করলে জাতি কখনোই পুনর্গঠন হতে পারে না।
দ্বিতীয় জরুরি সংস্কার ছিল—দলীয় রাজনীতির অর্থায়ন নিয়ন্ত্রণ। বাংলাদেশের রাজনীতির বড় ব্যাধি হচ্ছে অর্থের প্রভাব। বিদেশি তহবিল, কালো টাকা, কর্পোরেট লবি—সব মিলিয়ে রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই জায়গাটিতে কোনো নজর দেয়নি। যদি স্বচ্ছ অর্থায়ন না থাকে, তাহলে ভবিষ্যতের রাজনীতিও দুর্নীতিগ্রস্ত থাকবে।
তৃতীয় সংস্কার হওয়া উচিত ছিল—মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। জুলাই সনদে বলা হয়েছিল একটি স্বাধীন মিডিয়া কমিশন হবে, যা ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার স্বাধীনতা, সাংবাদিক নিরাপত্তা এবং তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে। কিন্তু তা হয়নি। বরং মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ আগের মতোই শক্ত রয়ে গেছে।
চতুর্থত, পুলিশ সংস্কার ছিল সময়ের দাবি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাঠামো ও আচরণ পরিবর্তন ছাড়া গণতন্ত্র স্থায়ী হয় না। অভ্যুত্থানের সময় পুলিশ যে আচরণ করেছে তা জনগণের মনে দীর্ঘসময় দাগ তৈরি করবে। পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা, শক্তি ব্যবহারের নীতিমালা পুনর্গঠন করা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা—এসব করা হয়নি। শুধু পোশাকের রং পরিবর্তনকে সংস্কার বলা যায় না।
পঞ্চমত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বড় কাজ হওয়া উচিত ছিল—ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা তার সমতুল্য আইন বাতিল বা সংশোধন করা। কিন্তু তারা তা করেনি। ফলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার হয়নি।
এই সব ব্যর্থতার প্রভাব অত্যন্ত গভীর। জুলাই সনদ যদি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত না হয়, তাহলে এই ব্যর্থতাগুলো আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। জনগণ বিশ্বাস করবে— অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সময় কাটিয়ে গেছে, কাঠামো বদল না করে দায়িত্ব পরবর্তী সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। এতে অভ্যুত্থানের চেতনা দুর্বল হয়ে পড়বে। জনগণের আন্দোলনের শক্তি কমবে। এমনকি অভ্যুত্থানের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে—এটি কি সত্যিই জনতার পরিবর্তনের জন্য ছিল, নাকি একটি রাজনৈতিক সংকটের সাময়িক সমাধান ছিল?
পরিশেষে, জুলাই সনদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত না হলে দেশ আবারও একটি চক্রে আটকে যাবে—দলীয় প্রভাব, অবিশ্বাস, নির্বাচন সংকট, ক্ষমতার বদল, আন্দোলন, অস্থিরতা। এই চক্র ভাঙার সুযোগ ছিল; অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। তাই এখনো সময় আছে—এখনো সনদকে জাতীয় নীতিমালা হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। নাহলে জনগণের ত্যাগ, রাষ্ট্রের সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যতের গণতন্ত্র—সবই ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে।
আবুল কালাম আজাদ
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ও কলামিষ্ট
[email protected]
এমআরএম/এএসএম