এমন রাজনীতি চাই না, আর এক মুহূর্তও চাই না
আবুল কালাম আজাদ
আবুল কালাম আজাদ, যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এমন এক অদ্ভুত জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্য নেই, সত্যের দাম নেই, নৈতিকতা নেই-আছে শুধু শক্তির প্রদর্শনী, প্রভুর তোষণ, আর ক্ষমতার বাজারে নিজের দর বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। আমরা এমন রাজনীতি চাই না। এই দেশের মানুষ আর সেই পুরোনো নাটকের দর্শক হতে চায় না, যেখানে চরিত্র বদলায়, মুখোশ বদলায়, কিন্তু মানুষের ভাগ্য বদলায় না।
দীর্ঘদিন ধরে আমরা এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির শিকার, যেখানে ক্ষমতায় গেলে নেতারা নিজেদের উন্নতির সিঁড়ি গোনেন, আর ক্ষমতার বাইরে গেলে দেশের ক্ষতি করার নতুন নতুন ফর্মুলা বের করেন। জনগণের উন্নতি শব্দটা তাদের মুখে উচ্চারিত হলেও বাস্তবে তা পরিণত হয় নিজেদের ভাগ্যের জোয়ারে। এই ভণ্ডামির রাজনীতি মানুষ অনেক সহ্য করেছে; আর না।
আমরা এমন রাজনীতি চাই না, যা বিদেশি রাষ্ট্রদূতের দরজায় দাঁড়িয়ে ইশারায় হাঁটু গেড়ে বসে। স্বাধীনতা অর্জনের এত বছর পরও যদি কোনো রাজনৈতিক নেতা বিদেশি দূতাবাসে ‘অনুমোদন’ নিতে যায়, তাহলে সেটি দেশের জন্য লজ্জাজনক, অপমানজনক। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যদি বিদেশি সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে, তবে স্বাধীনতার অর্থ কোথায়? দেশের জাতীয় স্বার্থ কোথায়? বিদেশের কাছে নতজানু হয়ে চলা রাজনীতি কোনোদিনই দেশকে সম্মানে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেয় না-দাসত্বের মনোভাব কখনো শক্তি আনতে পারে না।
আজকের রাজনীতিতে যারা ক্ষমতায় যায়, তারা জনগণের নামে স্লোগান দেয়, অথচ উন্নয়ন হয় তাদের ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে, বিদেশের বাড়িতে, বিলাসবহুল গাড়ির সারিতে। তাদের পরিবারের ভাগ্য বদলায় ঝড়ের গতিতে, আর দেশের মানুষ জীবনযুদ্ধে প্রতিদিন এক ইঞ্চি জমি পেতে লড়াই করে। জনগণ ভোট দেয়, আশা দেয়, বিশ্বাস দেয়-বদলে কী পায়? প্রতিশ্রুতির পাহাড়, আর বাস্তবতার মরুভূমি।
এমন রাজনীতিকে ঘৃণা না করে উপায় কী?
আমরা এমন রাজনীতি চাই না-যা ক্ষমতা হারালে দেশকে পুড়িয়ে ফেলে। যে রাজনীতি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে পরিণত করে আগুনের খেলায়; যেখানে শহরের রাস্তাগুলোকে যুদ্ধক্ষেত্র বানানো হয়; যেখানে নিরপরাধ মানুষ পোড়ে, আর অপরাধী নেতা ভিডিও বার্তা দেয় দূর বিদেশে বসে। বাজার জ্বলে গেলে ক্ষতি হয় দোকানির; বাস পোড়ালে ক্ষতি হয় শ্রমিকের; গাছ কাটা হলে ক্ষতি হয় পরিবেশের; কিন্তু এক ফোঁটা ক্ষতি হয় না সেই নেতার, যার নির্দেশে আগুন লাগানো হয়।
এই আগুন–নির্ভর রাজনীতি, ভাংচুর–নির্ভর আন্দোলন, বিরোধী মানেই শত্রু-এমন মানসিকতা কোনো সভ্য জাতি মেনে নিতে পারে না।
রাজনীতি যদি মানুষের জীবন কেড়ে নেয়, তাহলে সেটা ক্ষমতা নয়, বর্বরতা।
আজকের বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্মম দৃশ্যগুলোর একটিই হলো-রাস্তা অবরোধের নামে মুমূর্ষু রোগীকে আটকে রাখা। অ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেন শেষ হয়ে আসে, আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে দাগানো টায়ারের ধোঁয়া। একজন মানুষের জীবন ঝরে যায় কেবল এজন্য যে রাজনৈতিক দলগুলোর অহংকারের দাম মানুষের রক্তের চেয়েও বেশি। এ দৃশ্য যে দেশে বারবার ঘটে, সেই দেশে আন্দোলন নয়-অমানবিকতার উৎসব চলে।
এই বাংলাদেশে এমন রাজনীতি চাই না।
আমরা চাই এমন রাজনীতি, যেখানে বৈষম্য থাকবে না। আজও আমরা দেখি-একদিকে আকাশচুম্বী টাওয়ার, অন্যদিকে বস্তির ফুটোপ্লাস্টিকের ঘর; একদিকে হাজার কোটির প্রকল্প, অন্যদিকে একজন কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কান্না। শিক্ষা একটি শ্রেণির হাতে বন্দি, কর্মসংস্থান ক্ষমতাধরদের চক্রের হাতে, ন্যায়বিচার কারও পক্ষে আলাদা, কারও পক্ষে আলাদা। এই বৈষম্য কেবল অর্থনৈতিক নয়-এটি মানসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক। এমন বৈষম্যে দেশ টেকে না, সমাজ ভেঙে পড়ে, রাষ্ট্র দুর্বল হয়।
আমরা চাই সেই রাজনীতি যা চায় একটি সমান দেশ-ধনী-গরিব সবার সুযোগ থাকবে, সব নাগরিকের অধিকার থাকবে, রিকশাওয়ালা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পর্যন্ত সবাই মানুষ হিসেবেই বিবেচিত হবে।
আমরা এমন রাজনীতি চাই, যা সত্যিকারের উন্নতি ঘটাবে মানুষের। নেতা-মন্ত্রী-ব্যবসায়ী-বরাদ্দ-কমিশন-এই চক্রের উন্নতি নয়; দেশের উন্নতি-সবার উন্নতি। এই দেশের সম্ভাবনা অসীম-৩ কোটি তরুণ, সোনার ফসল, প্রাকৃতিক সম্পদ, উদ্যোক্তা শক্তি। কিন্তু সম্ভাবনাকে পরিণত করতে দরকার দৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যাদের চশমার কাঁচে বিদেশের দরজা নয়, দেশের ভবিষ্যৎ ভাসমান থাকবে।
আমরা এমন রাজনীতি চাই, যা দেশের মানুষের জান–মালের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেবে। আজ মানুষ রাস্তায় বের হলে জানে না কখন কী হবে; সন্ধ্যার পরকার কেউ আতঙ্কে থাকে, বিচার পেতে হলে ক্ষমতাসীনদের মুখাপেক্ষী হতে হয়। অপরাধীরা রাজনৈতিক ছায়ায় বেঁচে যায়; সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে।
আইন যদি ক্ষমতাহীনদের ওপর কঠোর হয়, আর ক্ষমতাবানদের ক্ষেত্রে অন্ধ হয়ে যায়-তাহলে সে সমাজে ন্যায়বিচার নেই, আছে পক্ষপাতদুষ্টতার জাল।
এমন বাংলাদেশ চলতে পারে না।
বাংলাদেশকে এমন রাজনীতি গড়তে হবে, যা আমাদের অর্থনীতি, শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, মানবসম্পদ-সবকিছু উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেবে। যেখানে একটি শিশু বড় হবে নিরাপদ পরিবেশে; একজন ছাত্র শিক্ষা পাবে সমান সুযোগে; একজন শ্রমিক তার অধিকার নিশ্চিত পাবে; একজন উদ্যোক্তা সৎ পথে ব্যবসা করতে পারবে; একজন কৃষক তার ফসলের দাম পাবে; একজন নাগরিক তার মর্যাদা বজায় রাখতে পারবে।
আজকের দুনিয়ায় প্রতিযোগিতার মাঠ অত্যন্ত কঠিন-যে দেশ জ্ঞান-প্রযুক্তি-অর্থনীতিতে এগিয়ে যাবে, সে দেশই বিশ্বকে চমকে দেবে। কিন্তু আমরা কি এগোতে পারব, যদি রাজনীতি থাকে কাদা–ছোঁড়া, লাঠি–ঝাঁপটা, হরতাল–অবরোধ, বিদেশী অনুমতির রাজ্যে?
না, এভাবে দেশ এগোয় না।
যে দেশকে স্বাধীনতার জন্য লাখো মানুষ রক্ত দিয়েছে, সেই দেশের রাজনীতি কখনোই কলুষিত, দুর্নীতিপ্রবণ, সহিংসতাপূর্ণ থাকতে পারে না।
আমরা চাই রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলাক।
আমরা চাই রাজনীতির ভাষা বদলাক।
আমরা চাই রাজনীতির লক্ষ্য বদলাক।
প্রতিহিংসার জায়গায় আসুক সহযোগিতা, অপমানের জায়গায় আসুক শালীনতা, আগুনের জায়গায় আসুক যুক্তি, ভাঙচুরের জায়গায় আসুক সমাধান।
বাংলাদেশ কোনো দলের নয়-কোনো নেতার নয়-এটি কোটি মানুষের। এ দেশকে গড়তে হলে সবার হাত লাগবে, সবার মন লাগবে, সবার অধিকার নিশ্চিত হবে।
আমরা এমন রাজনীতি চাই-যা দেশের সব মানুষকে সুখে–শান্তিতে বাঁচতে দেবে; জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, অর্থে–বৃত্তে শক্তিশালী করে তুলবে; এবং একদিন বিশ্বমঞ্চে মাথা উঁচু করে বলবে-বাংলাদেশ পারে, বাংলাদেশ যোগ্য, বাংলাদেশ সম্মানপ্রাপ্ত।
আমরা চাই রাজনীতি বদলাক-শুধু দল বদলালে হবে না; মানসিকতা, নীতিমালা, উদ্দেশ্য, আচরণ-সবকিছু বদলাতে হবে।
কারণ এই বাংলাদেশে এমন রাজনীতি আর চাই না, যা দেশকে পিছিয়ে দেয়;
চাই সেই রাজনীতি, যা দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়।
মানুষ স্পষ্ট করে দিয়েছে-
‘যে রাজনীতি মানুষের, সে রাজনীতিই আমরা চাই। যে রাজনীতি ধ্বংসের, সে রাজনীতি আর সহ্য করব না।’
আবুল কালাম আজাদ
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ও কলামিস্ট
[email protected]
এমআরএম/এএসএম